বঙ্গবন্ধুর ‘মুক্তিযোদ্ধা’, বাংলা একাডেমির সংজ্ঞা ও জামুকার দাবি
৭ জানুয়ারি ২০২০ ১৪:৩৮
‘দেশের জন্যে যুদ্ধ করার সেই অবিশ্বাস্য গৌরব সবার জন্যে নয়, সৃষ্টিকর্তা অনেক য্ত্ন করে সৌভাগ্যবান কিছু মানুষকে তার জন্যে বেছে নিয়েছেন। বাংলাদেশে ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী কিংবা সাহিত্যিক হবে, ফিল্ড মেডেল বিজয়ী গণিতবিদ হবে, অস্কার বিজয়ী চিত্রপরিচালক হবে, অলিম্পিকে স্বর্ণবিজয়ী দৌড়বিদ হবে, ওয়ার্ল্ডকাপ বিজয়ী ক্রিকেট টিম হবে, এমনকি মহাকাশ বিজয়ী মহাকাশচারী হবে কিন্তু আর কখনওই মুক্তিযোদ্ধা হবে না! এই সম্মানটুকু সৃষ্টিকর্তা যাদের জন্যে আলাদা করে রেখেছেন শুধু তাঁরাই তার প্রাপ্য, অন্যেরা নয়।’– বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। এরপরও বীর মুক্তিবাহিনী তথা মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে আর কিছু বলার প্রয়োজন আছে কি? তারপরও কিছু না বললেই নয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধে যার যেরকম অবদান সেরকম ভাবেই তিনি স্বীকৃতি পাবেন বা পরিচিত হবেন বা সম্মান পাবেন- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কিছুতেই সবাইকে গণহারে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বলা ঠিক নয়। মুক্তিযোদ্ধা তিনিই এবং শুধু তিনিই যিনি ভারতের মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং সেন্টারে সশস্ত্র ট্রেনিং নিয়েছেন বা দেশের অভ্যন্তরে কোথাও মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং সেন্টারে সশস্ত্র ট্রেনিং নিয়েছেন এবং অস্ত্র হাতে জীবন বাজি রেখে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধ বা গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। আগ্নেয়াস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে যুদ্ধ না করলে মুক্তিযোদ্ধা হওয়া যায় না। কিছুতেই না। মুক্তিযোদ্ধা তিনিই যে অবশ্যই হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করেছে। সেটা গেরিলা যুদ্ধ হোক বা সম্মুখ যুদ্ধ হোক।
‘মুক্তি’র সাথে ‘যুদ্ধ’ শব্দটা যুক্ত আছে এবং ‘মুক্তি’র সাথে রয়েছে ‘যোদ্ধা’ শব্দটিও। কাজেই এখানে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ ও ‘মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দ দুটি বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নাই। তবে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে আমাদের ‘সহযোদ্ধা’ বলে কিছুই ছিল না। ‘সহযোদ্ধা’ বলতে একাত্তরে বুঝতাম রণাঙ্গনে সশস্ত্র যুদ্ধরত অবস্থায় আমার আরেকজন সাথী; যিনি সশস্ত্র যুদ্ধরত। এখানে কাল্পনিক সহযোদ্ধা বলতে তৃতীয়পক্ষ কেউ কখনও ছিল না। ‘সহযোদ্ধা’ শব্দটি নতুনভাবে উচ্চারণ করে সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা সম্মান ও মর্যাদাকে অযথা ইচ্ছাকৃতভাবে বিতর্কিত করা হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু সরকারের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা: বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকার মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নির্ধারণ করে ১৯৭২ সালের ৭ আগস্ট গেজেট প্রকাশ করেছিল। সেই গেজেটে মুক্তিযোদ্ধাকে সংজ্ঞায়িত করে বলা হয়েছিল, ‘Freedom Fighter mean any person who had served as a member of any force engaged in the war of liberation but shall not include members of the Defence Services or the police or the Civil Armed Forces.’
জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকার)-এর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা- ’The people who were involved in the liberation war in response to the call of the Father of the Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman in between March 26 and December 16, 1971.’
বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান অনুযায়ী ‘মুক্তিবাহিনী, মুক্তিফৌজ, মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা হলো: মুক্তিবাহিনী, মুক্তিফৌজ, মুক্তিযোদ্ধা- দেশের মুক্তির জন্য যারা যুদ্ধ করেন; দেশকে হানাদার মুক্ত করার জন্য যারা যুদ্ধে রত হন; বাংলাদেশকে পাকিস্তানি হানাদারদের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য যারা ১৯৭১-এ লড়াই করেছিলেন।
বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞা: ‘মুক্তিযুদ্ধ: রাজনীতিক আর্থনীতিক সামাজিক তথা সার্বিক মুক্তি বা স্বাধীনতার জন্য যে যুদ্ধ।’
বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান অনুযায়ী মুক্তিসংগ্রামের সংজ্ঞা: ‘মুক্তিসংগ্রাম: স্বাধীনতা ও সামাজিক মুক্তির জন্যে যে আন্দোলন।’
জামুকার নতুন বানানো সংজ্ঞা অনুযায়ী যদি গণহারে সবাইকে মুক্তিযোদ্ধা বা সহযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা করা হয় তাহলে যারা জেনেশুনে বিষ পান করে এই বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিবেন একদিন তাদেরকে জাতির কাছে জাবাবদিহি করতেই হবে।
মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিবাহিনীর নতুন বানানো সংজ্ঞা নিয়ে সারাবাংলার প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধারা বাংলার আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা ও অশনিসংকেত দেখতে পাচ্ছেন।
জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) বঙ্গবন্ধুর সংজ্ঞায় হস্তক্ষেপ কেনো করলেন? বঙ্গবন্ধু কন্যাতো এখনও বেঁচে আছেন। বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞাকে অত্যন্ত সুকৌশলে পাশ কাটিয়ে জামুকার নতুন মুক্তিযোদ্ধার গোঁজামিল উদ্ভট সংজ্ঞায় বড়ধরনের শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। ‘জামুকা’র মুক্তিযোদ্ধার নতুন সংজ্ঞা অনুযায়ী বাংলা একাডেমির অভিধান কি নিষিদ্ধ করতে হবে? বাংলা একাডেমি বা দেশবাসী বা মুক্তিযোদ্ধারা কি সেটা মেনে নিবেন? তাছাড়া বঙ্গবন্ধু কন্যাতো বাংলা একাডেমির আজীবন সম্মানিত সদস্য।
বাংলার গণিতশাস্ত্রবিদ ভূগুরাম দাস তথা শুভঙ্কর যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে জামুকার মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা দেখে তিনি নিজেও লজ্জা পেতেন এবং জামুকার কাছে হানাদার পাকিস্তানিদের মতো নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতেন। তবে এটাও ঠিক এই মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞাটি যারা তৈরি করেছেন তারা শুভঙ্করের চেয়েও আরও বেশি মেধাবী।
জামুকার সংজ্ঞায় অস্ত্র প্রশিক্ষণ ও সশস্ত্র যুদ্ধের কথা উল্লেখ নেই- নেই কোনো সংঘবদ্ধ বাহিনীর অস্তিত্ব। এটা প্রচ্ছন্নভাবে মুক্তিকামী জনতার সংজ্ঞা হতে পারে। জামুকার সংজ্ঞায় একস্থানে বলা হয়েছে ‘in between March 26 and December 16, 1971’. তাহলে আওয়ামী লীগ নেতা আ ক ম মোজাম্মেল হক তো (মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী) বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার আগেই অর্থাৎ মার্চের ১৯ তারিখে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছেন এবং দশ হাজার লোকের নেতৃত্ব দিয়ে প্রতিরোধযুদ্ধ করেছেন। তাহলে তিনি কি পাকিস্তানিদের ভাষ্য মতো ‘সশস্ত্র দুষ্কৃতকারী’ হিসেব গণ্য হবেন? (যদিও তিনি বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসায় গিয়ে বঙ্গবন্ধুর অনুমতি নিয়েই অস্ত্র ধরেছিলেন)। আর আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরের মুক্তিযোদ্ধারা যারা ডিসেম্বর ১৬ তারিখের পরও অর্থাৎ ২২ ডিসেম্বর সন্ধ্যা পর্যন্ত হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সম্মুখ যুদ্ধ করেছি আমরা কী হিসেবে পরচিতি হব? আমরাও কি তাহলে ‘সশস্ত্র দুষ্কৃতকারী’? (উল্লেখ্য বাঞ্ছারামপুরের পাকিস্তানি আর্মি ২২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আত্মসমর্পণ করে)।
বঙ্গবন্ধু বেঁচে নেই; কিন্তু তার প্রদত্ত মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞার কী হবে? বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে কি মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা পরিবর্তন সম্ভব হতো? তাই আমরা বঙ্গবন্ধুর শাশ্বত চিরন্তন সংজ্ঞার আলোকে মুক্তিযোদ্ধার সঠিক তালিকাও চাই। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যাতো এখনও বেঁচে আছেন। বঙ্গবন্ধুর রক্ত তাঁর ধমনীতে প্রবাহিত হচ্ছে। তিনি কি বঙ্গবন্ধুর সংজ্ঞাকে পরিবর্তন করে জামুকার নতুন বানানো সংজ্ঞাকে মেনে নেবেন?
সারাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাদ দেওয়া হয়েছে? ভয় কি বন্ধু! বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত মুক্তিযোদ্ধার শাশ্বত সংজ্ঞাকে পাশকাটিয়ে চলে গেছে? ভয় কি বন্ধু! রাজাকারের তালিকায় বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম উঠেছে? তোমার মান-সম্মান ও মর্যাদা খেয়েছে? হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে? ভয় কি বন্ধু! ‘বড় বড় লোকেদের ভিড়ে জ্ঞানী আর গুণীদের আসরে তোমাদের কথা কেউ কবে না’ ভয় কি বন্ধু! ‘তোমাদের কথা রবে সাধারণ মানুষের ভীড়ে, মাঠে মাঠে কৃষাণের মুখে, ঘরে ঘরে কৃষাণীর বুকে।’
প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুরা এতো হতাশা হওয়ার কিছুই নাই- ‘মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়/ আড়ালে তার সূর্য হাসে/ হারা শশীর হারা হাসি/ অন্ধকারেই ফিরে আসে।’ বাংলার আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটার আড়ালে দেখতে পাচ্ছি সূর্য হাসছে এবং এই অন্ধকারের মধ্যেই রক্তিম সূর্য আবার ফিরে আসবে বন্ধুগণ! কারণ মুক্তিযোদ্ধাদের একমাত্র অভিভাবক বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এখনও বেঁচে আছেন।
লেখক: ফারুক ওয়াহিদ, ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা, বাঞ্ছারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
[মত-দ্বিমতে প্রকাশিত মন্তব্য লেখকের নিজস্ব]