ইরান-আমেরিকা ‘যুদ্ধে’ সম্ভাব্য যেসব ঝুঁকির মুখে বিশ্ব অর্থনীতি
৭ জানুয়ারি ২০২০ ২০:৩০
পারস্য উপসাগরের হরমুজ প্রণালী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি নৌ-রুট। এ রুট দিয়ে সারাবিশ্বের প্রায় ৩০ থেকে ৪০ ভাগ জ্বালানি তেল বিভিন্ন পাঠানো হয়। জাপানের জন্য প্রতিদিন যে পরিমাণ জ্বালানি তেলের প্রয়োজন হয় তার শতকরা ৯০ হরমুজ প্রণালী দিয়ে পার হয়। চীনের জ্বালানি তেলের চাহিদার সম্ভবত শতকরা ৪০ ভাগই সরবরাহ করা হয় এই রুট দিয়ে। এছাড়া ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার দেশগুলোর জন্য এই রুট দিয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ তেল সরবরাহ করা হয়।
ইরান ও আমেরিকার যদি কোনভাবে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় তবে ইরানের এই হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ হরমুজ প্রণালীর প্রধান নিয়ন্ত্রণ ইরানের হাতে। দেশটি চাইলেই এই প্রণালী বন্ধ করে দিতে পারে। দুয়েকটি যুদ্ধ জাহাজের ওপর হামলা করে সেগুলো ডুবিয়ে দিলে অথবা তেলবাহী কয়েকটি বাণিজ্যিক জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েও হরমুজ প্রণালী বন্ধ করা যেতে পারে। জাহাজ ডুবিয়ে বন্ধ না করা গেলেও এই রুটটি হবে বড় যুদ্ধক্ষেত্র। ফলে এই গুরুত্বপূর্ণ নৌ-রুট ব্যবহার করে সারাবিশ্বের তেল সরবরাহ ঠিক রাখা যাবে না। যদি পরিস্থিতি এমন হয় তাহলে সারাবিশ্বে তেলের দাম হু হু করে বাড়বে। এবং প্রতি ব্যারেল তেলের দাম কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটা আমরা ঠিক এই মুহূর্তে কল্পনাও করতে পারব না। যদি যুদ্ধ বাঁধে এবং পরিস্থিতি এ রকম হয় তবে তা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বা আমেরিকা সামাল দিতে পারবে না। ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি’র কুদ্স ব্রিগেডের কমান্ডার মেজর জেনারেল কাসেম সোলায়মানিকে আমেরিকা হত্যা করার পর এরই মধ্যে বিশ্ববাজারে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৫ ডলার বেড়ে গেছে।
হরমুজ প্রণালীর মতো আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রণালী হচ্ছে বাব আল-মান্দেব। ভারত মহাসাগর ও ওমান সাগর থেকে তেলবাহী বা অন্য যেসব পণ্যবাহী জাহাজ ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার দেশগুলোতে যেতে চায় তারা ভারত মহাসাগর থেকে ইয়েমেন উপকূলের বাব আল-মান্দেব প্রণালী দিয়ে প্রবেশ করে। এরপর এডেন উপসাগর ও লোহিত সাগর হয়ে ভূমধ্যসাগর দিয়ে গিয়ে সুয়েজ খাল পার হয়ে আটলান্টিক মহাসাগরে যায়। এরপর এসব জাহাজ ইউরোপ-আমেরিকার পথে পাড়ি জমায়। যদি ইরান এবং আমেরিকার মধ্যে যুদ্ধ লাগে তাহলে আশঙ্কা করার জোরালো কারণ রয়েছে যে, পুরো মধ্যপ্রাচ্যে সেই যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়বে এবং তাতে ইয়েমেনের হুথিরাও জড়িয়ে পড়বে। হুথিরা ইরান সমর্থিত। হুথিরা যদি একই কায়দায় বাব আল-মান্দেব প্রণালী বন্ধ করে দেয় কিংবা বাব আল-মান্দেব প্রণালী যদি হরমুজ প্রণালীর মতোই আরেকটি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয় তাহলে এ পথ দিয়ে জাহাজ চলাচল কঠিন হয়ে পড়বে।
মনে রাখতে হবে, এই রুট ব্যবহার করে যে জাহাজটি আমেরিকায় যেতে চায় সেটির যদি বিকল্প পথে যাওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়ে তখন বাড়তি ২৯ দিন সময় লাগবে গন্তব্যে পৌঁছতে। এতে জাহাজটির পরিবহন খরচ বেড়ে যাবে এবং জ্বালানি তেল পৌঁছাতেও বেশি সময় লাগবে। এছাড়া অন্যান্য ঝুঁকিতো থাকবেই। বিকল্প পথে ইউরোপের দেশগুলোতেও যেতে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে অনেক বেশি সময় লাগবে। সেক্ষেত্রে খরচ এবং সময় দুটোই বাড়বে। আর এতে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তেই থাকবে। এ থেকে বোঝা যায়, আমেরিকা ও ইরান যদি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তাহলে তেলের দাম বেড়ে যাবে। এতে সারাবিশ্ব জ্বালানি তেলকে কেন্দ্র করে ভয়ংকর একটা অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে; যা ঠেকানো কষ্টকর হবে।
পারস্য উপসাগর অঞ্চলের দেশ ইরাক, কুয়েত, সৌদি আরব, বাহরাইন, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমানের পাশাপাশি ইরানও বিশ্ববাজারে তেল সরবরাহ করে থাকে। যদি যুদ্ধ শুরু হয় তবে প্রতিটি দেশেরই তেল উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যাহত হবে। হরমুজ প্রণালী ও বাব আল-মান্দেব প্রণালী যদি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত নাও হয় পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠবে। এতে তেলের উৎপাদন এবং সরবরাহ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হবে। ফলে বিশ্ব অর্থনীতি অস্থিতিশীল হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
এতক্ষণ যা বলা হলো তা হচ্ছে, যুদ্ধ শুরু হলে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। এর বাইরেও বিশ্ব অর্থনীতির জন্য নেতিবাচক খবর থাকবে। তা হচ্ছে, পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোতে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে তেল স্থাপনা ও সমুদ্রবন্দরগুলো ক্ষতির সম্মুখীন হবে। আর এটা যে খুব অল্প সময়ের মধ্যে স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরিয়ে আনা যাবে তা কিন্তু নয়। এটি হবে সম্ভাব্য যুদ্ধের সুদূর প্রসারি প্রভাব। এই প্রভাবে পশ্চিমা দুনিয়া যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্রাচ্য।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব, ইরাক, কুয়েত, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, বাহরাইনে বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক জনশক্তি রফতানি করা হয়েছে। সেখানে আমাদের দেশের লোকজন কাজ করে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠাচ্ছে। ইরান-আমেরিকার যুদ্ধ শুরু হলে এবং সেই যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্য ছড়িয়ে পড়লে এই সমস্ত দেশের জীবন-জীবিকা মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়বে। এতে বাংলাদেশিরা দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হবে। সেক্ষেত্রে আমাদের দেশের অর্থনীতি ও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ক্ষেত্রে বড়ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাতে আমাদের অর্থনীতিও বিপর্যস্ত হতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশের শ্রমিকদের পাশাপাশি ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইনসহ বিভিন্ন দেশের শ্রমিকরাও কাজ করে। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে তারাও দেশে ফিরে যেতে বাধ্য হবে। ফলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো তাৎক্ষণিকভাবে বড় রকমের চাপে পড়বে। এতে তাদের অর্থনীতিও বিপর্যস্ত হবে। আবার যেসব দেশের জনশক্তি ফিরে যাবে তারাও সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এদিক দিয়ে ইরান কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে। কারণ ইরানে সাধারণত কোনো বিদেশি শ্রমিক কাজ করে না। দেশটির জনগণ নিজেরাই নিজেদের কাজ করে থাকে। যতই যুদ্ধ-বিগ্রহ যাই হোক না কেন নিজেরাই নিজেদের অর্থনীতির চাকা মোটামুটিভাবে সচল রাখতে সক্ষম তারা। এর বিপরীতে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলো বড়ধরনের বিপদের মুখে পড়বে। সেক্ষেত্রে তাদের সামনে বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেবে শ্রমিক সংকট। বিদেশি শ্রমিকরা চলে গেলে তাদের কল-কারখানাসহ অন্যান্য জায়গা মোটামুটি বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ কল-কারখানায় কাজ করে ওই দেশগুলোর অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছেন মূলত বিদেশি শ্রমিকরাই।
লেখক: রেডিও তেহরানর সাংবাদিক