Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানি হামলা: আসল সত্য কোনটি?


১৮ জানুয়ারি ২০২০ ১৮:১৮

গত সপ্তাহে ইরাকের মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় আহত হয়েছে ১১ মার্কিন সেনা। ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি এমন একটি খবর দিয়েছে। তবে ভিন্ন একটি সূত্র থেকে যে তথ্য পাওয়া গেছে তা রীতিমতো ভয়াবহ। যদিও সে তথ্য অস্বীকার করা হচ্ছে। কিন্তু প্রকাশিত ছবি ও ভিডিওতে যা দেখা গেছে তাতে আঁচ করা যাচ্ছে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রগুলো মার্কিন বাহিনীর কতটা ক্ষয়ক্ষতি করেছে!

ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা সম্পর্কে এরই মধ্যে ইরাকের দুই সংসদ সদস্য মন্তব্য করেছেন। সংসদ সদস্য নাঈম আল-আবুদি লেবাননের আল-মায়াদিন টেলিভিশন চ্যানেলকে জানিয়েছেন, ‘ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় আইন আল-আসাদ ঘাঁটির মার্কিন অংশ সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়েছে।’ আল-মায়াদিন টেলিভিশন জানিয়েছে, ‘ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর মার্কিন সেনারা ইরাকি সেনাদের সেখানে যেতে বাধা দিয়েছে।’ হাসান সালেম নামে ইরাকের আরেকজন সংসদ সদস্য আল-ফোরাত টিভি নেটওয়ার্ককে জানিয়েছেন, ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা অনেকটা ভূমিকম্পের মতো মনে হচ্ছিল। হামলায় মার্কিন সামরিক ঘাঁটির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং বহু মার্কিন সেনা হতাহত হয়েছে। হতাহত সেনাদেরকে ইসরাইলে নেওয়া হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

মজার ব্যাপার হচ্ছে- হামলার পরপরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষয়ক্ষতির কথা অস্বীকার করে টুইটারে বলেছিলেন, ‘All is well! Missiles launched from Iran at two military bases located in Iraq. Assessment of casualties & damages taking place now. So far, so good! We have the most powerful and well equipped military anywhere in the world, by far! I will be making a statement tomorrow morning.’ অর্থাৎ ‘সবকিছু ঠিক আছে। ইরাকে দুটি ঘাঁটি লক্ষ্য করে ইরান ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহতের বিষয়টি নির্ধারণের চেষ্টা চলছে। এখন পর্যন্ত সবকিছু ঠিক আছে। বিশ্বের মধ্যে আমাদেরই আছে সবচেয়ে শক্তিশালী ও অস্ত্রসজ্জিত সামরিকবাহিনী। আগামীকাল সকালে আমি একটি বিবৃতি দেবো।’ ট্রাম্প এই টুইটার বার্তা দেওয়ার পরদিন সংবাদ সম্মেলনে জানান, কোনো হতাতের ঘটনা ঘটেনি ও ঘাঁটির তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। তিনি ইরানের যে ৫২টি স্থানে হামলার হুমকি দিয়েছিলেন তা থেকে সরে গিয়ে ইরানের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞার হুমকি দেন।

বিজ্ঞাপন

ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ডবাহিনী বা আইআরজিসি’র কুদস ফোর্সের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার বদলা নিতে ইরান গত ৮ জানুয়ারি দুটি মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। হামলার ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে ট্রাম্প যা হোক কিছু বলেছেন; কিন্তু পেন্টাগনের মুখ একেবারে কুলুপ আঁটা ছিল। এ অবস্থায় মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের বরাত দিয়ে শেষ পর্যন্ত বার্তা সংস্থা এএফপি ১৬ জানুয়ারি জানিয়েছে, হামলায় অন্তত আমেরিকার ১১ সেনা আহত হয়েছে। এ দিনই আরেকটা খবর বের হয় যে, মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি কমিটির চেয়ারম্যান মি. বেনি জি. থম্পসন পেন্টাগনের ডিপার্টমেন্ট অব ডিফেন্সের ফ্রিডম অব ইনফরমেশন অ্যাক্ট পলিসির (DoD FOIA Policy) আওতায় ইরানি হামলায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানতে চেয়েছিলেন। এ বিভাগের প্রধান মি. জেমস পি হোগান তথ্য জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন। তাতে ইরাকে অবস্থিত আইন আল-আসাদ মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সার্বিক ক্ষয়ক্ষতির তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। পেন্টাগনের ডিপার্টমেন্ট অব ডিফেন্সের স্পেশাল ইনভেস্টিগেটিভ টিমের তদন্তের আলোকে সার্বিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এরকম-
১. মোট হতাহত ২৮৫ জন (নিহত: ১৩৯ জন, আহত: ১৪৬ জন)
২. ১টি ব্ল্যাক হক গানশিপসহ ১৫টি হেলিকপ্টার ধ্বংস
৩. ২টি মিলিটারি কার্গোবিমান ধ্বংস
৪. ৩টি MQ-1 প্রিডেটর ড্রোন ধ্বংস
৫. বেইস কমান্ড সেন্টার ধ্বংস
৬. ৩টি হ্যাঙ্গার ধ্বংস
৭. ৩টি ব্যারাক ধ্বংস
৮. ১০টি সেনাছাউনি ধ্বংস
৯. এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল টাওয়ারের ক্ষয়ক্ষতি
১০. রানওয়ের ক্ষয়ক্ষতি, যা আগামী ১৫ দিন ব্যবহারের অযোগ্য থাকবে।

