হৃদয় যার আকাশের মতো বিশাল
১০ জানুয়ারি ২০২০ ১৭:০৮
আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি তাদের কাছে অনেকগুলো তারিখ গুরুত্বপূর্ণ। তবে এর মধ্যে দুটি তারিখ অবিস্মরণীয় উল্লাসের। একটি ১৬ই ডিসেম্বর— যেদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে; আরেকটি ১০ জানুয়ারি— যেদিন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন। যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি কিংবা পৃথিবীর যেসব মানুষ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানে না তারা অবাক হয়ে ভাবতে পারে- একটি দেশের মুক্তি আর একজন মানুষের মুক্তি কেমন সমার্থক হতে পারে? কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু সমার্থক।
যখন এই দেশের যুদ্ধাপরাধীরা সরকারের অংশ ছিল তখন আমি অনেক খাটাখাটুনি করে খুবই ছোট আকারে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখেছিলাম। সেটি আকারে এত ছোট ছিল যে, সেটাকে বই না বলে পুস্তিকা বলা যুক্তিসঙ্গত। উদ্দেশ্য ছিল, এই দেশের নতুন প্রজন্ম যেন কোনো ধরনের বড় প্রস্তুতি ছাড়াই ছোট ইতিহাসটি পড়ে ফেলতে পারে। আমরা খুব আনন্দ নিয়ে লক্ষ্য করছিলাম সত্যি সত্যি আমাদের নতুন প্রজন্মের অনেকেই এই ছোট ইতিহাসটা পড়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্য এক ধরনের আগ্রহ এবং ভালোবাসা অনুভব করেছে। সেই সময় আমি এক ধরনের ছেলেমানুষি কৌতূহল নিয়ে ভেবেছিলাম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যদি আরও ছোট করে লিখতে হয় তাহলে সেটি কেমন দেখাবে? বাইশ পৃষ্ঠায় না হয়ে এক পৃষ্ঠায়? কিংবা আরও ছোট, এক পৃষ্ঠা না হয়ে এক প্যারাগ্রাফে? কিংবা আরও ছোট, এক লাইনে? আমি তখন এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করি, কেউ যদি এক লাইনেও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বর্ণনা করতে চায় সেখানেও বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা লিখতে হবে। সেজন্যে এটি মোটেও অতিরঞ্জিত কোনো বক্তব্য নয় যে, বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু সমার্থক। তাই ১৬ই ডিসেম্বর যখন এই দেশের মাটিতে পৃথিবীর নৃশংসতম সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল তখন আমরা যেরকম উল্লাসে ফেটে পড়েছিলাম, ঠিক একইভাবে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু যখন এই দেশের মাটিতে পা দেন তখনও বাঁধভাঙা আনন্দের বন্যায় আমরা ভেসে গিয়েছিলাম।
দিনটির কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। মুক্তিযুদ্ধের সেই ভয়াবহ দিনগুলোতে এই দেশের অসংখ্য পরিবারের মতো আমরাও সহায়-সম্বল ও আশ্রয়হীন ছিলাম। স্বাধীন বাংলাদেশে বেঁচে থাকার জন্য মা আর ভাইবোন কয়েকজন ছাড়া আমাদের আর কিছু ছিল না। বিচ্ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আমরা সবাই গ্রামের বাড়িতে একত্র হয়েছি। তখন হঠাৎ খবর পাই, বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসছেন। মুহূর্তের মধ্যে আমাদের সব দুর্ভাবনা ও দুশ্চিন্তা কেটে গেল। আমি কল্পনা করতে লাগলাম, তিনি এসে দেশের হাল ধরবেন আর দেখতে আমাদের দেশের সব দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা দূর হয়ে যাবে। সেই সময়ে ইন্টারনেট কল্পনারও বাইরে; টেলিভিশন কেবলমাত্র বিত্তশালীদের বিলাসিতা। ঘরে ঘরে তখন রেডিও ছিল। যুদ্ধের পুরো সময়টাতে মুক্তিযোদ্ধারা যখন মাঠে-ঘাটে, বনে-জঙ্গলে থেকে যুদ্ধ করেছে তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এই দেশের মানুষের বুকে স্বপ্ন জাগিয়ে রেখেছে। যুদ্ধের খবরের পাশাপাশি বজ্রকন্ঠ হিসেবে একটু পর পর বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠস্বর শুনিয়ে গেছে। আর বঙ্গবন্ধু সেই সুদূর পাকিস্তানে কোনো এক জেলখানায় মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। এই দেশে কী হচ্ছে তার কিছুই তিনি জানতে পারেননি। অথচ তার কণ্ঠস্বর শুনিয়ে এই দেশের মানুষকে উজ্জীবিত করা হচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধারা জীবনপণ করে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। তিনি সেটাও জানতেন না।
আমরা সবাই গোল হয়ে ঘিরে বঙ্গবন্ধুর ফিরে আসার সেই মুহূর্তগুলোর ধারা বর্ণনা শুনে রোমাঞ্চিত হয়েছি। মানুষের ভালোবাসা খুব সহজে অনুভব করা যায়। বঙ্গবন্ধু নিশ্চয়ই এই দেশের মানুষের সেই অবিশ্বাস্য অফুরান ভালোবাসা অনুভব করেছিলেন। দেশের মাটিতে পা রেখে তাঁর বুকের ভেতর কেমন অনুভূতি হয়েছিল সেটা আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। দেশকে নিয়ে তাঁর একটি স্বপ্ন ছিল, সেই স্বপ্ন আমাদের ভেতরে সঞ্চারিত হয়েছিল। আমরা এখনও সেই স্বপ্ন দেখে যাচ্ছি। দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা, ষড়যন্ত্র, নিষ্ঠুরতা, ব্যর্থতা, পৈচাশিকতা কোনো কিছুই আমাদের সেই স্বপ্ন কেড়ে নিতে পারেনি। এমনকি কেড়ে নিতে পারবে না।
আমরা সবাই জানি, স্বাধীনতার কয়েক বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল। এই মানুষটি আমার দেশের সমার্থক; তাই বলা যায়, ঘাতকরা এক অর্থে দেশকেও হত্যা করেছিল। এর পর দীর্ঘদিন আমি নিজে দেশের বাইরে ছিলাম। তাই কীভাবে দেশটিতে ধীরে ধীরে পরিবর্তন এসেছিল তা নিজের চোখে দেখতে পারিনি। দূর থেকে খবর পেতাম। ইন্টারনেট ছিল না বলে সে খবরও ভাসা ভাসা। কাজেই খবরের গভীরতা অনুভব করতে পারিনি।
একসময়ে দেশে ফিরে এসে অবাক হয়ে দেখি, যে জামায়াতে ইসলামী স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের জবাই করেছে, তারা এখন এই দেশে প্রকাশ্যে রাজনীতি করে। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার এই দেশ থেকে বঙ্গবন্ধুর শেষ চিহ্নটিও মুছে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। যে বঙ্গবন্ধু আমাদের একটি স্বাধীন দেশে দিয়ে গেছেন রেডিও-টেলিভিশনে সেই বঙ্গবন্ধুর নামটি পর্যন্ত উচ্চারিত হয় না। বাংলাদেশে পাকিস্তানি ক্রিকেটের ভক্ত নতুন একটি প্রজন্মের জন্ম হয়েছে। তারা মুখে পাকিস্তানের পতাকা এঁকে খেলা দেখে, ছোট শিশুরা জানতে চায় স্বাধীনতার ঘোষককে। মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে এর বাইরে তাদের কোনো কৌতূহল নেই।
সবচেয়ে অশ্লীল ব্যাপারটি ঘটে প্রতিবছরের ১৫ই আগস্ট। এদিন বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া মহা ধুমধামে, বিছানা সাইজের কেক কেটে কাল্পনিক জন্মদিন পালন করে। বঙ্গবন্ধুকে শুধু মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে ফেলা নয়, তাঁকে অবজ্ঞা করা হয়, অপমান করা হয় রাষ্ট্রীয়ভাবে। এত বড় দুঃসাহস কেমন করে দেখাতে পারে এই দেশের কিছু মানুষ? কেমন করে এত অকৃতজ্ঞ হতে পারে এই দেশের মাটিতে থাকা, এ দেশের বাতাসে নিঃশ্বাসে নেওয়া কিছু মানুষ? যে রাজনৈতিক দলটির জন্ম হয়েছে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর সেই রাজনৈতিক দলটি কেন বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করতে চায়? কে আমাকে এই প্রশ্নের উত্তর দেবে?
