জন্ডিস সারাতে এখনো চলে ঝাড়ফুঁক!
৩ জানুয়ারি ২০২০ ০৮:৫৭
ঢাকা: মেহেরপুর জেলার গাড়াডোব গ্রাম। গ্রাম্য কবিরাজ জমিলা আক্তারের বাসায় চলছে এক জন্ডিস রোগীর চিকিৎসা। রোগীর নাম রাশেদ ইসলাম (ছদ্মনাম)। ঢাকার চিকিৎসক পরামর্শ দিয়েছেন ওষুধের পাশাপাশি গ্রামের বাড়িতে রাশেদকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে। গত দুইদিন হলো রাশেদ গ্রামের বাড়িতে। কিন্তু পরিবার সদস্যদের তোড়জোড় তাকে নিয়ে, কবিরাজের কাছে না গেলে কিছুতেই জন্ডিস ভালো হওয়ার নয়।
ঢাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এই শিক্ষার্থী তার পরিবারের সদস্যদের বোঝাতে চেষ্টা করেছেন, কবিরাজের কাছে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার বিষয়টি নিছক গ্রাম্য কুসংস্কার ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু পরিবার সদস্যরা কোনো কথা শুনতে নারাজ। শেষশেষ কবিরাজ জমিলা আক্তারের বাড়িতে তাকে যেতে হয়েছে ঝাড়ফুঁকের জন্য।
কবিরাজ বাড়িতে গিয়ে রাশেদ জানতে পারেন বেশ কয়েকটি ধাপে তাকে জন্ডিসের চিকিৎসা নিতে হবে। পানি দিতে হাত ধুতে হবে, মালা পরতে হবে শরীরে, মাঝেমধ্যে ঝাড়ফুঁকও করতে হবে।
এই একবিংশ শতাব্দীতে যখন দেশের প্রতিটি উপজেলায় রয়েছে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন পর্যায়েও যেখানে কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে, এমন সময়েও দেশের অনেক এলাকাতেই এখনো জন্ডিসের চিকিৎসার জন্য কবিরাজকেই ভরসা মনে করেন গ্রামবাসী। যুগ যুগ ধরে তারা জেনে এসেছেন, জন্ডিস হলে ওঝা-কবিরাজের কাছে গেলে রোগ ভালো হয়। গাছ-গাছড়ার ওষুধ খাওয়ার পাশাপাশি কবিরাজের দেওয়া কিছু নিয়ম মেনে চললে কয়েকদিনের মধ্যেই জন্ডিস রোগী ভালো হয়ে যায়। তাদের সে ধ্যান-ধারণায় পরিবর্তন আসেনি আজও। যদিও চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে ভিন্ন কথা। তাদের উপদেশ— চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ খেলে হিতে বিপরীত হতে পারে।
মেহেরপুর জেলার বেশ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে জানা গেছে, এসব গ্রামের বাসিন্দারা রোগব্যাধি হলেই চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে কবিরাজের কাছে যান। কাউকে বশ করা, কারও ক্ষতি করা, বিভিন্ন ধরনের অভিশাপ থেকে মুক্তি, ভূত-জ্বীন তাড়ানোসহ জন্ডিস রোগীদের চিকিৎসা দেন গ্রাম্য কবিরাজরা।
এ সব কবিরাজের পুঁথিগত কোনো বিদ্যা নেই। নেই প্রাতিষ্ঠানিক কোনো যোগ্যতাও। তারপরও বাধাহীনভাবে কবিরাজরা বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা চালিয়ে আসছেন। বিশ্বাসে মেলায় বস্তু- এই নীতিতে কিছু রোগীর রোগ ভালো হলেও তাদের গুনতে হয় বড় ধরনের মাশুল।
সরেজমিনে মেহেরপুর জেলার গাড়াডোব গ্রামে কবিরাজ জমিলা আক্তারের বাসায় যান এই প্রতিবেদক। সেখানে তিনি প্রত্যক্ষ করেন জন্ডিস রোগীর চিকিৎসা দেওয়ার নানা বিষয়। জন্ডিসের চিকিৎসা দেওয়ার কয়েকটি পদ্ধতি সারাবাংলার পাঠকদের কাছে তুলে ধরা হলো।
পানি দিয়ে হাত ধুয়ে দেওয়া: প্রথমে কবিরাজ/ওঝা তাদের রোগীদের আকর্ষণ করার জন্য সাদা পানি দিয়ে হাত ধুয়ে দেন। হাত ধোয়ার সময় পানির রঙ হলুদ আকার ধারণ করে। এতে রোগীর লোকজন বুঝতে পারেন পানি দিয়ে জন্ডিস বের হচ্ছে। এভাবে চিকিৎসা চলতে থাকে টানা তিন দিন।
তাবিজ ও মালা: ওঝারা তাদের তাদের মন্ত্রবলে জন্ডিস রোগীদের একটি গাছের মালা পরিয়ে দেন। এরপর সেটা থাকবে টানা আড়াই দিন। মাথায় পরিয়ে দেওয়া হলে আস্তে আস্তের সেটা বড় হয়ে পায়ের নিচে চলে আসে। আর মন্ত্র বলে তো তাবিজ থাকছে।
গাছড়া ওষুধ-ঝাড়ফুঁক: কবিরাজের একেক জনের চিকিৎসা দেওয়ার ধরন একেক রকম। তারা জন্ডিস রোগীদের বিভিন্ন সময় ঝাড়ফুঁক দেন। বিভিন্ন গাছের বাকল ও রস খেতেও উপদেশ দেন।
