সমন্বয়হীনতায় আলোর মুখ দেখেনি সাঈদ খোকনের প্রতিশ্রুতি
৩ জানুয়ারি ২০২০ ১৫:২৮
ঢাকা: রাজধানী ঢাকার প্রধান পাঁচটি সমস্যা সমাধানে ইশতেহার ঘোষণা দিয়ে ২০১৫ সালের ১৩ এপ্রিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন সাঈদ খোকন। এ সময় আরও ১০টিরও বেশি প্রতিশ্রুতি ছিল তার। যানজট, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি সংকট, বুড়িগঙ্গার নাব্য ফিরিয়ে আনা এবং বায়ূ দূষণ রোধ ও পরিচ্ছন্ন-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মতো প্রধান সমস্যাগুলো সমাধানের প্রতিশ্রুতিতে নির্বাচিত হয়ে সে বছর ৬ মে মেয়র হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন সাঈদ খোকন।
এরই মধ্যে কেটে গেছে চার বছরের বেশি সময়। তবুও বাস্তবায়ন হয়নি মেয়র খোকনের প্রতিশ্রুতিগুলো। একদিকে যানজটে দুর্ভোগ বেড়েছে, অন্যদিকে বায়ু দূষণে শীর্ষ তালিকায় নাম উঠেছে ঢাকার। ফেরেনি বুড়িগঙ্গার সৌন্দর্যও। এর মধ্যে ডেঙ্গুর কবলে পড়ে নাকাল হতে হয় নগরবাসীকে ডেঙ্গু ছাড়িয়ে যায় আগের সব রেকর্ড। অথচ এসবগুলোই সমাধানের প্রধান প্রতিশ্রুতি ছিল সাঈদ খোকনের। কিন্তু কোনো প্রতিশ্রুতিই আলোর মুখ দেখেনি তার।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, সাঈদ খোকন যেসব সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেগুলো সমাধানের দায়িত্ব একাধিক সংস্থার। সিটি করপোরেশন এককভাবে এসব সমস্যা সমাধান করতে পারে না। তবে সব সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের কাজটি করতে পারলে সমস্যাগুলোর সমাধান নিয়ে আসা সম্ভব ছিল। কিন্তু সাঈদ খোকন এককভাবেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তার এমন উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রতিশ্রুতিতে জনগণও আশান্বিত হয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত সাঈদ খোকন সমন্বয় আনতে পারেননি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে, জনগণের আশাও পূরণ হয়নি।
তবে ডিএসসিসির মেয়র সাঈদ খোকনের দাবি, চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না তার। কর্তব্যও কোনো অবহেলা করেননি তিনি। প্রতিশ্রুতির শতভাগ বাস্তবায়ন করতে না পারলেও ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পেরেছেন। তবে প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়নে সমন্বয়হীনতা প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করেছিল বলে মনে করেন তিনি।
সাঈদ খোকন সারাবাংলাকে বলেন, ‘সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে। যার ফলে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছি। অনেকাংশে সফল হয়েছি। আবার কিছু ক্ষেত্রে পুরোপুরি সফল হতে পারিনি। তাই বলে একেবারেই যে ব্যর্থ হয়েছি, তা কিন্তু নয়।’
তিনি আরও বলেন, প্রচলিত স্ট্রিট লাইটের পরিবর্তে এলইডি লাইট স্থাপন করতে পেরেছি। বিলবোর্ডে পরিবর্তন এনেছি। সড়কে সড়কে ডিজিটাল বিলবোর্ড স্থাপন করেছি। সড়ক ও ফুটপাতগুলোকে চলাচলের উপযোগী করেছি। প্রতিবন্ধীদের জন্যও সুন্দর নগরী গড়তে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু এত সব পরিবর্তনের পরেও যারা বলে কিছুই করিনি, মূলত এসব বলে তারা রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চায়, আর কিছু নয়।
যেসব প্রতিশ্রুতি আলোর মুখ দেখেনি
যানজট: নির্বাচনি ইশতেহারে মেয়র খোকনের অগ্রাধিকার প্রতিশ্রুতির মধ্যে যানজট নিরসন ছিল অন্যতম। যানজট নিরসনে দায়িত্ব নেওয়ার অন্তত তিন বছর পর্যন্ত এ বিষয়ে তেমন কোনো উদ্যোগই নিতে দেখে যায়নি সাঈদ খোকনকে। শুধু তাই নয়, যে সিটি করপোরেশন রিকশার অনুমোদন দেয়, সেই করপোরেশনের মেয়র হিসেবে ডিএসসিসি এলাকায় কতসংখ্যক রিকশা চলাচল করে তার সঠিক পরিসংখ্যান আজ পর্যন্ত করতে পারেননি।
২০১৮ সালের আগস্টে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের তোপে পড়ে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে রাষ্ট্রপতির আদেশে বাস রুট র্যাশনালাইজেশন কমিটি গঠন করা হয়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল যানজট নিরসন এবং গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনা। কিন্তু এ কমিটির গত দেড় বছরেও কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারেনি। যার মূল দায়িত্ব ছিল মেয়র সাঈদ খোকনের।
দূষণমুক্ত নগর গঠন: সমন্বয়হীন খোঁড়াখুড়ির ফলে মহানগরীতে বেড়েছে বায়ু দূষণের হার। গত সাড়ে চার বছরে পরিবেশ দূষণ রোধে ডিএসসিসিকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপই নিতে দেখা যায়নি। অথচ এ বায়ু ও পরিবেশ দূষণ রোধ করে স্বস্তির ঢাকা গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মেয়র খোকন।
