Saturday 28 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আমদানির আড়ালে লোপাট ৩০০ কোটি টাকা


২ জানুয়ারি ২০২০ ০৮:০১

ঢাকা: পেঁয়াজ। এরইমধ্যে অস্থিরতার দিক থেকে পণ্যটি ইতিহাস তৈরি করে ফেলেছে। গত সেপ্টেম্বরে ভারত রফতানি বন্ধের পর থেকে বাংলাদেশে পণ্যটি নিয়ে যা হয়েছে তা সাধারণ মানুষ মনে রাখবেন অনেক দিন।

এদিকে, শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর দিয়েছে বিস্ফোরক তথ্য। তাদের অভিভাবক প্রতিষ্ঠান জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে এক প্রতিবেদনে তারা জানিয়েছে, শুধু মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আমদানি করেই বিদেশে পাচার করা হয়েছে প্রায় তিনশ কোটি টাকা। আর বলাই বাহুল্য, কাজটা আমদানিকারকদের।

বিজ্ঞাপন

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর এই অর্থ পাচারের বিষয়টি তদন্ত করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অনুমতির অপেক্ষায় রয়েছে বলেও তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ডের তথ্য মতে, মিয়ানমার থেকে ২০১৯ সালে প্রথম পেঁয়াজ আমদানি করা হয় ৩১ আগস্ট। তখন মিয়ানমারের বাজারে পেঁয়াজের কেজিপ্রতি দাম ছিল ২৯ টাকা। ঠিক সেই সময়ে দেশের পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আমদানির ঘোষণাপত্রে প্রতি কেজি ৪৩ টাকা উল্লেখ করে। অপরদিকে সেপ্টেম্বরে মিয়ানমারের বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ছিল ৮০ টাকা। তখন ব্যবসায়ীরা প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৪৩ টাকা দরে আমদানির ঘোষণা দেয়। অর্থাৎ প্রতি কেজি পেঁয়াজ আমদানিতে ৩৭ টাকা আন্ডার ইনভয়েসিং করা হয়েছে।

অক্টোবরে মিয়ানমারের বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ছিল ৮২ টাকা। এ সময় আমদানিকারকরা প্রতি কেজি পেঁয়াজ আমদানির ঘোষণা পত্রে ৪৩ টাকা দর উল্লেখ করে। অর্থাৎ প্রতি কেজি পেঁয়াজে আমদানিকারকরা ৩৯ টাকা আন্ডার ইনভয়েসিং করেছেন। পরে নভেম্বরে মিয়ানমারের বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ছিল ১৩০ টাকা। আর এই সময়ে আমদানিকারকরা প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৪৩ টাকা দর দেখিয়ে আমদানির ঘোষণা দেয়। যেখানে কেজি প্রতি পেঁয়াজে ৯১ টাকা আন্ডার ইনভয়েসিং করা হয়েছে। পেঁয়াজ আমদানিকারকরা যে ঘোষণা দিয়েছেন মূলত তার থেকে অনেক বেশি দরে তারা পেঁয়াজ কিনেছেন। অর্থাৎ আমদানিকারকরা মানিলন্ডারিং করেছেন। আর এভাবেই দেশ থেকে সুকৌশলে পাচার করা হয়েছে ২৯৪ কোটি ৫১ লাখ ৭৪ হাজার ৭৪০ টাকা।

বিজ্ঞাপন

মিয়ানমার থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ প্রতি মেট্রিকটন ৫০০ ডলার ঘোষণায় আমদানি করা হলেও আসলে আমদানিকারকরা প্রতি মেট্রিকটন ১২শ ডলারে কিনেছেন। অর্থাৎ প্রতি মেট্রিকটন পেঁয়াজ কেনার কেত্রে প্রায় ৭০০ ডলার আন্ডার ইনভয়েসিং হয়েছে। আর এই আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের টাকা আমদানিকারকরা ব্যাংকিং চ্যানেল বহির্ভুত হুন্ডি ও মানিলন্ডারিং করে অন্যভাবে পাঠিয়েছেন। অর্থাৎ মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আমদানির আড়ালে এই পরিমাণ টাকা পাচার হয়েছে। সাধারণত আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিং হয়ে থাকে কিন্তু সুকৌশলে আন্ডার ইনভয়েসিং করে এই অর্থ হুন্ডিতে পাচার করা হয়েছে।

এনবিআর থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশের পেঁয়াজ আমদানি মূলত ভারত নির্ভর। অর্থাৎ মোট আমদানির ৯৮.৫৩ শতাংশ পেঁয়াজই আসে ভারত থেকে। গত বছর ২৯ সেপ্টেম্বর বন্যার কারণে ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ ঘোষণা করলে অন্যান্য দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির জন্য এলসি খোলে বাংলাদেশ।

কাস্টমসের ডাটাবেজ অনুসারে, ২০১৬ সালে হংকং থেকে দশমিক ৪ মেট্রিক টন, আরব আমিরাত থেকে ২২ দশমিক ৬৩ মেট্রিক টন, থাইল্যান্ড থেকে ৫৫ দশমিক ৪১ মেট্রিক টন, মালয়েশিয়া থেকে দশমিক ৪২ মেট্রিক টন, পাকিস্তান থেকে ৫৮ মেট্রিক টন আর ভারত থেকে ৮ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৮ দশমিক ২ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে। আমদানি করা এই পেঁয়াজের দাম ১ হাজার ২৪৭ কোটি ৪১ লাখ টাকা।

অপরদিকে, ২০১৭ সালে মিশর থেকে ৩ হাজার ৮১৭ দশমিক ৯০ মেট্রিক টন, তুরস্ক থেকে দশমিক ১ মেট্রিক টন, আরব আমিরাত থেকে ২০ দশমিক ৫৪ মেট্রিক টন, পাকিস্তান থেকে ৮৩০ মেট্রিক টন, হংকং থেকে দশমিক ২২ মেট্রিক টন, থাইল্যান্ড থেকে ৭৯ দশমিক ৯ মেট্রিক টন, চীন থেকে ৪৩০ মেট্রিক টন ও ভারত থেকে ৯ লাখ ৪০ হাজার ৯ দশমিক ৭ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। আমদানি করা এই পেঁয়াজের দাম ২ হাজার ১৮৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা।

এদিকে, ২০১৮ সালে মিশর থেকে ৪৩৩ মেট্রিক টন, চীন থেকে ১৩২ মেট্রিক টন, তুরস্ক থেকে ৩৫৩ দশমিক ৫৩ মেট্রিক টন, অস্ট্রেলিয়া থেকে ১ দশমিক ১১ মেট্রিক টন, ইন্দোনেশিয়া থেকে ৩৮৭ মেট্রিক টন, আরব আমিরাত থেকে ৩৪ দশমিক ৯৯ মেট্রিক টন, সিঙ্গাপুর থেকে দশমিক ৫৭ মেট্রিক টন, থাইল্যান্ড থেকে ৫৬ দশমিক ৫৫ মেট্রিক টন, সৌদি আরব থেকে দশমিক ২ মেট্রিক টন আর ভারত থেকে ১১ লাখ ৫৩ হাজার ১২৯ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। আমদানি এসব পেঁয়াজের মূল্য ২ হাজার ৪২৭ কোটি ১৩ লাখ টাকা।

এছাড়া, ২০১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত থাইল্যান্ড থেকে আমদানি হয়েছে ৫১ দশমিক ৭৮ মেট্রিক টন, পাকিস্তান থেকে ৬৬২ দশমিক ৩৬ মেট্রিক টন, অস্ট্রেলিয়া থেকে ৩ দশমিক ২১ মেট্রিক টন, আরব আমিরাত থেকে ২৩১ দশমিক ৫৭ মেটিক টন, মিশর থেকে ৫ হাজার ৫১৫ দশমিক ১৩ মেট্রিক টন, মিয়ানমার থেকে ৩৮ হাজার ৫ দশমিক ৮৭ মেট্রিক টন, ভারত থেকে ৭ লাখ ৪৮ হাজার ৮৫৯ দশমিক ১৭ মেট্রিক টন, সিঙ্গাপুর থেকে ৭২৮ দশমিক ৯ মেট্রিক টন, ইন্দোনেশিয়া থেকে ১৭৫ মেট্রিক টন, চীন থেকে ২ হাজার ১৯১ দশমিক ৫৫ মেট্রিক টন ও তুরস্ক থেকে ১ হাজার ১০৬ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। আমদানি করা এই পেঁয়াজের দাম ১ হাজার ৬২২ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, বছরে দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ২৪ লাখ মেট্রিক টন। আর চলতি বছরে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ২৩ লাখ ৩০ মেট্রিক টন।