আওয়ামী লীগের পর বিএনপি এই দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল। রাজনৈতিক দল একটি করপোরেশন নয় যে, কিছু দক্ষ মানুষ সেটি করপোরেট কায়দায় চালিয়ে নেবে। সবার আগে তাদের প্রয়োজন কিছু আদর্শের। আমি রাজনীতির খুঁটিনাটি বুঝি না। কিন্তু তারপরেও একটি বিষয় বুঝতে আমার বিন্দুমাত্র সমস্যা হয় না; সেটি হচ্ছে- বাংলাদেশ পঁচাত্তর পরবর্তী সেই ভয়ংকর অমানিশার কাল পার হয়ে এসেছে। এই দেশে কোনো দল রাজনীতি করতে চাইলে এখন তাদের সবার আগে আদর্শের মূল দুটি ভিত্তি গড়ে তুলতে হবে। এর একটি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ, অন্যটি বঙ্গবন্ধু। মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে এবং বঙ্গবন্ধুকে হৃদয়ে ধারণ না করে এই দেশে কেউ আর কোনোদিন রাজনীতি করতে পারবে না। যারা মুক্তিযুদ্ধ আর বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করে তারা এই দেশের আবর্জনা। আবর্জনা দিয়ে আস্তাকুঁড় ভরা যায়, রাজনৈতিক দল তৈরি করা যায় না।
পৃথিবীর খুব বেশি দেশ এককভাবে সেই দেশের স্থপতির নাম বলতে পারবে না। আমাদের সৌভাগ্য, আমরা যেরকম একটি দেশ পেয়েছি, ঠিক সেরকম দেশের একজন স্থপতিও পেয়েছি। এই দেশে সত্যিকারের রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি ক্যান্টনমেন্টে কিছু রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়েছে। সেগুলোরও জন্ম হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর। কাজেই এই দেশে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিতর্ক হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। পাকিস্তান দেশটিকে ভেঙে বাংলাদেশের জন্ম দেওয়াটিকে যদি অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা যায় শুধুমাত্র তাহলেই পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিতর্ক করার চেষ্টা করতে পারে। সেই কাজটিও এখন কঠিন। কারণ পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে সবদিক দিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে। এই পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা এখন কী নিয়ে কথা বলবে?
বঙ্গবন্ধু জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করার জন্য এই দেশে অনেক বড় একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমি খুবই আগ্রহ নিয়ে সেই মুজিববর্ষ দেখার জন্য অপেক্ষা করছি। গালে পাকিস্তানি পতাকা আঁকা নতুন প্রজন্ম কিংবা স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে বিভ্রান্ত শিশু-কিশোর যেন এই দেশে আর কখনও জন্ম না নেয়, সেটিই হতে হবে আমাদের প্রধান লক্ষ্য। এই দেশের নতুন শিশু কিশোরেরা যেন নিজের দেশকে ভালোবাসতে পারে, নিজের দেশকে নিয়ে গর্ব করতে পারে সবার আগে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। তথ্য দিয়ে তাদের ভারাক্রান্ত করার কোনো প্রয়োজন নেই। তাদের হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হবে যে, এই দেশের জন্ম দিয়েছেন যে মানুষটি তার হৃদয় ছিল আকাশের মতো বিশাল। তাদের বোঝাতে হবে, আমাদের কত বড় সৌভাগ্য যে, এই দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো বিশাল হৃদয়ের মানুষটির জন্ম হয়েছিল।
তা না হলে কী হতো?
লেখক: অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন মুজিববর্ষ মুহম্মদ জাফর ইকবাল