বুড়িগঙ্গার নাব্য ফিরিয়ে আনা ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি: মেয়র খোকনের নির্বাচনি ইশতেহারে আরও একটি অগ্রাধিকার প্রতিশ্রুতি ছিল বুড়িগঙ্গার আদিরূপ অর্থাৎ নাব্য সংকট নিরসন করে এর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা। কিন্তু এতেও সফল হতে পারেননি তিনি। দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০১৬ সালের শেষের দিকে বুড়িগঙ্গার তীরে বেশকিছু অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করলেও শেষ পর্যন্ত বিআইডব্লিউটিএ এবং জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সমন্বয়হীনতায় সে উদ্যোগ আর আলোর মুখ দেখেনি।
পরিচ্ছন্ন শহর গড়া: পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শহর গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাস্তবায়নের পথে হাঁটলেও সঠিক নজরদারির অভাবে তাও বাস্তবায়ন হয়নি। দায়িত্ব নেওয়ার ১ বছর পর ডিএসসিসি এলাকায় পরিচ্ছন্নতার লক্ষ্যে মহানগরীতে বসানো হয় সাড়ে ৫ হাজার মিনি ডাস্টবিন। কিন্তু বছর ঘুরতেই অস্তিত্বের সংকট দেখা দিয়েছিল সেসব মিনি ডাস্টবিনের। অর্থাৎ নজরদারির অভাবে এসব ডাস্টবিনের অর্ধেক হয়েছে চুরি। আর বাকি অর্ধেক হয়েছে নষ্ট। এরপর আর গুরুত্ব দেওয়া হয়নি এ প্রকল্পে।
গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির সংকট: মহানগরীর আরও একটি অন্যতম সমস্যা গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় সেবা। কিন্তু এ তিনটির একটিও সিটি করপোরেশন এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এগুলোর জন্য নির্ভর করতে হয় একাধিক সেবা সংস্থার ওপর। আর এমন সেবার সমস্যা নিরসন ছিল মেয়র খোকনের আরও একটি অগ্রাধিকার প্রতিশ্রুতি। এসব সমস্যার কিছু সমাধান মিললেও স্থায়ী সমাধান এখনও মেলেনি। সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে প্রায় ১৫-২০ দিন পানির সংকটে নাকাল ছিলেন পুরান ঢাকা এলাকার বাসিন্দারা। এমন সমস্যা সমাধানের মূল প্রতিবন্ধকতা সমন্বয়হীনতা, যা এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত করতে পারেনি ডিএসসিসি।
এসব প্রতিশ্রুতি ছাড়াও মেয়র সাঈদ খোকন আরও প্রায় ১০টি প্রতিশ্রুতি ছিল। যার মধ্যে ডিজিটাল মহানগরী, সবার জন্য শিক্ষার সুযোগ, বস্তি উন্নয়ন ও দলিত হরিজন সম্প্রদায়ের মানবিক মর্যাদা ও সুযোগের সমতা, আবাসন সমস্যা সমাধানে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ, ঐতিহ্য সংরক্ষণ, অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ, ক্রীড়া ও চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা, কামরাঙ্গীরচরে নবগঠিত তিনটি ওয়ার্ডের উন্নয়ন ও নগর প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু এসব প্রতিশ্রুতিও থমকে আছে অনেকাংশে।
এরই মধ্যে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা আবাসন সুবিধা পেলেও বস্তিবাসীর জীবনমানে ঘটেনি কোনো উন্নয়ন। আবার অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে মেয়র খোকন পুরান ঢাকায় অগ্নিনির্বাপনে কার্যকর উদ্যোগ নেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিলেও গত ফেব্রুয়ারিতে চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ৭১ জনের প্রাণহানির পর পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল ও দাহ্যপদার্থ অপসারণ করার অভিযানও সফল হয়নি। এমনকি ক্রীড়া ও চিত্ত বিনোদনের উদ্দেশ্যে ‘জল সবুজে ঢাকা’ নামে ১৯টি পার্ক ও ১২টি খেলার মাঠ সংস্কার প্রকল্প হাতে নিলেও দু’বছর পার হলেও শেষ হয়নি কাজ। মাত্র তিনটি মাঠ আর পার্কের কাজ শেষ হয়েছে। বাকিগুলো কবে শেষ হবে, তাও অনিশ্চিত।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘মেয়র সাঈদ খোকন যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সেসব প্রতিশ্রতি মূলত একাধিক প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু তিনি উচ্চাকাঙ্ক্ষিত হয়ে এককভাবে এসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। যে কারণে এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সেবা সংস্থার সমন্বয় প্রয়োজন থাকলেও তিনি সেগুলোতে সঠিকভাবে নেতৃত্ব দিতে পারেননি। তাই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছেন।’
আরেক পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবীব সারাবাংলাকে বলেন, “মেয়র খোকন যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সেগুলো যে বাস্তবায়ন সম্ভব, তা মেয়র আনিসুল হক দেখিয়ে গেছেন। কিন্তু মেয়র সাঈদ খোকনের এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন ছিল, ‘আমি পারব না’ এমন শব্দ বাদ দিয়ে এবং প্রভাবশালীদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এগিয়ে যাওয়া। তিনি সেটি পারেননি। তাই আজ ব্যর্থ হিসেবে কিংবা তার চেয়ে আরও দক্ষ লোক খুঁজেছে তার নিজেরই দল। কাজেই ভবিষ্যতে যে বা যারা এমন দায়িত্ব নেবেন, তাদের উচিত হবে এমন ব্যর্থতাগুলো থেকে শিক্ষা নেওয়া এবং জনগণকে সম্পৃক্ত করে কাজ এগিয়ে নেওয়া।”
ডিএসসিসি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি মেয়র সাঈদ খোকন