‘ছোঁয়াচে রোগের মতো ছড়িয়ে পড়ছে ধর্ষক মানসিকতা’
১৩ জানুয়ারি ২০২০ ০৮:০০
ঢাকা: গত ৯ জানুয়ারি রাতে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর এলাকায় গণধর্ষণের শিকার হয় ১৩ বছরের এক কিশোরী। পরেরদিন ভোরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করা হয়। ওই রাতেই ভাটারা এলাকায় ধর্ষণের শিকার হয় (১২) বছরের এক শিশু। এর পরের দিন ১০ জানুয়ারি (শুক্রবার) রাতে রাজধানীর রামপুরায় একই ব্যক্তির দ্বারা ধর্ষণের শিকার হন দুই কর্মজীবী নারী, যাদের বয়স ১৮ ও ১৯ বছর। শনিবার ভোরে এই দু’জনকে ঢামেক ওসিসিতে ভর্তি করা হয়।
এর আগে, ৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায় কুর্মিটোলায় ধর্ষণের শিকার হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী, তাকে ওই রাতেই ভর্তি করা হয় ঢামেক ওসিসিতে। এরও আগে, ১ জানুয়ারি সবুজবাগে ধর্ষণের শিকার হয় এক শিশু। গেল ৪ জানুয়ারি এই শিশুটিকেও ঢামেক ওসিসিতে ভর্তি করা হয়।
পরিসংখ্যান বলছে, সব মিলিয়ে নতুন বছরের প্রথম মাসের প্রথম ১১ দিনেই ঢামেক হাসপাতালের ওসিসিতে ভর্তি হয়েছে ধর্ষণের শিকার মোট ১৩ জন, এদের বেশিরভাগই শিশু ও কিশোরী। এ প্রতিবেদন লেখার সময় রোববার (১২ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় নরসিংদীতে ধর্ষণের শিকার তৃতীয় শ্রেণির এক শিশুকেও নিয়ে আসা হচ্ছিল ঢামেক ওসিসিতে।
বেসরকারি সংগঠন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের (এমজিএফ) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ৯০২টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর আগের বছর ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩৫৬। অর্থাৎ এক বছরে শিশু ধর্ষণ বেড়েছে আড়াই গুণ। অন্যদিকে, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য বলছে, গত বছর ১০ মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১ হাজার ২৫৩ জন নারী-শিশু, এর মধ্যে ১০৬টি শিশুর বয়স ছয় বছরের নিচে।
এ পরিস্থিতিতে সারাদেশে নারী-শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যা এক ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে বলে মনে করছেন মানবাধিকারকর্মী ও সমাজবিজ্ঞানীরা। প্রতিদিন শিশু ও নারী ধর্ষণের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া পেছনে বিচারহীনতার সংস্কৃতি আর সমাজের অবক্ষয়ের ধারাবাহিকতার কুফলই দায়ী বলে মনে করেন দেশের আইনবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীরা।
অন্যদিকে, মনোবিজ্ঞানীদের মতে, সমাজে ছোঁয়াচে রোগের মতো ছড়িয়ে পড়ছে ধর্ষক মানসিকতা। এ অবস্থায় সরকারকে দায়িত্ব নিয়ে শুধু ধর্ষণবিরোধী সচেতনতা বাড়ালেই চলবে না, একইসঙ্গে নাগরিকদের সততা আর নৈতিকতার শিক্ষাও দিতে হবে।
বেসরকারি সংগঠন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের (এমজিএফ) চাইল্ড প্রোটেকশন কো-অর্ডিনেটর রাফিজা শাহীন সারাবাংলাকে বলেন, ২০১৯ সালে ৯০২টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর আগের বছর এই সংখ্যা ছিল ৩৫৬ জন। ২০১৯ সালে ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুরা সবচেয়ে বেশি ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। তাদের সংখ্যা মোট শিশু ধর্ষণের শতকরা ৪৮ ভাগ। শিশু ধর্ষণের হারে দ্বিতীয় পর্যায়ে আছে ৭ থেকে ১২ বছরের শিশু, যারা মোট সংখ্যার শতকরা ৩৯ ভাগ।
রাফিজা শাহীন বলেন, এসব শিশু-কিশোরীদের বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে, চকলেট বা খাবারের লোভ দেখিয়ে, ভয় দেখিয়ে, মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে ও ঘরে একা পেয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে।
সংগঠনটির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে সবচেয়ে বেশি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে ঢাকা জেলায়। এরপর আছে নারায়ণগঞ্জ ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ময়মনসিংহ ও কুমিল্লা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মাহবুব উদ্দিন বলেন, সমাজের অবক্ষয়ের ধারাবাহিকতার কুফল হলো প্রতিদিন শিশু ওে নারী ধর্ষণের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া। এটি দায়িত্বশীল মানুষদের দায়িত্বহীনতার ফলাফল। আমাদের শিশু-কিশোরদের ওপর এই ধর্ষণের ঘটনা বেশি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
এই শিক্ষক বলেন, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষ বেশি ধর্ষণের শিকার হয়ে থাকে। বাবা-মায়ের অনুপস্থিতিতে শিশুদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে কেউ না থাকায় সাধারণত ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। আমাদের চিন্তা-চেতনায় অন্যের দায়িত্ব নেওয়ার মানসিকতা ও সততা কমে যাওয়ায় এমন ঘটনা বাড়ছে। দুর্বলের প্রতি আগ্রাসী মনোভাবের কারণে গৃহকর্মী ও কর্মজীবী নারীরা আক্রান্ত হচ্ছেন। ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার জন্য বিচারহীনতার সংস্কৃতিও এখন বড় একটি কারণ। ধর্ষণের ঘটনায় আদালতে বিচার হতে হবে, বাইরে মিটমাট করা যাবে না। বিচারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারলে ধর্ষণ কমবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল ও কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের শিক্ষক ড. মেহতাব খানম বলেন, ধর্ষক মানসিকতা সমাজের ভেতর সংক্রমিত হচ্ছে। এটি অনেকটা ছোঁয়াচে রোগের মতো করে ছড়াচ্ছে। সরকার যদি সচেতন না হয়, বিচারের সংস্কৃতি যদি তৈরি না হয়, তাহলে এমন ঘটনা আরও বাড়বে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় একজন ধর্ষককে দেখে আরও অনেকে ধর্ষণ করতে উৎসাহিত হয়। এ ঘটনাকে তারা অপরাধ হিসেবে দেখে না। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য পরিবার ও প্রাথমিক পর্যায় থেকে শিশুদের শিক্ষা দিতে হবে। সরকারকে দায়িত্ব নিয়ে ধর্ষণবিরোধী সচেতনতা বাড়াতে হবে।
এ বিষয়ে মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি আাডভোকেট ফাওজিয়া করিম সারাবাংলাকে বলেন, এর জন্য বিচারহীনতার সংস্কৃতি অবশ্যই দায়ী। কিন্তু তা একমাত্র কারণ নয়। আমরা এখন দেশেকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করতে ব্যস্ত। বাস্তবমুখী শিক্ষা কার্যক্রমসহ অন্য বিষয়গুলোতে নজর কম দিচ্ছি। একজন নাগরিককে যদি সামাজিক চেতনা, ন্যায়-নীতি, সততা আর মূল্যবোধ শিখিয়ে বড় করা না হয়, তবে এমন সমস্যা বাড়তেই থাকবে।
এই মানবাধিকারকর্মী বলেন, কোনো সমাজ বা রাষ্ট্র থেকে যদি ‘ডেমোক্রেসি’ হারিয়ে যায়, নাগরিকরা তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, সেসব রাষ্ট্রে ধর্ষণের মতো ঘটনা বাড়ে। সেখানে নাগরিকরা যত সোচ্চারই হোক, এমন অপরাধ ঠেকানো তখন কঠিন হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রকে তাই এ ধরনের শূন্যতা তৈরি থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
আরেক মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভেঅকেট এলিনা খান বলেন, সরকারি নানা পদক্ষেপ সত্ত্বেও একটি শিশুবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছি আমরা। ফলে আমাদের শিশুরা একটি চরম অনিরাপদ অবস্থায় রয়েছে। বিশেষ করে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল অবস্থায় থাকা শিশুরা ও পথশিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে রয়েছে।
তিনি বলেন, শিশুদের রক্ষা করার জন্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি ও সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উদ্যোগে পাড়ায় পাড়ায় শিশু সুরক্ষা কেন্দ্র তৈরি করতে হবে।