Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘গুরুপাপে লঘুদণ্ডে’র পর আরও বেপরোয়া সোহরাওয়ার্দীর উত্তম


২ জানুয়ারি ২০২০ ১৯:৫২

চট্টগ্রাম ব্যুরো: তিন বছর আগে হাসপাতালের সরঞ্জাম কেনায় দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় শাস্তি পেয়েছিলেন রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক উত্তম কুমার বড়ুয়া। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে তার নিয়মিত বেতন বৃদ্ধি একবছরের জন্য স্থগিত করা হয়েছিল। এবার এই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম নগরীতে পাঁচ তলা ভবন-ফ্ল্যাট, ঢাকায় অভিজাত মার্কেটে দোকান কেনাসহ জ্ঞাত আয় বর্হিভূত অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

বিজ্ঞাপন

সংশ্লিষ্টদের মতে, মন্ত্রীর অনুমোদন না নিয়ে এবং সরকারি ক্রয়নীতি লঙ্ঘন করে হাসপাতালের সরঞ্জাম কিনে অর্থ আত্মসাতের মতো গুরুতর অপরাধে উত্তম বড়ুয়ার যে শাস্তি হয়েছিল, তা ‘গুরুপাপে লঘুদণ্ডে’র মতো। গুরুতর অপরাধে সহজ শাস্তি পেয়ে উত্তম কুমার বড়ুয়া অনিয়ম-দুর্নীতিতে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া ৩৫ বছর আগে জালিয়াতির মাধ্যমে মেডিকেলে ভর্তির বিষয়ে উত্তম বড়ুয়ার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগের তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

বিজ্ঞাপন

২০১৯ সালের ১ ডিসেম্বর উত্তম কুমার বড়ুয়াকে তলব করেন দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্ত বিভাগের উপপরিচালক মো. সামছুল আলম। তাকে ৫ ডিসেম্বর হাজির হতে বলা হয়েছিল। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, দুর্নীতিবাজ ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজশে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিভিন্ন মেডিকেল যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং জ্ঞাত আয় বর্হিভূত সম্পদ অর্জন। দুদকের তলবে সাড়া দিয়ে ৮ ডিসেম্বর তিনি হাজির হন এবং তার বক্তব্য গ্রহণ করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা।

জানতে চাইলে দুদক কর্মকর্তা মো. সামছুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘তার (উত্তম কুমার বড়ুয়া) বিরুদ্ধে মোট দুইটি অভিযোগ আমরা পেয়েছি— মেডিকেলের সরঞ্জাম কেনাকাটায় দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জন। কমিশন অভিযোগগুলো অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর আমরা তাকে তলব করেছিলাম। তিনি এসেছিলেন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। অনুসন্ধান পর্যায়ে এর বেশি তথ্য দেওয়া যাবে না।’

সূত্রমতে, উত্তম কুমার বড়ুয়ার বিরুদ্ধে ২০১৬ সালে ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজশে প্রতিযোগিতা ছাড়াই এমআরআই মেশিনসহ যন্ত্রপাতি কেনার অভিযোগ ওঠে। সেসময় হাসপাতালের জন্য এমআরআই মেশিন কেনা হয়। হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক হিসেবে তিনি ছিলেন এ সংক্রান্ত দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্য সচিব। এমআরআই মেশিন কেনায় উত্তম কুমার বড়ুয়ার বিরুদ্ধে সরকারী ক্রয়নীতি-২০০৮-এর সংশ্লিষ্ট বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে তদন্ত শুরু হয়।

ওই বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রুজু হয়। এতে অভিযোগ করা হয়, দরপত্র কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে তার অনিয়ম ও দায়িত্বে অবহেলার কারণে এমআরআই সামগ্রী কেনার দরপত্র কার্যক্রমে কোনো প্রতিযোগিতা হয়নি। এর ফলে প্রতিযোগিতামূলক দামে এমআরআই সামগ্রী কেনা সম্ভব হয়নি। বাজার দর কমিটি ও দাফতরিক প্রাক্কলিত/দরপত্র মূল্য নির্ধারণ কমিটি, তথা ক্রয়কারী কর্তৃপক্ষের ব্যয় সংকোচন করার তাগিদ সরকারি ক্রয়নীতিতে থাকলেও তা অনুসরণ করা হয়নি।

এর ফলে সরকারী কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ১৯৮৫-এর ৩ (বি) ও (ডি) অনুযায়ী ‘অসদাচরণ ও দু‍র্নীতি’র দায়ে উত্তম কুমার বড়ুয়াকে অভিযুক্ত করে বিভাগীয় মামলা করে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। ২০১৬ সালের ২৩ আগস্ট তিনি স্বাস্থ্য সচিবের দফতরে ব্যক্তিগত শুনানিতে হাজির হয়ে এ সংক্রান্ত অভিযোগের জবাব দেন।

ব্যক্তিগত শুনানিতে বক্তব্য গ্রহণ এবং তদন্ত শেষে ২০১৬ সালের ১৯ অক্টোবর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এক আদেশ দেন। এতে বলা হয়, যন্ত্রপাতি ক্রয়ে দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। সরকারি কর্মচারী বিধিমালা ১৯৮৫-এর ৪(২) (বি) বিধি অনুযায়ী তার বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি এক বছরের জন্য স্থগিত করে বিভাগীয় মামলা নিষ্পত্তি করা হলো।

উত্তমের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ, বিভাগীয় মামলা নিষ্পত্তির পর  হাসপাতালের আইসিইউ, এনআইসিইউ, পিআইসিইউ’র জন্য নিম্নমানের মেশিন এবং উচ্চমূল্যে ল্যাসিক ও লেজার মেশিন কেনার মাধ্যমে তিনি আরও শত কোটি টাকা লোপাট করেছেন।

এদিকে, দুদক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ২৯ জুলাই উত্তম কুমার বড়ুয়া চট্টগ্রাম নগরীর নন্দনকাননে ৩৭, বৌদ্ধ মন্দির সড়কে আড়াই শতক জমির ওপর নির্মিত একটি পাঁচতলা ভবন কিনেছেন। নিজের নামে কেনা ৬ হাজার ৮০০ বর্গফুটের এই দালান কেনার দলিলে (দলিল নম্বর ৬৯৬১) মূল্য দেখানো হয়েছে মাত্র দুই কোটি টাকা। প্রকৃতপক্ষে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকায় এই ভবন কিনেছেন বলে দুদক অভিযোগ পেয়েছে। এর বাইরে ঢাকার ধানমন্ডি ও ইন্দিরা রোডে দু’টি ফ্ল্যাট এবং শ্যামলী স্কয়ার শপিং মলে উত্তম বড়ুয়ার দোকান আছে বলে তথ্য পেয়ে অনুসন্ধান করছে দুদক।

জানতে চাইলে উত্তম কুমার বড়ুয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যত অভিযোগ আনা হয়েছে, সব মিথ্যা ও বানোয়াট। সামনে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের কাউন্সিল আছে। আমি সেক্রেটারি ক্যান্ডিডেট। সেজন্য সংগঠনের মধ্যে আমার প্রতিপক্ষরা এসব অভিযোগ পত্র-পত্রিকায় সরবরাহ করছেন।’

দুদকের তলবের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগ দুদককেও দেওয়া হয়েছে। সেজন্য তারা ডেকেছিল। আমি গিয়ে আমার বক্তব্য উপস্থাপন করেছি।’

সরঞ্জাম কেনায় অনিয়মে শাস্তি পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা ঠিক যে আমাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। আমার একবছরের বেতন বৃদ্ধি স্থগিত করা হয়েছিল। কিন্তু আমি দুর্নীতি করিনি। সরকারি ক্রয়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রক্রিয়া থাকে। সেখানে প্রক্রিয়াগত ভুল হয়েছিল।’

১৯৯৭ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকার শেরেবাংলা নগরের শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি প্রকল্পের আওতায় অস্থায়ী ভিত্তিতে মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগ দেন উত্তম কুমার বড়ুয়া। এরপর থেকে তিনি বিভিন্ন পদে ওই হাসপাতালে চাকরি করে এখন পরিচালক পদে দায়িত্বরত।

এদিকে, চট্টগ্রামের রাউজানের বাসিন্দা উত্তম কুমার বড়ুয়ার বিরুদ্ধে জালিয়াতির মাধ্যমে ১৯৮৪-৮৫ শিক্ষাবর্ষে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ভর্তির অভিযোগ তদন্তে নেমেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

অভিযোগ আছে, উত্তম কুমার বড়ুয়া ১৯৮৪-৮৫ শিক্ষাবর্ষে মেডিকেল কলেজ ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণই করেননি। কিন্তু ওই শিক্ষাবর্ষে মেডিকেল কলেজগুলোতে যখন অটো মাইগ্রেশন প্রক্রিয়া শুরু হয়, তিনি তখন সিলেট মেডিকেল কলেজে গিয়ে সেসময় কেরানী পদে কর্মরত জনৈক মনির আহমের মাধ্যমে নিজের নাম অটো মাইগ্রেশনপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের তালিকায় টাইপ করিয়ে নেন। এর ফলে সিলেট মেডিকেল কলেজের মাইগ্রেশনপ্রাপ্ত ছাত্র হিসেবে তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। এ অভিযোগ পেয়ে পিবিআই টিম গত বছরের শেষদিকে সিলেট মেডিকেলে গিয়ে বিষয়টি তদন্ত করে। পরে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে গিয়েও নথিপত্র যাচাই করে। তবে তদন্ত এখনো শেষ হয়নি।

জানতে চাইলে পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘পুলিশ সদর দফতর থেকে একজন চিকিৎসকের (উত্তম কুমার বড়ুয়া) ভর্তি জালিয়াতির বিষয় তদন্তের নির্দেশনা পেয়েছি। আমরা কাজ শুরু করেছি।’

অনিয়ম অবৈধ সম্পদ অর্জন উত্তম কুমার বড়ুয়া ক্রয়নীতি ভঙ্গ দুর্নীতি ভর্তিতে জালিয়াতি মেডিকেল সরঞ্জাম কেনায় দুর্নীতি শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর