`হোমিও কলেজের বিরুদ্ধে নয়, ঋত্বিক ঘটকের ভিটা রক্ষায় আন্দোলন’
৫ জানুয়ারি ২০২০ ০১:০০
প্রবাদপ্রতিম বাঙালি চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের রাজশাহীর পৈতৃক ভিটা সংরক্ষণের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন হোমিওপ্যাথিক কলেজের বিরুদ্ধে নয় বলে জানিয়েছেন আন্দোলন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, ঋত্বিক ঘটকের ভিটায় নয় বরং অন্য কোথাও সরিয়ে নেওয়া হোক হোমিওপ্যাথিক কলেজ।
শনিবার (৫ জানুয়ারি) গণমাধমে পাঠানো এক প্রতিবাদলিপিতে এসব কথা জানানো হয়।
গত ২ জানুয়ারি রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আয়োজিত মানববন্ধনে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষসহ অন্য বক্তারা ভিটা সংরক্ষণ আন্দোলনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নোংরা ভাষায় বিষোদ্গার করেছেন অভিযোগ করে প্রতিবাদলিপিতে এসব মানহানিকর বক্তব্যের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়।
সেখানে আরও বলা হয়, “ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক ভিটা উদ্ধারের জন্য রাজশাহীর চলচ্চিত্র সংসদসমূহ ও সকল পর্যায়ের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মী এবং ঢাকার নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, তানভীর মোকাম্মেল, মোরশেদুল ইসলামসহ ১২ খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার, ভারত, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্রপ্রেমীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে গত ২৩ ডিসেম্বর ২০১৯ থেকে শুরু হওয়া আন্দোলন কর্মসূচিকে মানববন্ধনে যেভাবে হোমিওপ্যাথিক কলেজকে ধ্বংসের পাঁয়তারা হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে তা সত্যের অপলাপ ছাড়া আর কিছুই নয়। ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটির মতো একটি সক্রিয় ও দেশে-বিদেশে পরিচিত চলচ্চিত্র সংসদকে একটি নামসর্বস্ব সংগঠন হিসেবে অভিহিত করেই তাঁরা ক্ষান্ত হননি, তাঁরা এর সভাপতি এবং গত এক যুগ ধরে ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক ভিটায় দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান চলচ্চিত্রব্যক্তিত্বদের এনে ‘ঋত্বিক সম্মাননা পদক প্রদান ও চলচ্চিত্র উৎসব’ আয়োজনের প্রধান পৃষ্ঠপোষককে ভূমিদস্যু ও ‘দখলবাজ হিসেবে আখ্যা দিতেও পিছপা হননি।”
আন্দোলনকারীরা জানান, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগে ঋত্বিক ঘটকের বাবা সুরেশ চন্দ্র ঘটক রাজশাহীর মিঞাপাড়ায় বাড়ি করে স্থায়ী আবাস গড়েন। দেশভাগের পরে এই বাড়ি ছেড়ে ঋত্বিক ঘটকের পরিবারকে কলকাতা চলে যেতে হয়। এই ভিটার ৩৪ শতাংশ জমি এরশাদ সরকারের শাসনামলের শেষ দিকে হোমিওপ্যাথিক কলেজকে লিজ দেওয়া হয়। ১৯৮৭-৮৮ সালের ওই লিজ-সংক্রান্ত যে দলিলপত্রের হদিস পাওয়া যায় তাতে ঋত্বিকের বাবা সুরেশ চন্দ্র ঘটক ও মা ইন্দুবালা দেবীর নাম উল্লেখ পাওয়া যায় এবং জমিটিকে ‘এনিমি প্রপার্টি’ তথা ‘শত্রু সম্পত্তি’ হিসেবে উল্লেখ পাওয়া যায়।
এই জমিরই ফাঁকা একটি অংশে হোমিওপ্যাথিক কলেজ কর্তৃপক্ষ ২০০৬ সালে দোতলা ভবন নির্মাণ করে। অপর অংশে ঋত্বিক ঘটক ও তাঁর পরিবার, তাঁর বড় ভাই মনীশ ঘটকের মেয়ে উপমহাদেশের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবীর স্মৃতিবিজড়িত কয়েকটি কক্ষ এখনো অবিকৃত রয়েছে। এখানে বিগত সময়ে মহাশ্বেতা দেবী, ঋত্বিক ঘটকের জমজ বোন প্রতীতি দেবী ও তাঁর মেয়ে বর্তমান সরকারের সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক এমপি আরমা দত্ত একাধিকার এই ভিটায় এসে স্মৃতিবিজড়িত এসব কক্ষ দেখে আবেগাপ্লুত হয়েছেন।