শরীরে ঠাণ্ডা লাগানো: জন্ডিস চিকিৎসা হিসেবে আপনারা শরীরে ঠাণ্ডা অবশ্যই লাগাতে হবে। প্রয়োজনে আপনাকে শীতের সকালে উঠে হালকা কাপড় পরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। আর সবকিছু্ ঠাণ্ডা খেতে হবে। গরম কোনো খাবার খেলে জন্ডিস বেড়ে যেতে পারে।
এদিকে সেইসব কবিরাজরা বেশ কিছু খাবার না খাওয়ার জন্য পরমর্শ দেন সেগুলো হলো— হলুদ স্পর্শ করা যাবে না; মরিচ, পেঁয়াজ, তেলের তরকারি খাওয়া যাবে না; আমিষ জাতীয় খাবার থেকে দূরে থাকতে হবে। প্রায় ৪০ পদের খাবার থেকে দূরে থাকতে রোগীকে পরামর্শ দেন তারা।
জন্ডিস রোগ বিষয়ে বিশেজ্ঞরা জানান, জন্ডিস কোনো মারাত্মক রোগ নয়। খাবার ও পানি খাওয়ার অনিয়মের কারণে এ রোগ দেখা যায়। নিয়মিত খাবার খাওয়া ও পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিলে ১০ থেকে ১৫ দিনে আবার রোগী স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাবে।
সারাবাংলার সঙ্গে কথা হয় মেহেরপুরের জন্ডিস রোগী সোহেল রানার সঙ্গে। তিনি জানান, দর্শনায় এক কবিরাজের গিয়ে আমার জন্ডিস ভালো হয়েছে। তাছাড়া আমাকে অন্য এক কবিরাজ গলায় কাঁচের তৈরি বিশেষ মালা পরতে দেন। এছাড়াও গাছের রস খেতে হয়েছে কয়েক মাস। এভাবে দুই মাস চিকিৎসা নেওয়ার পর জন্ডিস ভালো হয়েছে।
অন্যকে বাবু নামের আরেক জন্ডিস রোগী সারাবাংলাকে জানান তার ভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা। তিনি বলেন, ‘অনেকের কথা মতো কবিরাজকে দেখিয়ে কাজ হয়নি। উল্টো আমার জন্ডিস বেড়ে যায়। পরে কুষ্টিয়ায় এক ডাক্তারের কাছে গিয়ে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘কবিরাজদের মাধ্যমে এ রোগের সুচিকিৎসা সম্ভব হয় না। কারণ এটি বাড়তে থাকলে রোগী মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে যায়। আমার দেখা অনেক মানুষ আছে, যারা ভুল চিকিৎসায় মারা গেছেন।’
গাড়াডোব গ্রামের কবিরাজ জমিনা আক্তারের কাছে জানতে চাওয়া হয় তার চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে জন্ডিস রোগী এলে গাছ-গাছড়ার মাধ্যমে চিকিৎসা করি। মানুষ বেঈমানি করতে পারে, কিন্তু গাছ বেঈমানি করে না।’
তবে চিকিৎসকরা বলছেন ভিন্ন কথা। তারা বলছেন, জন্ডিসের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো ওষুধ নেই। বিশ্রাম ও বেশি বেশি তরল খাবারে জন্ডিস সেরে যায়। কবিরাজরা চিকিৎসার নামে খাবারে যে বিধিনিষেধ আরোপ করেন, তারও কোনো ভিত্তি নেই। জন্ডিস হলে গুরুপাক খাবারের বদলে সহজপাচ্য খাবার খাওয়া শ্রেয়। কিন্তু পুষ্টিকর খাবার বা আমিষ খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিলে উল্টো তা শরীরকে দুর্বল করে দিতে পারে। নানা ধরনের রস খেতে দেওয়া হলে সেগুলো তৈরিতে বিশুদ্ধ পানির ব্যবহার নিশ্চিত না করতে পারলে তা উল্টো শরীরকে নাজুক করে দিতে পারে। আবার রোগীর শরীরে ঠান্ডা লাগানোর যে কথা বলা হয়, সেটি উল্টো রোগীকে নিউমোনিয়ার মতো রোগেও আক্রান্ত করে দিতে পারে।
এ বিষয়ে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মামুন-উর রশিদ (মামুন) সারাবাংলাকে বলেন, ‘জন্ডিসের কোনো ওষুধ নেই। আমার জানামতে এখন পর্যন্ত জন্ডিসের জন্য নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ আবিষ্কার হয়নি। জন্ডিস হলে রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে যায়। ওষুধ খাওয়ার পাশাপাশি নিয়মিত বিশ্রাম নিলে জন্ডিস রোগ ভালো হয়।’
তিনি বলেন, ‘আমরা অনেকেই দেখি জন্ডিস সারাতে তারা কবিরাজের শরণাপন্ন হয়। ফলে হিতে বিপরীত কিছু ঘটে যায়। তাই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কিছু না খাওয়া ভালো।’