এদিকে কাস্টমসের অ্যাসাইকুডা সিস্টেমের তথ্য মতে, আগস্ট থেকে নভেম্বর সময়ে বিভিন্ন বন্দর দিয়ে ভারত, মিয়ানমার এবং অন্যান্য দেশ থেকে মোট ১ লাখ ৬৭ হাজার ৮০৬ দশমিক ৪৭ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে। এর মধ্যে ভারত থেকে ১ লাখ ২৬ হাজার ২২৫ দশমিক ৬২ মেট্রিক টন, মিয়ানমার থেকে ৩৪ হাজার ৮৬১ দশমিক ৩৮ মেট্রিক টন এবং অন্যান্য দেশ থেকে ৬ হাজার ৭১৯ দশমিক ৪৭ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে। সে অনুপাতে এই সময়ে ভারত থেকে ৭৫ শতাংশ, মিয়ানমার থেকে ২১ শতাংশ এবং অন্যান্য দেশ থেকে ৪ শতাংশ পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে।

ওয়ার্ল্ড কাস্টমসের তথ্য মতে, চলতি বছরের আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে ৩৪ হাজার ৮৬১ দশমিক ৩৮ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে, যার মূল্য ১৫১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। তবে এই পেঁয়াজ আমদানি মাধ্যমে মিয়ানমারে পাচার হয়েছে ২৯৪ কোটি ৫১ লাখ ৭৪ হাজার ৭৪০ টাকা। আমদানিকারকরা আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের (চালানপত্রে পণ্যের দাম কম দেখানো) এই টাকা পাচার করেছেন।

এ বিষয়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মো. সহিদুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘মানিলন্ডারিংয়ের আলামত আমরা পেয়েছি। এ বিষয়ে এনবিআরকে অবহিত করা হয়েছে। এনবিআরের অনুমতি পেলে অনুসন্ধান করে আরও বিশদ তথ্য পাব বলে আশা করছি।’

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আন্ডার ইনভয়েসিং এবং ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থপাচার হচ্ছে। এটা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। এর জন্য দায়ী ব্যাংক। ব্যাংকগুলোকে যে টাকা বলে সেই টাকা তারা পাঠিয়ে দেয়। আর পণ্য আনার পরে কাস্টমসের কিছু্ করার থাকে না। ধরা পড়ার পর সেটা নিয়ে আলোচনা হলেই তখন কাস্টমসের ওপর দোষ আসে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু দায়িত্ব আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি এগুলো মনিটরিং না করে তাহলে এভাবেই অর্থ পাচার হতে থাকবে। আর অর্থনীতিতে পিছিয়ে যাবে দেশ। তাই এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।’

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘শুল্ক গোয়েন্দার এমন একটি প্রতিবেদন আমি পেয়েছি। অর্থ পাচারের বিষয়টি আমরা অনুসন্ধান করব। যারা বিদেশে অর্থ পাচার করে তারা দেশের শত্রু। আমরা এসব অপরাধীদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনব। তবে এক্ষেত্রে কিছুটা সময় লাগলেও অপরাধীরা সাজা পাবেই।’

গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে দেশের বাজারের পেঁয়াজের নতুন ইতিহাস তৈরি হয়। ২০১৯ সালে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছিল চাহিদার তুলনায় কম। এর আগেও ঘাটতি পূরণে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা হতো। কিন্তু নিজেদের বাজার রক্ষায় সেপ্টেম্বরে ভারত সরকার হঠাৎ করেই পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের ঘোষণা দেয়। এতে বাংলাদেশের বাজারে যেন আগুন লাগে। রাতারাতি পেঁয়াজের দাম জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে এই পণ্যটির কেজিপ্রতি দাম দাঁড়ায় ২৫০ টাকায়। এই সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধানে মিয়ানমার, চীন, তুরস্ক ও পাকিস্তান থেকে পেঁয়াজ আমদানির নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়।

৩০০ কোটি টাকা আমদানি এনবিআর পেঁয়াজ মিয়ানমার লোপাট

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

দু’দিনে ভারতে ৯৯ টন ইলিশ রফতানি
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৭:৩৪

সম্পর্কিত খবর