বর্তমানে টিকে থাকা কক্ষগুলো হোমিওপ্যাথিক কলেজের কমনরুম ও হাসপাতালের বহির্বিভাগ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কলেজ কর্তৃপক্ষ গত ২১ ডিসেম্বর ২০১৯ এই অংশের একটি দেয়াল ও সংলগ্ন একটি কক্ষ সাইকেল গ্যারেজ নির্মাণের জন্য ভেঙে ফেলে। এরপরই দেশে-বিদেশে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে ওঠে। যার পরিপ্রেক্ষিতে পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে হোমিওপ্যাথিক কলেজ কর্তৃপক্ষ ওই মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে।
প্রতিবাদলিপিতে সাক্ষরকারীরা বলেন, ‘আমরা রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে পরিষ্কার ভাষায় বলতে চাই, এই আন্দোলন কিছুতেই হোমিওপ্যাথিক কলেজের বিরুদ্ধে নয়। রাজশাহীর জেলা প্রশাসক ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের কাছে যে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে, রাজশাহী নগরীর সাহেববাজার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, ঢাকার শাহবাগ, কানাডার টরন্টোসহ বিভিন্ন স্থানে যেসব মানববন্ধন ও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হয়েছে তাতে কোথাও হোমিওপ্যাথিক কলেজের স্বার্থবিরোধী কিছু বলা হয়নি, তাদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারও করা হয়নি। বরং, বলা হয়েছে এই কলেজকে অন্যত্র সরিয়ে ঋত্বিকের পৈতৃক ভিটাকে সরকার সংরক্ষণ করুক এবং এখানে ঋত্বিকের নামে একটি চলচ্চিত্র কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হোক। এই ভিটা কোনো সংগঠন বা কোনো ব্যক্তির দখল করার প্রশ্নই ওঠে না।’
রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের শুভবুদ্ধির উদয় হবে আশা করে প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়, ‘আমরা জানি, রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক কলেজ ও হাসপাতালের সঙ্গে সম্পৃক্তদের বেশিরভাগই স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির অনুসারী। তাদের অপতৎপরতা বন্ধ না হলে আমরা এটাই ভাবতে বাধ্য হবো যে, সাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনা থেকেই তারা সাতচল্লিশের মর্মান্তিক দেশভাগের অনিবার্য ফল হিসেবে দেশত্যাগে বাধ্য হওয়া সনাতন তথা হিন্দু ধর্মাবলম্বী ঋত্বিকের পৈতৃক ভিটাতে সুপরিকল্পিতভাবে আস্তানা গেড়েছেন।’
প্রতিবাদলিপিতে যারা সাক্ষর করেছেন তারা হলেন, রাজশাহী ফিল্ম সোসাইটির সভাপতি আহসান কবীর লিটন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের সভাপতি ড. সাজ্জাদ বকুল, বঙ্গবন্ধু পরিষদের রাজশাহী মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক কবি আরিফুল হক কুমার, রাজশাহী কবিকুঞ্জের সভাপতি অধ্যাপক রুহুল আমিন প্রামাণিক, বরেন্দ্র ফিল্ম সোসাইটির সভাপতি সুলতানুল ইসলাম টিপু, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট রাজশাহীর সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার ঘোষ, ভোর হলো’র সভাপতি কামার উল্লাহ সরকার কামাল, রাজশাহী থিয়েটারের সভাপতি নিতাই কুমার সরকার, জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ রাজশাহীর সভাপতি আব্দুর রাকিব, ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি রাজশাহী মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান উজ্জ্বল, রাজশাহী আবৃত্তি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শরীফ আহমেদ বিল্টু, খেলাঘর আসর রাজশাহীর সাধারণ সম্পাদক আফতাব হোসেন কাজল ও জয়বাংলা সাংস্কৃতিক জোট রাজশাহীর সভাপতি নিজামুল হুদা লিটন।
ঋত্বিক ঘটক ঋত্বিক ঘটকের পৈত্রিক ভিটা রক্ষা আন্দোলন রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক কলেজ