Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আবারও বাড়ছে পেঁয়াজের দাম, ভোজ্যতেলও লাগামহীন


৪ জানুয়ারি ২০২০ ১৮:৪৯

চট্টগ্রাম ব্যুরো: দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজ বাজারে আসার পর সপ্তাহ দুয়েক স্থিতিশীল থাকলেও পাইকারি ও খুচরা বাজারে আবার বাড়তে শুরু করেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম। এছাড়া ভোজ্যতেলের দামও লাগামহীন হয়ে উঠছে। বছরের ‍শুরুতেই এই দুই পণ্যের বাড়তি দামে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে।

পেঁয়াজের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের যুক্তি হচ্ছে, বিরূপ আবহাওয়ার কারণে গত এক সপ্তাহে বাজারে পাবনা-ফরিদপুর থেকে পেঁয়াজ আসেনি। এছাড়া মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আমদানি করে যাওয়ায় সংকট তৈরি হয়েছে। আর ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রে যুক্তি হলো, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশের শীর্ষস্থানীয় পরিশোধন কারখানাগুলো ভোজ্যতেল সরবরাহ প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। এর ফলে পাইকারি ও খুচরা বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ছে।

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রামের বৃহত্তম পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে সপ্তাহের প্রথম দিন শনিবার (৪ জানুয়ারি) পেঁয়াজ ও ভোজ্যতেলের ঊর্ধবগতির এই চিত্র পাওয়া গেছে।

হঠাৎ পেঁয়াজের দাম বাড়ছে লাফিয়ে

শনিবার খাতুনগঞ্জে পাইকারি বাজারে চীনের সাদা পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে কেজি প্রতি ৬০ টাকায়, মিশরের পেঁয়াজ ৭০-৮০ টাকা, পাকিস্তানের পেঁয়াজ ১০০ থেকে ১০৫ টাকায় এবং মায়ানমারের পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১৫০ টাকায়। দেশি পেঁয়াজ সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে কেজিপ্রতি ১৬০ থেকে ১৭৫ টাকায়।

খাতুনগঞ্জের মেসার্স মেহের ট্রেডার্সের স্বত্তাধিকারী মো. আলী তালুকদার সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, গত বৃহস্পতিবার চীনের পেঁয়াজ ৪৫ টাকায় বিক্রি করেছেন। অন্যান্য পেঁয়াজও ১৫-২০ টাকা কম দামে বিক্রি করেছেন। মিয়ানমারের পেঁয়াজের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ৩০ টাকা।

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারের পেঁয়াজ বাজারে তেমন নেই। কারণ সেখানে এখন নতুন পেঁয়াজ উঠছে। সেই পেঁয়াজ রফতানির উপযোগী হতে মাসখানেক সময় লাগবে। এজন্য সব পেঁয়াজের দামই একটু বেড়েছে।’

খাতুনগঞ্জের হামিদউল্লাহ মার্কেটের পেঁয়াজের আড়তদার মেসার্স বাচা মিয়া ট্রেডার্সের মালিক মোহাম্মদ ইদ্রিস সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশি পেঁয়াজ নিয়ে বড় সমস্যা হয়েছে। পাবনা-ফরিদপুরে বৃষ্টি হয়েছে। সেজন্য কৃষক পেঁয়াজ তুলতে পারেননি। বাজারে দেশি পেঁয়াজ নেই। আড়তে বৃহস্পতিবার দেশি পেঁয়াজ মণপ্রতি বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ৮০০ টাকায়। একদিনের ব্যবধানে গতকাল (শুক্রবার) বিক্রি হয়েছে ৭ হাজার টাকা। প্রতিকেজি বিক্রি হয়েছে শুক্রবার ১৭৫ টাকা। আজ (শনিবার) বিক্রি হচ্ছে ১২৫ টাকা। দেশি পেঁয়াজের দাম ১৬০-১৭০ টাকা হয়ে গেছে।’

এই ব্যবসায়ী জানান, বাজারে এখন মায়ানমারের ও দেশীয় পেঁয়াজের চাহিদা বেশি। এই দুটোর সরবরাহে সংকট তৈরি হওয়ায় বাজারে প্রভাব পড়েছে।

এদিকে খুচরা বাজারে একদিনের ব্যবধানে সব ধরনের পেঁয়াজের দাম কমপক্ষে ২৫ থেকে ৩০ টাকা বেড়েছে। নগরীর মোমিন রোডে মেসার্স হক স্টোরে শনিবার পাকিস্তানের ছোট পেঁয়াজ প্রতিকেজি ১২০ টাকা, বড় পেঁয়াজ ৮৫ টাকা এবং তুরস্কের বড় পেঁয়াজ প্রতি কেজি ৯৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

একই এলাকায় মেসার্স শরীফ স্টোরে পাকিস্তানের ছোট-বড় পেঁয়াজ যথাক্রমে ১৪০ টাকা ও ৯০ টাকা এবং মিয়ানমারের পেঁয়াজ ১৩০ টাকা ও তুরস্কের পেঁয়াজ ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

হক স্টোরের মালিক কুতুব উদ্দীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত সপ্তাহের চেয়ে এ সপ্তাহের শুরুতে সব পেঁয়াজের দাম ২৫ টাকা থেকে ৩০ টাকা বেড়েছে। দাম আগামীকাল (রোববার) থেকে আরও বাড়বে। পাইকারিতে মিয়ানমারের পেঁয়াজ ১৫০ টাকা হয়েছে শুনেছি। দেশীয় পেঁয়াজের দাম বেশি বেড়েছে।’

দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা আছে প্রায় ২৪ লাখ মেট্রিকটন অর্থাৎ মাসে ২ লাখ টন ও দিনে প্রায় ৭ হাজার মেট্রিকটন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসেবে, ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে দেশে উৎপাদিত ও আমদানি করা পেঁয়াজ মিলিয়ে প্রতিদিন বাজারে সরবরাহ ছিল ৭ হাজার ৮৯০ মেট্রিকটন। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার টন আমদানি করা পেঁয়াজ। কিন্তু গত ২৯ সেপ্টেম্বর ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দিলে দেশের বাজারে চরম ঘাটতি দেখা দেয়।

বাংলাদেশে আমদানি করা পেঁয়াজের সিংহভাগই আসে ভারত থেকে বিভিন্ন স্থলসীমান্ত দিয়ে। এর বাইরে টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে আসে মায়ানমারের পেঁয়াজ, তবে পরিমাণে খুবই কম। এর বাইরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বিভিন্ন দেশ থেকে জাহাজের মাধ্যমে আসে পেঁয়াজ, যা খুবই নগণ্য পরিমাণে বলে জানিয়েছেন আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে কৃষিজাত পণ্য আমদানির জন্য অনুমতি নিতে হয় বন্দরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্র থেকে।

উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্র, টেকনাফ স্থলবন্দরের কর্মকর্তা এবং আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২৯ সেপ্টেম্বর ভারত রফতানি বন্ধের পর থেকে গত ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে ৬৮ হাজার মেট্রিকটন। এর মধ্যে টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে প্রায় ৪৩ হাজার টন, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ১২ হাজার টন পেঁয়াজ এসেছে। বাকি ১৩ হাজার টন পেঁয়াজের মধ্যে কিছু বিমানে এবং কিছু ভারত থেকে পুরনো এলসির পণ্য এসেছে।

এর মধ্যে ডিসেম্বরে দেশীয় পেঁয়াজ উঠতে শুরু করলে আমদানির পরিমাণ কমে যায়। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েও আমদানি কমেছে, টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়েও কমেছে।

সামুদ্রিক বন্দর উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক মো. আসাদুজ্জামান বুলবুল সারাবাংলাকে বলেন, ‘নতুন করে কেউ তেমন আর পেঁয়াজের আমদানিপত্র খুলছে না। যে পরিমাণ আমদানিপত্র খোলা হয়েছে, তার তিনভাগের একভাগও পেঁয়াজ আসেনি। বড় বড় শিল্পগ্রুপগুলো আমদানিপত্র নিলেও পেঁয়াজ আনেনি।’

ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেওয়ার পর কক্সবাজারের টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে মিয়ানমার থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৪৩ হাজার মেট্রিকটন পেঁয়াজ এসেছে। তবে ডিসেম্বরের পর থেকে মিয়ানমার থেকে আমদানির পরিমাণ অর্ধেকেরও কমে নেমে এসেছে বলে জানিয়েছেন টেকনাফ স্থলবন্দরের শুল্ক কর্মকর্তা মো. আবছার উদ্দিন।

