Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সমন্বিত পরিকল্পনার প্রতিফলন নেই পররাষ্ট্রনীতিতে


২ জানুয়ারি ২০২০ ১৬:১৮

ঢাকা: পরিকল্পনা ও দক্ষতার অভাবে পররাষ্ট্রনীতিতে সরাসরি বা সমন্বিত কোনো পরিকল্পনার প্রতিফলন পাওয়া যাচ্ছে না। সদ্য সমাপ্ত বছরের পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিশ্বের পূর্ব বা পশ্চিম— কোনো প্রান্তেই সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুব বেশি অগ্রগতি দেখাতে পারেননি ঢাকার কূটনীতিকরা। গেল বছরে পররাষ্ট্র নীতিতে অর্থনৈতিক কূটনীতিতে জোর দেয় ঢাকা, কিন্তু সেখানেও তেমন সাফল্য নেই। তবে বছরের শেষ দিকে গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমারকে বিচারের মুখোমুখি করার মাধ্যমে যেমন সাফল্য দেখিয়েছে ঢাকা, ঠিক তেমনি একই ইস্যুতে বড় ধরনের ব্যর্থতাও রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

গেল বছরের ঢাকার কূটনীতিকদের মূল্যায়ন করতে গিয়ে এমনটাই বলছেন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা।

সদ্য সমাপ্ত বছরের পর্যালোচনায় দেখা যায়, গণহত্যার অভিযোগে গাম্বিয়ার মাধ্যমে মিয়ানমারকে বিচারের মুখোমুখি করতে পারা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বড় একটি সাফল্য। কিন্তু সেই সাফল্যকে ম্লান করে দিয়েছে গত ১৩ ডিসেম্বরের একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি, যার শিরোনাম ‘বাংলাদেশ অ্যাটেন্ডস আইসিজে হেয়ারিং অন জেনসাইড অ্যালিগেশনস এগেইনসট মিয়ানমার ব্রোট বাই দ্য গাম্বিয়া’।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যে বিচার প্রক্রিয়া চলছে, তাতে বাংলাদেশ কোনো পক্ষ নয়। কূটনৈতিক কৌশলের জন্য বাংলাদেশ যে হেগের আদালতে অনুষ্ঠিত বিচার প্রক্রিয়া দেখতে একটি প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছে, সে বিষয়টি খুব ঘটা করে পাবলিক না করার সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু ১৩ ডিসেম্বরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিটি কূটনৈতিক কৌশলে বাধা তৈরি করেছে। বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল আইসিজে’র মামলা সম্পর্কে কাদের সঙ্গে দেখা করেছে, তাদের কী বলেছে— তার সবই উল্লেখ করা আছে ওই বিজ্ঞপ্তিতে, যা ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে চাপে ফেলতে পারে। ওই বিজ্ঞপ্তির এক-তৃতীয়াংশ জুড়ে হেগে যাওয়া বাংলাদশ প্রতিনিধি দলের সদস্যদের নাম ও পদবী ছিল, যার কোনো প্রয়োজনই ছিল না।

শুধু তাই নয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রোহিঙ্গা সেলের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারাও ১৩ ডিসেম্বরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি সম্পর্কে কিছু জানেন না। অথচ স্পর্শকাতর একটি বিষয়ে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে বার্তা প্রকাশ করেছে। এছাড়া রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীন ও রাশিয়া তো বটেই, বন্ধুরাষ্ট্র ভারতকেও এখনো নিজেদের পক্ষে টানতে পারেনি বাংলাদেশ।

বিজ্ঞাপন

এদিকে, ঢাকা-নয়াদিল্লি দুই পক্ষই চলমান সম্পর্ককে সোনালি অধ্যায় বলে অভিহিত করছে। কিন্তু ঢাকার কাছ থেকে নয়াদিল্লি চাহিদা অনুযায়ী সব সুবিধা আদায় করতে পারলেও ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশ তিস্তা বা সীমান্তে হত্যার মতো বিষয়েও কাঙ্ক্ষিত সমর্থন পেতে ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক, বাণিজ্য ও বিনিয়োগেও তেমন বড় কোনো পরিবর্তন আসেনি। মধ্যপ্রাচ্যেরে শ্রমবাজারেও আসেনি সুবাতাস। রাশিয়ার কমনওয়েলথ অব ইন্ডিপেন্ডেন্ট ন্যাশনস (সিআইএস) দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ার বিষয়েও কোনো অগ্রগতি হয়নি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাহাব এনাম খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে ২০১৯ সালে খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি। তবে গাম্বিয়ার সহায়তায় আইসিজে’র মাধ্যমে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ একধরনের গ্লোবাল মোমেন্টাম তৈরি করতে পেরেছে। এটি একটি বড় বিষয়। এছাড়া বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে সমন্বিত কোনো পরিকল্পনার প্রতিফলন দেখা যায়নি।’

তিনি আরও বলেন, ‘২০১৯ সালে পররাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুব বেশি অগ্রগতি না হওয়ার ফলে ২০২০ সালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র বড় চ্যালেঞ্জ থাকবে কৌশলগত বা অর্থনীতি ইস্যুতে বাংলাদেশের যে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মূল্যায়ন, তা নিয়ে আরও বিশদভাবে চিন্তা করা। বিশেষ করে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) এবং যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় নিরাপত্তা কৌশল ইন্দো-প্যাসিফিক— এই দুই কৌশলকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে ভাবতে হবে। বাংলাদেশকে কোনো অবস্থাতেই কেবল ক্ষুদ্র চিন্তায় তার সম্পর্কগুলোকে দেখলে হবে না, বৃহৎ পরিসরে দেখতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি অনুযায়ী বৃহৎ পরিসরে দেখাটাই শ্রেয়।’

অধ্যাপক সাহাব এনাম খান বলেন, ‘২০১৬ সালে চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফরে বাংলাদেশ বিআরআই ইস্যুতে চীনের সঙ্গে চুক্তি করে। সেই চুক্তি যদি আমরা মূল্যায়ন করি, তেমন আশানুরূপ সাফল্য দেখা যায় না। এর বড় কারণ, এ বিষয়ে বাংলাদেশের পরিকল্পনার অভাব এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দক্ষতার অভাব। তাই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ও বিআরআই— দুইটি বিষয়েই ফোকাস দেওয়া প্রয়োজন। পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন— এই বিষয়গুলোতে কেবল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নয়, এর সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয় বা বিভাগকেও সমন্বয় করে কাজ করতে হবে।’

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘বৈশ্বিক অবস্থানে আমরা কোথায় ছাড় দেবো, কোথায় শক্ত হব— এগুলোর জন্য অনেক হোমওয়ার্ক প্রয়োজন। কাজ না করলে তো বোঝা যাবে না যে কোথায় ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে, কোথায় সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে। অর্থনৈতিক কূটনীতির মূল কাজ তো এগুলোই। বিশেষ করে দেশের বাইরে আমাদের মিশনগুলোর মূল কাজ অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিষয়েই হওয়ার কথা। কিন্তু এসব বিষয়ে তো কোনো উদ্যোগই দেখা যাচ্ছে না। আরও প্রো-একটিভ হওয়ার দরকার আছে।’

ড. জাহিদ হোসেন আরও বলেন, ‘অর্থনৈতিক সম্ভাবনাগুলোর ফসল ঘরে তোলার ক্ষেত্রে আমাদের মন্ত্রণালয় ও মিশন— উভয়েরই হোম ওয়ার্কের ঘাটতি দেখি। হোমওয়ার্ক দুই দিক থেকেই হতে হবে। বিদেশের মিশনগুলো জানে, ওইসব দেশের চাহিদা কী, অবস্থা কী, কোথায় ইনপুট দিতে হবে। আমাদের মিশনগুলোকেও এমন সম্ভাবনার ক্ষেত্র চিহ্নিত করে মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে হবে। আমার মনে হয়, এসব ক্ষেত্রে আমাদের সক্ষমতার ঘাটতি আছে। যেমন— যুক্তরাষ্ট্রের বাজার থেকে আমরা কিছুই পাই না, কিন্তু ভিয়েতনাম পায়। আবার রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর জিএসপি সুবিধা উঠে গেল। অথচ ওই দুর্ঘটনার পর আমরা অনেক সংস্কার করেছি। অ্যালায়েন্স, যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতা ও ইউরেপিয়ান ক্রেতাদের সঙ্গে মিলেই আমরা সংস্কার করেছি। তাহলে কেন আমরা জিএসপি বহাল করতে পারছি না? তাই আমাদের সক্ষমতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে নজর দিতে হবে। অন্তত আমাদের এটুকু তো বলতে পারা উচিত, আমাদের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আমেরিকানরা রাজি হয়নি। আমরা কি এতটুকু বলতে পারছি?’

বাংলাদেশ বিনিয়োগ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান এবং মেরিডিয়ান ফাইনান্সের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান কাজী এম আমিনুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে অর্থনৈতিক কূটনীতিতে জোর দেওয়া হয়েছে। তবে এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানিক বা অন্যান্য সক্ষমতা উন্নয়নের বিষয়গুলোতেও জোর দেওয়া প্রয়োজন। কেননা অর্থনৈতিক কূটনীতি বিষয়ে ভালো জ্ঞান সমৃদ্ধ জনবল না থাকলে তো তা শতভাগ বাস্তবায়ন করা যাবে না। নেগোশিয়েশনের জন্য লোকবল প্রয়োজন, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিষয়গুলো বোঝে— এমন লোক প্রয়োজন। এসব বিষয় নিয়ে যেসব কর্মকর্তা কাজ করছেন, তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন।’

তিনি আরও বলেন, এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সচিবের সদিচ্ছা দেখেছি। যেহেতু অর্থনৈতিক কূটনীতিতে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে, তাই বিশেষভাবে নিজেদের সক্ষমতা অর্জন করা দরকার, সক্ষমতা তৈরি করা দরকার এবং সক্ষমতাকে প্রয়োগ করা দরকার। যেমন— ভারতে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানো হয়। অর্থনৈতিক বিষয়গুলো মাথায় রেখে যেকোনো দেশের সঙ্গে যেকোনো ইস্যু পাকাপাকিভাবে সামাল দেয় তারা। আমাদের ক্ষেত্রেও বিষয়গুলো সেরকম দক্ষতার সঙ্গে সামাল দেওয়া প্রয়োজন।

কূটনৈতিক সাফল্য পররাষ্ট্রনীতি সমন্বিত পরিকল্পনা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর