বঙ্গবন্ধুকে ব্রিটিশ পুলিশ বলল- স্যার, উই হ্যাভ প্রেইড ফর ইউ
১০ জানুয়ারি ২০২০ ১২:৪৩
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। বিকেল ৪.৩১ মিনিট। ঢাকার ‘রমনা রেস কোর্স ময়দানে’ জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের দলিলে সই করেন। বিজয়ের উল্লাসে মেতে ওঠে গোটা বাঙালি জাতি। কিন্তু কোথায় যেন অপূর্ণতার সুর। কী যেন নেই, কে যেন নেই!
হ্যাঁ, বাঙালির অস্তিত্বের সমস্তটুটু জুড়ে যার বসবাস, যাকে ছাড়া স্বাধীনতা অর্থহীন- বাঙালির সেই রাখাল রাজা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখনো পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। কিন্তু বিজয়ী বীরকে, বিজয়ী জাতির নেতাকে কি আর বন্দি রাখা য়ায়? শ্বাশত নিয়মেই মুক্তি পেলেন বঙ্গবন্ধু।
কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু মুক্তি পেয়েছেন। ড. কামাল হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে দেশের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন! তিনি সুস্থ আছেন! বেঁচে আছেন!— এই সংবাদ ছিল বাঙালি জাতির কাছে স্বপ্নের মতো। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের কাছে সেই মুহূর্তে এর চেয়ে আনন্দের সংবাদ আর কিছু ছিল না।
সম্প্রতি সারাবাংলাকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আনন্দঘন মুহূর্তের গল্প শুনিয়েছেন ড. কামাল হোসেন। বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী সামনে রেখে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন, সারাবাংলার স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট আসাদ জামান। ছবি তুলেছেন সিনিয়র ফটো করেসপন্ডেন্ট হাবিবুর রহমান।
সারাবাংলা: কারামুক্তির পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের মুহূর্তটি কেমন ছিল?
ড. কামাল হোসেন: আমাকে রাখা হয়েছিল অ্যাবোটাবাদের কাছে একটি কারাগারে। বন্দিত্বের ৯ মাসে ওরা আমার সঙ্গে খুব ভাল আচরণ করেনি। অন্য বন্দিরা কারাকক্ষের বাইরে একটু হাঁটা-হাঁটি করার সুযোগ পেলেও, আমি পাইনি। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বরের পর দেখলাম হঠাৎ ওদের আচরণ পাল্টে গেল। জেলের কর্মকর্তারা এসে আমার সঙ্গে ভালভাবে কথা বলতে লাগল। এটা-ওটা ঘুরিয়ে দেখাল। আমি বুঝতে পারলাম কিছু একটা ঘটেছে। ২৮ ডিসেম্বর একজন এসে বলল, সব কিছু গুছিয়ে নিন। আপনাকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাব। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোথায়? ওরা শুধু বলল, যেখানে নিয়ে যাব সেখানে আপনার খুব ভাল লাগবে। ঠিক তাই হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি যেখানে পৌঁছালাম, সেখানে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হলো। তিনি তখন একটা রুমের মধ্যে ছিলেন। দৌড়ে এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। জিজ্ঞেস করলেন, আসতে এতো দেরি হলো কেন? আমার অনুভূতি তখন অন্য রকম ছিল। সব কিছু স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল।
সারাবাংলা: তারপর?
ড. কামাল হোসেন: আমি ওখানে যাওয়ার তিনদিন আগে অর্থাৎ ২৪ তারিখে ভুট্টো আসেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। বঙ্গবন্ধু তখন ভুট্টোকে বললেন, তুমিও কি বন্দি? ভুট্টো তখন বললেন, না না আমি তো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। বঙ্গবন্ধু তখন বললেন, তুমি কী করে প্রেসিডেন্ট হলে? আমি তো তোমার থেকে দুইগুণ বেশি সিট পেয়েছিলাম জাতীয় পরিষদে। তখন ভুট্টো বললেন, আপনি প্রধানমন্ত্রী হয়ে যান। বঙ্গবন্ধু তখন বললেন- এসব কথা রাখ। আমাকে যতদ্রুত সম্ভব বাংলাদেশে পাঠিয়ে দাও। আমি বাংলাদেশে যেতে চাই, এক মুহূর্ত দেরি করতে চাই না। ভুট্টো তখন বললেন, আমাকে একটু সময় দাও আমি ব্যবস্থা করছি।
ভুট্টো চলে যাওয়ার সময় বঙ্গবন্ধু বললেন, আমার ধারণা ড. কামাল হোসেনও এখানে আছে (বঙ্গবন্ধুর যখন বিচার চলছিল, তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল আপনার পক্ষে আইনজীবী কে হবেন? তখন বঙ্গবন্ধু সঙ্গে সঙ্গে বলেছিলেন- ড. কামাল হোসেনকে আমি চাই। বিচারকরা তখন বললেন যে, এটা সম্ভব হবে না। আমরা সরকারের তরফ থেকে ব্রুহি সাহেবকে নিয়োগ করব। তিনি আপনাকে আত্মপক্ষ সমর্থনে সাহায্য করবেন। তখনই বঙ্গবন্ধুর সন্দেহ হয়েছিল, ড. কামালও পাকিস্তানে বন্দি) তাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন। তখন ভুট্টো বললেন, আমি দেখছি বিষয়টা।
সারাবাংলা: ২৮ ডিসেম্বর থেকে ৮ জানুয়ারি আপনি তো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন? জায়গাটা কেমন ছিল? আপনারা ওখানে কী করছিলেন?
ড. কামাল হোসেন: ওটা ছিল রাওয়ালপিন্ডির অদূরে শিহালা পুলিশ অ্যাকাডেমি। ওখানে যাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, তুমি লেগে থাক। এভাবে লেগে থাক, আমাদের পাঠানোর ব্যাপারে ওরা যেন দেরি না করে। ওদের ফরেন মিনিস্টার আজিজ আহমেদ আসল আমার সঙ্গে দেখা করতে। আমি ওকে বললাম, আমাদের দ্রুত পাঠানোর ব্যবস্থা কর। সে তখন বলল, কয়েকটা দিন লাগতে পারে। ৩ জানুয়ারি ভুট্টোর পাবলিক মিটিং আছে। ওখানে ঘোষণা দেবে, বঙ্গবন্ধুর ব্যাপারে সে কী করতে চায়।
আমি বললাম, আমরা দ্রুত যেতে চাই। তারা বলল, আমরা ইন্ডিয়ার ওপর দিয়ে যেতে দিতে পারব না। ইরান/ইরাক হয়ে যেতে হবে। বঙ্গবন্ধু বলল, যেসব দেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক আছে, সেসব দেশ দিয়ে যাব না। দুই/তিন দিন পর এসে তারা বলল, আপনাকে আমরা লন্ডন নিয়ে যাব, সেখান থেকে দেশে যাবেন। বঙ্গবন্ধু তখন বলল, এটা মেনে নাও। আমি বললাম, এটাতে বঙ্গবন্ধু সম্মতি দিয়েছেন, তোমরা ব্যবস্থা কর। তো কয়েক দিনের মধ্যে আমাদের প্লেনের ব্যবস্থা করল। আমাদের বলা হলো, বিদায়ের আগে ভুট্টো এসে তোমাদের সঙ্গে দেখা করবে।
উনি (ভুট্টো) এলেন। বঙ্গবন্ধুকে বললেন, একটু আমাদের সঙ্গে কথা বল। বঙ্গবন্ধু বললেন, তোমাদের সঙ্গে কোনো কথা নাই। আমার কথা হবে বাংলাদেশ যাওয়ার পরে। ভুট্টো বললেন, কিছু সম্পর্ক রাখেন না। বঙ্গবন্ধু বললেন, রাজনৈতিক ব্যাপারে কোনো আলোচনা হবে না। আমি আমার স্বাধীন দেশে ফিরে গেলে তারপর আলোচনা হতে পারে।
ভুট্টো চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে প্রেসের সামনে কোনো কিছু আদায় করে নিতে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সাফ জানিয়ে দেন, কোনো কথা বলব না তোমার সঙ্গে। তারপরও ভুট্টো বার বার বলছিলেন, কিছু একটা সম্পর্ক কী রাখা যায় না? আপনি তো পাকিস্তান বানিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, কোনোভাবেই এইসব নিয়ে কথা বলা সম্ভব না। আগে আমি বাংলাদেশে যাব, তারপর এসব নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
সারাবাংলা: পাকিস্তান থেকে যখন প্লেনে উঠলেন, তখন অনুভূতিটা কেমন ছিল?
