ইউক্রেনের বিমান বিধ্বস্ত: ‘ভুল’ আর ‘অপরাধ’ তো এক নয়
১১ জানুয়ারি ২০২০ ১৮:১৬
কিছুদিন আগে পাকিস্তানি সামরিক হেলিকপ্টার ভেবে ভারতের সেনারা কাশ্মীর সীমান্তের কাছে নিজেদেরই একটি হেলিকপ্টার ভূপাতিত করেছে। এটা নিতান্তই ভুল। সেজন্য ভারতের সংশ্লিষ্ট কয়েকজন সেনাকে বিচারে আওতায় আনা হয়েছে বলে গণমাধ্যমের খবর থেকে আমরা জানতে পেরেছি।
আফগানিস্তানে বহুবার বিয়ে বাড়ি ও বেসামরিক স্থাপনায় বিমান হামলা চালিয়ে আমেরিকা বহু বেসামরিক নাগরিক হত্যা করেছে এবং বলেছে ভুল হয়ে গেছে! আফগানিস্তান ও ইরাকে বহুবার ফ্রেন্ডলি ফায়ার করেছে এবং বহু সেনা মারা গেছে। কিন্তু আমেরিকা বলেছে নিতান্তই ভুল। সিরিয়ায় উগ্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দায়েশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে আমেরিকার বিমানগুলো ‘ভুল করে’ বার বার শুধু সিরিয়ার সেনা এবং সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনায় হামলা করেছে।
মনে রাখতে হবে- অপরাধ আর ভুল এক জিনিস নয়। ইরান যে ইউক্রেনের বিমান ভুল করে ভূপাতিত করেছে তা স্বীকার করেছে। কিন্তু এটি ঠিক যে, অনেকে তা স্বীকারও করে না। যেমন ইউক্রেন ও রাশিয়া সীমান্তের কাছে ইউক্রেনের একটি বিমান সম্ভবত ২০১৬ সালে ভূপাতিত হয়। এ নিয়ে দীর্ঘ তদন্ত হয়েছে। আমেরিকা ও পশ্চিমারা এজন্য রাশিয়াকে দোষারোপ করে আর রাশিয়া দোষারোপ করে আমেরিকাকে। প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছে তা জানা যায়নি। সত্য অজানাই থেকে গেছে।
শুধু কী তাই? পারস্য উপসাগরের আকাশে ইরানের যাত্রীবাহী বিমান ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ে ভূপাতিত করেছিল আমেরিকা। ১৯৮৮ সালের ৩ জুলাই মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস ভিনসেন্স থেকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে ধ্বংস করা হয় ইরানি যাত্রীবাহী বিমান। নিহত হয় বিমানটির ৬৬ শিশুসহ ২৯০ জন আরোহীর সবাই। এটি আমেরিকার ভুল ছিল না। সেটা ছিল ইচ্ছা করে যাত্রীবাহী বিমান ধ্বংস করা। পারস্য উপসাগরে ইরানের যাত্রীবাহী বিমানে প্রকাশ্যে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে আমেরিকা বলেছিল, তারা সেটাকে ‘যুদ্ধবিমান’ মনে করেছিল। তার মানে একই রকমের ‘ভুল’। ইরানের যাত্রীবাহী বিমান ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ভূপাতিত করার পর ৩২ বছর পেরিয়ে গেলেও আজ পর্যন্ত আমেরিকা ওই ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেনি বা ক্ষমা চায়নি। এমনকি ওই ঘটনায় মার্কিন সরকার ইউএসএস ভিনসেন্সের কমান্ডার উইলিয়াম রজার্সকে পদক দিয়ে পুরস্কৃত করেছিল। তবে আন্তর্জাতিক সমাজ আমেরিকার ওই পদক্ষেপের নিন্দা জানায় এবং সেটাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ বলে অভিহিত করে।
এমন ঘটনা আরও আছে। ১৯৮৭ সালে ইউএসএস স্টার্ক নামে একটি আমেরিকান যুদ্ধজাহাজের ওপর অ্যাক্সোস্যাট মিসাইল হামলা হয়েছিল, যা চালিয়েছিল ইরাক। সে হামলায় ৩৭ জন মার্কিন নাবিক নিহত এবং ২১ জন আহত হয়। অথচ ইরাক ও আমেরিকা তখন ঘনিষ্ঠ মিত্র। ইরানের বিরুদ্ধে ইরাক সে সময় যে যুদ্ধ করছিল তা মূলত আমেরিকারই যুদ্ধ ছিল। তারপরও ইরাক ‘ভুল করে’ ওই হামলা চালায়।
ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল স্টাফ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, গত সপ্তাহে তেহরানের অদূরে ইউক্রেনের যে যাত্রীবাহী বিমানটি ভূপাতিত হয়েছে সেটি স্পর্শকাতর সামরিক স্থাপনার নিকটবর্তী হওয়ায় শত্রুর জঙ্গিবিমান ভেবে সেটিতে গুলি চালানো হয়েছে। শনিবার (১১ জানুয়ারি) সকালে এক বিবৃতিতে জেনারেল স্টাফ এ তথ্য জানিয়েছেন। বিবৃতিতে এ ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করার পাশাপাশি নিহতদের পরিবারবর্গের কাছে ক্ষমা চাওয়া হয়েছে।
গত বুধবার (৮ জানুয়ারি) ভোররাতে ইউক্রেনের যাত্রীবাহী একটি বিমান তেহরানের ইমাম খোমেনি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পরই বিধ্বস্ত হয়। এ ঘটনায় বিমানের ১৭৬ আরোহীর সবাই নিহত হন। এই ১৭৬ জনের মধ্যে ১১৭ জনই ছিলেন ইরানি যাদের অনেকের কানাডা ও ব্রিটেনের নাগরিকত্ব ছিল। এছাড়া, বিমানটিতে কানাডা, ব্রিটেন, আফগানিস্তান ও সুইডেনের যাত্রীরা ছিলেন। ইউক্রেন এয়ারলাইন্সের বিমানটির কিয়েভ হয়ে কানাডা যাওয়ার কথা ছিল। গত দুদিন ধরে ইরানি সশস্ত্র বাহিনীর নিবিড় তদন্ত শেষে ১১ জানুয়ারি এ বিবৃতি প্রকাশ করা হয়।
ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল স্টাফের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গত ৩ জানুয়ারি বাগদাদে মার্কিন সন্ত্রাসী হামলায় ইরানের কুদস ফোর্সের কমান্ডার মেজর জেনারেল কাসেম সোলাইমানি নিহত হওয়ার পর তেহরানের সম্ভাব্য প্রতিশোধমূলক হামলাকে বিবেচনায় নিয়ে মার্কিন বিমানবাহিনীর তৎপরতা ভীষণভাবে বেড়ে যায়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও সশস্ত্রবাহিনী ইরানের অভ্যন্তরে বহু সামরিক ও বেসামরিক স্থাপনায় হামলা চালানোর হুমকি দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থা গ্রহণ করে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বুধবার মধ্যরাতের পরপরই ইরাকে মার্কিন বাহিনীর ঘাঁটি আইন আল-আসাদে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করার পর ইরানের আকাশসীমার আশপাশে মার্কিন জঙ্গিবিমানের আনাগোনা হঠাৎ করে বেড়ে যায়। এ সময় ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার রাডারগুলোতে অসংখ্য শত্রু বিমান ধরা পড়ে। এ অবস্থায় ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা পরিচালনাকারী সৈন্যরা অত্যন্ত স্পর্শকাতরতার সঙ্গে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন।
ইরানের সশস্ত্রবাহিনীর জেনারেল স্টাফের বিবৃতিতে আরও বলা হয়, এ রকম একটি সংকটময় ও স্পর্শকাতর মুহূর্তে ইউক্রেনের ৭৫২ ফ্লাইটটি ইমাম খোমেনি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আকাশে উড্ডয়ন করে এবং টার্ন নেওয়ার সময় ইসলামি বিপ্লবী গার্ডবাহিনী বা আইআরজিসি’র একটি সামরিক স্থাপনার আকাশে চলে আসে। এ সময় রাডারে বিমানটিকে শত্রুর বিমান বলে প্রতীয়মান হয় এবং মানবীয় ত্রুটির কারণে সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃতভাবে বিমানটিতে গুলি চালানো হয়।
বিবৃতিতে এ ঘটনায় গভীর দুঃখ ও শোক প্রকাশ করার পাশাপাশি নিহতদের পরিবারবর্গের কাছে ক্ষমা চাওয়া হয়। সেইসঙ্গে এই নিশ্চয়তা দেওয়া হয় যে, যেসব কারণে এই মানবীয় ভুল হয়েছে সেসব কারণ অনুসন্ধান ও অপসারণের মাধ্যমে ভবিষ্যতে এ ধরনের ভুলের পুনরাবৃত্তি কঠোরভাবে রোধ করা হবে। সেইসঙ্গে এ ধরনের দুঃখজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ভুল হয় মানুষের। ইরানের এমন ভুলের জন্য আমাদেরও দুঃখিত হওয়ার কারণ আছে। এমন ভুলের কারণে অনেকগুলো প্রাণ ঝরে গেল। বিধ্বস্ত বিমানে ইরানেরই নাগরিক বেশি ছিল। তবে একথাও ঠিক যে, এই বিমান ভূপাতিত করে ইরান কারও ওপর প্রতিশোধ নিতে চায়নি। ফলে এ নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত তর্ক-বিতর্ক করাটা উচিত নয় বলে মনে করি। ইরানের এই ঘটনাটিকে যারা অপরাধ বলতে চান, তাদের সঙ্গে সবিনয়ে দ্বিমত করব। ভুল আর অপরাধ তো এক নয়।
লেখক: রেডিও তেহরানের সাংবাদিক