ব্যাংক চলছে ‘কসমেটিক সার্জারি’তে!
১৪ জানুয়ারি ২০২০ ১৭:১৫
ঢাকা: সম্প্রতি একটি ব্যাংক থেকে একজন প্রভাবশালী গ্রাহককে ১২শ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু গ্রাহক আর তা ফেরত দিতে পারবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ ওই ১২শ কোটি টাকা এখন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ। এদিকে, দুর্নাম ঠেকাতে ওই ব্যাংক খেলাপি বা মন্দ এই ঋণকে কাগজে না দেখিয়ে উল্টো পুনঃতফসিল (বিশেষ সুবিধা, ব্যাংকের কাগজে-কলমে ঠিক রাখা) করে দিচ্ছে।
ঋণ নেওয়ার সময় ওই গ্রাহকের আটশ কোটি টাকার সম্পদ দেখানো হয়েছে। ঋণের অর্থ ফেরত না পেয়ে ব্যাংক তখন ওই টাকার সঙ্গে আরও চারশ কোটি টাকা যোগ করে (প্রভিশন হিসেবে রেখে) মোট সম্পদ দেখানো হচ্ছে ১২শ কোটি টাকা। আর এর মধ্য থেকে নির্দিষ্ট একটি পরিমাণ সরকারকে দেওয়া হচ্ছে ট্যাক্স হিসেবে। আর বাকি অর্থ পরিশোধিত মূলধন হিসেবে নিজেদের কাছে রাখছে ব্যাংক।
আর্থিক খাত সংশ্লিষ্টরা এমন পরিস্থিতিকে এই মুহূর্তে দুর্বল ব্যাংক ব্যবস্থাপনার ভয়াবহ চিত্র বলে আখ্যা দিচ্ছেন। তাদের মতে, এভাবে টাকা বের হয়ে যাওয়ায় একের পর এক দুর্বল হয়ে যাচ্ছে ব্যাংকগুলো। আমানতকারীরা ঝুঁকিতে পড়ছেন। সুদের হার বেশি হওয়ায় সত্যিকারের ব্যবসায়ীরা একদিকে চিৎকার করে যাচ্ছেন, অন্যদিকে সরকার বারবার বলেও ব্যাংকগুলোকে এক অঙ্কের সুদের হার চালু করাতে পারছে না। টাকা না থাকায় ব্যাংকগুলো এখন দোটানায় পড়ে গেছে।
সবচেয়ে অসহায় অবস্থায় আছেন আমানতকারীরা। ব্যাংকে তাদের রাখা অর্থেই ৮৫ শতাংশ বিনিয়োগ করে ব্যাংকগুলো। কিন্তু ব্যাংকের দেওয়া ঋণ খেলাপি হয়ে গেলে উভয় সংকটে পড়া ব্যাংকগুলো কূল না শ্যাম রাখার মতো অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। আমানতকারী, সরকার, প্রভাবশালী ব্যবসায়ী— কার কথা শুনবে ব্যাংক?
আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে বিভিন্ন সময়েই বাংলাদেশ ব্যাংক গাইডলাইন তৈরির চেষ্টা করেছে। সর্বশেষ গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘একীভূতকরণ আইন’ নামে একটি আইনের খসড়া করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। এই আইনের একটি বিশেষ ধারায় বলা হয়েছে, যেসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫ শতাংশের বেশি, তাদের অন্য শক্তিশালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত (মার্জ) করে দেওয়া হবে। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে নিতে বাধ্য করা হবে শক্তিশালী ব্যাংকগুলোকে।
সরকার যদি ব্যাংক একীভূতকরণের সিদ্ধান্তে যায়, সেটি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল তো বটেই, বাংলাদেশের জন্যও নতুন কোনো উদাহরণ হবে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই বিভিন্ন সময়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে একীভূত করার নজির রয়েছে। ভারত সরকারও সম্প্রতি ২৭টি বড় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংককে একীভূত করে ১২টিতে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করছে।
এদিকে, ২০০৯ সালে সরকারি খাতের দু’টি বিশেষায়িত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা ও বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক একীভূত করে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল) গঠন করে সরকার। এরপর দেশের কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান এ পথে হাঁটেনি।
এছাড়া, গত বছরের জুলাই মাসে প্রথমবারের মতো আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে না পারায় অবসায়ন (লিকুইডেশন) করা হয় ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড। এর ফলে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। দায়দেনা শোধ করতে গঠন করা হয় দীর্ঘমেয়াদি স্কিম। কার্যক্রম শুরুর ২২ বছরের মধ্যে এ আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে অবসায়নে পাঠায় সরকার। যদিও প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক, দেখভালের দায়িত্বও ছিল এ সংস্থার। তদারকি দুর্বলতা ও পরিচালকদের অনিয়মের কারণে প্রতিষ্ঠানটি মূলত দেউলিয়া হয়ে যায়।
এমন অবস্থা আরও কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানেরও। বলা হচ্ছে, এই মুহূর্তে অন্তত ছয়টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। ব্যাংকসহ এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের একীভূতকরণ প্রক্রিয়া তাই পরিস্থিতি উত্তরণের শতভাগ গ্যারান্টি না দিলেও আশার আলো সঞ্চার করতে পারে এই খাতে। যদিও এ বিষয়েও এখনো সুনির্দিষ্ট রূপরেখা তৈরি করতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এখনো তাদের কাছে কোনো আপডেট আসেনি। কারণ মার্জার করার ক্ষেত্রে ব্যাংক পরিচালনা বা ব্যবস্থাপনা কেমন হবে, সেসব যাচাই-বাছাই করার দরকার আছে। এগুলো কিছুটা সময়সাপেক্ষ বিষয়। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এখনো এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা আসেনি।
কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, ব্যাংক একীভূতকরণ আইন বাস্তবায়ন হলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়াসহ নানা চাপ তৈরি হতে পারে। বিশেষ করে নাজুক অবস্থায় থাকা যে তিনটি ইসলামি ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে, সেগুলো কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হয়ে গেলে তৈরি হবে নতুন সমস্যা। কারণ ইসলামি ব্যাংক ব্যবস্থায় বলা আছে, আমানতকারীরাও এই ব্যাংকের শেয়ার হোল্ডার। ব্যাংক লাভজনক হলে আমানতকারীরা লাভজনক হবেন। ব্যাংক বন্ধ হলে তাও আমানতকারীদের মেনে নিতে হবে।
এ তো গেল একদিকের চিত্র। অন্যদিকে সরকার ছয় মাসের মাথায় ব্যাংক থেকে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি ঋণ নিয়ে ফেলেছে। বাজেট ঘাটতি মেটাতে প্রতিবছরের বাজেটে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণের ব্যবস্থা রাখে সরকার। এর মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকেই নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা থাকে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এই অর্থবছরের মাত্র ছয় মাসের মাথায় পুরো বছরের লক্ষ্যমাত্রাও ছাড়িয়ে গেছে সরকারের। ৪৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার জায়গায় দু’দিন আগে সরকারের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ ছিল ৪৯ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
ব্যাংক খাতে ব্যাপক গুঞ্জন আছে, ব্যাংক মালিক বা পরিচালনা বোর্ডের সঙ্গে বড় ব্যবসায়ীদের ভালো সম্পর্কের কারণে বড় অঙ্কের ঋণ নেওয়া সহজ হয়। এসব ব্যবসায়ীরা একদিকে ঋণখেলাপি হন, অন্যদিকে ব্যাংকের সাহায্যেই আমদানি বা রফতানির মাধ্যমে বিদেশে পাচার হচ্ছে টাকা।
২০১৮ সালে হোটেল সোনারগাঁওয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক, ব্যাংক মালিক, ব্যবসায়ী ও সরকারের মধ্যে এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল সুদের হার এক অঙ্কে আনার। সম্প্রতি আবারও অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, আসছে এপ্রিল থেকে ব্যাংকের সুদের হার এক অঙ্কে আনা হবে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত এ নিয়ে ব্যাংক পাড়ায় কোনো তোড়জোড় নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও কিছু বলা হয়নি। অথচ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সুদের হারের কথা বলে উল্টো সরকারের কাছ থেকে সুবিধা নিয়েছেন ব্যাংক মালিকরা।
এসব বিষয়ে কথা হয় মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রথমত, রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে। কারও নির্দেশনায় কাজ না করে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বসে বা সম্ভব হলে একটি কমিটি করে দিয়ে কিভাবে চললে ব্যাংকের ভালো হবে, তা দেখা প্রয়োজন। হলিস্টিক্যালি চিন্তা করতে হবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সুশাসন যদি একসঙ্গে কাজ করতে পারে, তবেই কেবল ব্যাংক খাতকে টেনে তোলা সম্ভব। থিংস ক্যান বি ডিফরেন্ট।
ব্যাংকের এরকম বাস্তবতায় বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনোমিস্ট জাহিদ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, এক অর্থে বলা যায় যে কসমেটিক সার্জারিতে চলছে ব্যাংক খাত। যে অসুখের জন্য যে ওষুধ দরকার, তা না দিয়ে সব রোগের জন্যই প্যারাসিটামল দেওয়ায় সবই উল্টো পথে যাচ্ছে। ফলে ভেতরের সঙ্গে বাইরের আর কোনো সম্পর্ক নেই।
জাহিদ হোসেন আরও বলছেন, বছর দুই আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সরকার ও ব্যবসায়ীরা মিলে ঋণখেলাপি বা সুদের হার কমানোর কথা বললেও সে নিয়ে কোনো প্রক্রিয়াই শুরু হয়নি এখনো। কৃত্রিমভাবে সবকিছু ব্যবস্থাপনার চেষ্টা চলছে। সবকিছুই যেন উল্টো পথে চলছে।
যদিও খেলাপি ঋণ উদ্ধার বা সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে সরকারি পদক্ষেপে সাফল্যের নজির কম নেই। নেপাল ও শ্রীলংকার মতো দেশও গত বছর ঋণখেলাপিদের অন্তত আটটি সুবিধা বাতিল করে। খেলাপিদের বিদেশ যাওয়ার ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। দেশ দু’টির এমন কিছু পদক্ষেপে খেলাপি ঋণের প্রায় পুরো টাকাই ফেরত গেছে ব্যাংকের কাছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলছেন, ব্যাংক এখন চরম সংকটময় সময় পার করছে। প্রথম থেকে যে সমস্যাগুলোর সমাধান করা দরকার ছিল, ধারাবাহিকভাবেই সেসবের আর সমাধান হয়নি। এ কারণে আজকে ব্যাংকের সংকট তীব্রতর হয়েছে। এই সংকটকে উৎড়ানোর জন্য সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক মিলে দ্রুত যদি ফলপ্রসূ সিদ্ধান্তে না আসে, তাহলে ভবিষ্যৎ আরও খারাপ হবে।