ড. কামাল হোসেন: অসাধারণ অনুভূতি। এটা আল্লাহ’র একটা বিশেষ রহমত যে, দ্রুত বাংলাদেশে ফিরে যেতে পারছি। কেননা আমাদের একটা ভয় ছিল- বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ওরা বিলম্বিত করবে। বাংলাদেশে ওদের হাজার হাজার লোক বন্দি ছিল। তাদেরকে মুক্ত করার জন্য বোধ হয় বঙ্গবন্ধুকে ধরে রাখবে কিছু দিন। অবশ্য বঙ্গবন্ধুকে দ্রুত মুক্ত করে তারা বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে। তারা ভাবল- বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ভাল ব্যবহার করে যদি উনাকে দ্রুত পাঠানো যায়, তাহলে ওদের বন্দিদের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু সফট অবস্থান নেবে।
সারাবাংলা: লন্ডন এয়ারপোর্টে নামার পর বঙ্গবন্ধুর ব্যাপারে বাঙালি কমিউনিটি এবং অন্যান্য দেশের লোকদের আগ্রহ কেমন ছিল?
ড. কামাল হোসেন: লন্ডন এয়ারপোর্টে যখন নামি, তখন ব্রিটিশ পুলিশ, যারা ইউনিফর্ম পরে ডিউটি করছিল তারা একটু সামনে এসে চোখে পানি এসে যাওয়ার মতো অবস্থায় বঙ্গবন্ধুকে স্যালুট দিয়ে বলছে- স্যার, উই হ্যাব প্রেইড ফর ইউ। বোঝাই যাচ্ছে পৃথিবীর মানুষের মধ্যে কী ধরনের সহানুভূতি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি ছিল। ব্রিটিশ পুলিশের লোক এভাবে বলছে, তোমার জন্য আমরা প্রার্থনা করেছি এবং সে আনন্দে অশ্রুপাত করছে। আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হলো ক্লারিজেস হোটেলে। হাজার হাজার লোক ক্লারিজেস হোটেলে ভিড় করল বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য।
সারাবাংলা: একজন সরকার প্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে যে রকম মূল্যায়ন ও নিরাপত্তা পাওয়ার কথা, স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সময় বঙ্গবন্ধু কি সেরকম পেয়েছিলেন?
ড. কামাল হোসেন: ওর চেয়ে বেশি কিছু তিনি পেয়েছেন। যেমন ব্রিটিশ পুলিশ ওনাকে আবেগময় হয়ে বলল, তোমার জন্য আমরা প্রার্থনা করেছি। তখন বোঝা গেল বিশ্বব্যাপী আমাদের মুক্তির সংগ্রামের পক্ষে মানুষ কীভাবে সমর্থন দিয়েছে। লন্ডনের হোটেলের বাইরে এতো লোক কখনো জড়ো হয় না। আমাকে বলা হলো- আপনি একটু হোটেলের গেটে থাকবেন। লোকজন চিহ্নিত করে আমরা ছাড়ব। ক্ল্যারিজেস (claridges) হোটেলের বাইরে তখন মানুষের ভিড়। ওখানকার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা লোকেরা বঙ্গবন্ধুকে বললেন, এতো লোকের মধ্যে আপনি যাবেন না। কারণ, নিরাপত্তার ব্যাপার আছে। আপনি জানালা থেকে কথা বলেন। উনি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে সবার সাথে কুশল বিনিময় করলেন।
আমাদের ডেপুটি হাইকমিশনার রেজাউল করিম এরইমধ্যে পৌঁছে গেলেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, দ্রুত ঢাকা যাওয়ার ব্যবস্থা কর। আমরা পাকিস্তানি প্লেনে ঢাকা যাব না। এরইমধ্যে জানানো হলো- ভারত থেকে প্লেন পাঠানোর কথা বলছে। আবার ঢাকা থেকেও একটা প্লেনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। একদিন সময় লাগবে। আমরা বললাম, ঢাকার প্লেনে গেলে সব চেয়ে ভাল হয়। অতঃপর বাংলাদেশ থেকে যেটা গেল, সেটাতে আমরা উঠলাম।
এদিকে কোলকাতা চাচ্ছিল বঙ্গবন্ধু যেন কোলকাতা হয়ে ঢাকায় ফেরেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, আমাকে দিন থাকতে ঢাকা পৌঁছাতে হবে। হিসাব করে দেখা গেল, কোলকাতা ধরলে আর দিনের মধ্যে ঢাকা পৌঁছানো যাবে না। বঙ্গন্ধু বললেন, আমি দিল্লীতে নামব, তারপর ঢাকা যাওয়ার পর দ্রুত আমি কোলকাতায় আসব। উনি কথা রেখেছিলেন। দেশের বাইরে ওনার ফার্স্ট ট্রিপ যেটা হলো সেটা কোলকাতায়।
সারাবাংলা: দিল্লীর সময়টুকু কেমন ছিল?
ড. কামাল হোসেন: বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরার জন্য ছটফট করছিলেন। দিল্লীর এয়ারপোর্ট থেকে আমাদেরকে বলা হলো, আমরা আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি। ওখানে প্রধানমন্ত্রী (ইন্দিরা গান্ধি) আপনাকে রিসিভ করবেন এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আপনাকে ফিরিয়ে আনব। বঙ্গবন্ধু বললেন, ঠিক আছে। কিন্তু আমাদেরকে দিন থাকতে ঢাকায় যেতে হবে— এটা মাথায় রেখ।
এতো ব্যস্ততা, দেশে ফেরার তাড়া। তার মধ্যেও সবচেয়ে ইমপরটেন্ট কথা উনি (বঙ্গবন্ধু) বললেন- মিসেস গান্ধি, আপনি অবশ্যই বাংলাদেশে আসবেন। তবে আমি চাই, ইন্ডিয়ার সব আর্মি ফেরত নেওয়া হোক দ্রুততম সময়ে। তারপর গান্ধি ১৭ মার্চ ঢাকায় এলেন বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে। তার আগেই ইন্ডিয়ার সব আর্মি এখান থেকে সরিয়ে নিলেন তিনি।
সারাবাংলা: বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী প্লেন বাংলাদেশের আকাশসীমায় পৌঁছালে তার অনুভূতিটা কেমন ছিল?
ড. কামাল হোসেন: প্লেন বাংলাদেশের আকাশসীমায় আসার পর খুবই আবেগময় মুহূর্ত সৃষ্টি হল। বঙ্গবন্ধু রীতিমতো দাঁড়িয়ে গেলেন। ওনার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল। ব্যাপারটা ছিল এ রকম- আমরা জীবিত আছি এবং স্বাধীন বাংলাদেশ স্বচক্ষে দেখছি। আসলে ওই সময় যে দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল, সেটা যারা স্বচক্ষে দেখেনি, তাদেরকে বলে বোঝানো যাবে না। আমি বলতে পারি, জীবনে আনন্দময় মুহূর্তের মধ্যে একটা দিনকে যদি চিহ্নিত করতে হয়, সেটা হলো সেই দিন।
সারাবাংলা: ধন্যবাদ আপনাকে।
ড. কামাল হোসেন: আপনাদেরকেও ধন্যবাদ