পেঁয়াজ ব্যবসায়ী মো. আলী তালুকদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘পেঁয়াজের বাজারে এই হঠাৎ অস্থিরতা সাময়িক। দেশের পেঁয়াজ এই সপ্তাহের মধ্যেই বাজারে আসবে। ফেব্রুয়ারি নাগাদ আবারও মিয়ানমারের পেঁয়াজ আসা শুরু করবে। তখন সব ধরনের পেঁয়াজের দাম ৮০ টাকার নিচে চলে আসবে। তবে ভারত যতদিন রফতানি শুরু করবে না, ততদিন বাজারে উত্থান-পতন থাকবে।’

ভোজ্যতেলের দাম বাড়ছেই

গত নভেম্বর থেকে দেশের পাইকারি ও খুচরা বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়তে শুরু করেছে। বছরের শুরুতে এসে প্রায় লাগামহীন হয়ে পড়েছে ভোজ্যতেলের দাম। গত এক মাসে প্রতি লিটারে তেলে কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ টাকা এবং এক সপ্তাহের ব্যবধানে তিন থেকে চার টাকা করে বাড়ছে।

গত সপ্তাহে খাতুনগঞ্জের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রতিমণ সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ৩০০ টাকায়। এ সপ্তাহে বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৩৮০ টাকায়। গত সপ্তাহে সুপার সয়াবিন বিক্রি হয়েছিল ২ হাজার ৯৫০ টাকায়। এ সপ্তাহে বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৩০০ টাকায়। গত সপ্তাহে পাম অয়েল বিক্রি হয়েছিল ২ হাজার ৭৫০ টাকায়। গত সপ্তাহে বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ০৭০ টাকায়। এ সপ্তাহে বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ১০০ টাকায়।

পাইকারি বাজারে গত সপ্তাহে প্রতি লিটার সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে ৯১ টাকায়। সপ্তাহের প্রথম দিনে শনিবার (৪ জানুয়ারি) বিক্রি হয়েছে ৯৪ টাকা। একইভাবে সুপার সয়াবিন গত সপ্তাহের চেয়ে চার টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকায় এবং পাম অয়েল তিন টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৮৩ টাকায়।

খুচরা বাজারে চট্টগ্রাম নগরীর মোমিন রোডের মেসার্স হক স্টোরে সয়াবিন তেলের প্রতি পাঁচ লিটারের বোতলের মধ্যে পুষ্টি ও তীর মার্কা ৪৯০ টাকা এবং রুপচাঁদা ৫১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একই এলাকায় শরীফ স্টোরে রুপচাঁদা ৫১৫ টাকা, এস আলম ও মুসকান ৪৯৫ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।

দেশে বছরে ১৪ লাখ টনের মতো ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে, যার প্রায় পুরোটাই আমদানি করা হয়। আমদানি তেল বোতলজাত করে বাজারে বিক্রি করে বাংলাদেশ এডিবল অয়েল, সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, টি কে গ্রুপ, এস আলম, বসুন্ধরা, গ্লোবসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এছাড়া খোলা সয়াবিন ও পাম তেলও বিক্রি হয় বাজারে।

চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী আর এম ট্রেডার্সের পরিচালক আলমগীর পারভেজ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়ে গেছে। এই মুহূর্তে প্রতিমণ সয়াবিন তেলের বুকিং রেট হচ্ছে ৯৩০ ডলার আর পাম অয়েল ৮৩০ ডলার। নভেম্বর মাসে এর দাম অন্তঃত ১০০ ডলার কম ছিল। আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়ে যাওয়ায় এখানে আমাদের মিল মালিকরা কারখানার গেইটে তেল বিক্রি প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন। এই খবর বাজারে আসার পর পুরনো বুকিং রেটের তেল যাদের ছিল, তারাও বিক্রি কমিয়ে দিয়েছেন। মার্কেটে একটা সাপ্লাই ক্রাইসিস হয়েছে। এজন্য দাম বাড়ছে।’

বিশ্ববাজারে এক মাসে অপরিশোধিত পাম তেলের দাম ১০ শতাংশ ও অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম ১১ শতাংশের মতো বেড়েছে বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।

পেঁয়াজ ভোজ্য তেল লাগাম হীন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর