২২ বছরের বিচারিক জীবনে বহু দৃষ্টান্ত রেখে গেলেন মইনুল ইসলাম
৮ জানুয়ারি ২০২০ ২২:২১
ঢাকা: শেষ অফিস করলেন বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী। এই বিদায় লগ্নে মুখে মুখে তাই একটি কথা ঘুরছিল— ‘বিচারক হিসেবে তিনি ছিলেন সৎ এবং আদর্শবান। সমস্ত কর্মজীবনে তিনি ছিলেন নিরপেক্ষ, ন্যায় বিচারের পক্ষে’।
বুধবার (৮ জানুয়ারি) দুপুর ১টায়, এনএক্স ২১ নম্বর কোর্টে বিচারিক কাজ পরিচালনা করেছেন মইনুল ইসলাম চৌধুরী। তাকে সংবর্ধনা জানাতে এজলাস কক্ষে হাজির হন তিন শতাধিক আইনজীবী।
সেই ভিড়ের প্রথম সারিতে ছিলেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিন, সম্পাদক এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন এবং সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ এফ হাসান আরিফ।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, আপনি সুদীর্ঘ সময় কৃতিত্বের সঙ্গে হাইকোর্ট বিভাগে বিচারিক দায়িত্ব পালন করেছেন। আপনি ছিলেন আদর্শবান বিচারপতি। আপনি ধৈর্য ধরে মামলা শুনতেন এবং সব সময় চেষ্টা করেছেন ন্যায় বিচার করতে।
তিনি বলেন, আপনার আদালতে কেউ কোনোদিন অন্যায় সুযোগ নিতে পারেনি। বিচারপতি হিসেবে আপনি যে শপথ নিয়েছিলেন, আমি মনে করি আপনি তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। আপনি আরও কিছু দিন এই দায়িত্ব পালন করে যেতে পারলে বিচার বিভাগ নিশ্চয়ই আরও উপকৃত হতো।
এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, আপনি বিচারপতি থাকাকালে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় দিয়েছেন। আইনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যা পরবর্তীতে বিভিন্ন জার্নালে স্থান পেয়েছে। স্কুল ছাত্রদের ব্যাগের ওজন নিয়ে যে রায় দিয়েছিলেন তা ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছে। দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইন সম্পর্কে আপনার সম্যক ধারণা ছিল।
এ এফ হাসান আরিফ বলেন, আইনজীবীদের কাছে আপনি কতটা প্রিয়-শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন, আজ আইনজীবীদের এই ভিড়ই তা বলে দেয়।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আব্দুল বাসেত মজুমদার বলেন, আপনাকে নিয়ে আমরা গর্ব করি। আপনার জ্ঞানের পরিধি দেখে আমরা বিমোহিত হই। আপনি চলে গেলেও আপনার স্মৃতি রয়ে যাবে জুডিশিয়ারিতে।
মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, আমরা আপনাকে মিস করবো, জুডিশিয়ারি আপনাকে মিস করবে।
এসময় বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর দীর্ঘায়ু কামনা করেন ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, আইনজীবী জুনায়েদ সিদ্দিকীসহ অনেকে।
আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, এ রকম ন্যায় বিচারক যদি আজীবন বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, তবু কেউ আপত্তি তুলবেন না। আইন অনুযায়ী, ৬৭ বছর বয়সে একজন বিচারপতিকে অবসরে যেতে হয়। এমন দক্ষ ও ন্যায় বিচারকদের মেধা কাজে লাগাতে নতুন আইন করে সরকার ফের নিয়োগ দেওয়ার বিধান চালু করতে পারে।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বিচার বিভাগের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট হলো এর বিচারিক পর্যালোচনার ক্ষমতা। এই ক্ষমতাই বিচার বিভাগের প্রাণ। উচ্চ আদালতের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা হচ্ছে নির্বাহী এবং আইন বিভাগের বাড়াবাড়িকে সামলানো। আইনের শাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নির্ভর করে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গীর ওপর। জনগণ যদি মনে করে বিচার বিভাগ নিরপেক্ষভাবে কাজ করছে না, তাহলে সবকিছু অর্থহীন হয়ে পড়বে।
তিনি বলেন, আমাদের সংবিধানের ৯৫(গ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, বিচারক নিয়োগে রাষ্ট্র আইন প্রয়োগ করতে পারে। কিন্তু দক্ষ, যোগ্য ও সাহসী বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো সরকারই আইন প্রণয়ন করেনি। এ জন্য আপিল বিভাগের বিচারপতিদের এগিয়ে আসতে হবে।
এক নজরে
বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ১৯৫৩ সালের ৯ জানুয়ারি সিলেটের কোতয়ালী থানার বিলপার (লামাবাজার) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আবদুল ফাত্তাহ চৌধুরী, মা রৌনক আরা বেগম।
১৯৬৮ সালে এসএসসি এবং ১৯৭০ সালে এইচএসসি পাস করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য বিষয়ে পড়েন। ১৯৮২ সালের ১৭ মার্চ সহকারী বিচারক হিসেবে বিসিএস (জুডিশিয়াল) ক্যাডার সার্ভিসে যোগ দেন। এরপর ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত মইনুল ইসলাম চৌধুরী আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব (প্রশাসন-১) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৯৮ সালের পহেলা মার্চ জেলা ও দায়রা বিচারক হিসেবে পদোন্নতি পান। ২০০৪ সালের ২৩ আগস্ট তিনি হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। এর ঠিক দুই বছরের মাথায় ২০০৬ সালে তিনি স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন।
বিচারিক জীবনে আলোচিত অনেক মামলার রায় দিয়েছেন বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী। তার মধ্যে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ও অবৈধ ঘোষণার রায়, রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদা ক্রম সংক্রান্ত মামলার রায়, সৌদি দূতাবাস কর্মকর্তা খালাফ আল আলী হত্যা মামলার আপিলের রায়, নদীকে জীবন্ত স্বত্বা ঘোষণা করে রায়, মানবদেহের অঙ্গ-প্রতঙ্গ প্রতিস্থাপন সংক্রান্ত রিট মামলার রায় উল্লেখযোগ্য।