তবে ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের এক খবরে বলা হয়েছে, বেনি জি. থম্পসন ফাঁস হওয়া এ খবরকে ফেইক বা ভুয়া বলেছেন। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের তথ্য সম্পর্কে কিছুই জানি না। কিন্তু ধারণা করছি, ফাঁস হওয়া এই তথ্য হালকা করার জন্য এএফপি মাত্র এই ১১ জনের আহত হওয়ার খবর দিল। বিশ্বাস করি, এক সময় ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় মার্কিনবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতির পুরো চিত্র প্রকাশ করা হবে। তবে তা হয়ত আজই নয়, হয়ত ১০ বছর পরেও নয়। আরও পরে, হতে পারে ৫০ বছর পরে। এমন অনেক তথ্যই তারা নিরাপদ সময়ে প্রকাশ করেছে এবং এজন্য ৩০, ৪০ কিংবা ৫০ বছর সময় নিয়েছে।’

এএফপি যে খবর প্রকাশ করেছে তাতে মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের মুখপাত্র ক্যাপ্টেন বিল আরবান জানান, ৮ জানুয়ারি ইরান ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় তাতে কোনো মার্কিন সেনা নিহত হয়নি; কয়েকজন শুধু আহত হয়েছে। ওই হামলার সময় বিমান ঘাঁটিতে অবস্থান করছিল ১৫০০ মার্কিন সেনা সদস্য। তিনি দাবি করেন, ঊর্ধ্বতনদের কাছ থেকে আগেভাগে সতর্ক বার্তা পাওয়ার পর সেনারা বাংকারে অবস্থান নিয়েছিল। ওই হামলায় সামরিক সরঞ্জামাদির বড়ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এদিকে, ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পরই প্রকাশিত কোনো কোনো প্রচার মাধ্যমের খবরে অন্তত ৮০ মার্কিন সেনা নিহত এবং ২০০ আহত হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। মনে রাখতে হবে, ইরানের কোনো ক্ষেপণাস্ত্রকেই ঠেকাতে পারেনি মার্কিন সেনারা। এছাড়া আইন আল-আসাদ ঘাঁটিতে হামলার তীব্রতা এতটাই বেশি ছিল যে, ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি দুদিন আগে মন্তব্য করেছে, হামলার সময় মার্কিন ঘাঁটির যোগাযোগ ব্যবস্থা পুরোপুরি বিধ্বস্ত হওয়ায় আমেরিকা সেদিন অন্ধ হয়ে গিয়েছিল!

কোনো কোনো সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, ইরানি হামলার পরপরই মার্কিন টেলিভিশন চ্যানেল সিএনএনসহ আরও বেশকিছু মার্কিন মিডিয়া আইন আল-আসাদ বিমানঘাঁটি থেকে লাইভ নিউজ করতে চেয়েছিল। কিন্তু হামলার তিনদিন পর নিহতদের মৃতদেহ সরিয়ে নিয়ে ও আহত সৈন্যদের ইসরাইলের হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠিয়ে এবং ধ্বংস হওয়া সরঞ্জামাদি সরিয়ে তারপর সিএনএনকে এই ঘাঁটিতে ঢুকতে দিয়েছে আমেরিকা। তারপরও সিএনএন’র ভিডিও রিপোর্টে আইন আল-আসাদ ঘাঁটির ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র চোখে পড়ে। রিপোর্টার আরোয়া দামোন হচ্ছেন পশ্চিমা প্রথম কোনো সাংবাদিক যিনি আইন আল-আসাদ ঘাঁটিতে হামলার কয়েকদিন পর প্রবেশের সুযোগ পেয়েছিলেন। সিএনএনএ’র এক্সক্লুসিভ রিপোর্টে তাকে বলতে শোনা গেছে, এটা একটা অসাধারণ ঘটনা- কীভাবে এমন হামলার মুখে কেউ বেঁচে থাকতে পারে। সত্যিই ভিডিওতে যে অবস্থা দেখা গেছে তাতে এতটা ধ্বংসযজ্ঞ চলার পরেও কীভাবে ওই ঘাঁটির একজন সেনা মারা যায় না- সে প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়। বিশ্বের অনেক সামরিক বিশেষজ্ঞ একে আমেরিকার বড়রকমের মিথ্যাচার এবং সত্য গোপন করার চেষ্টা বলে অভিহিত করেছেন।

প্রশ্ন উঠতে পারে, আমেরিকা তাদের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে কেন মিথ্যা কথা বলবে? এর জবাবে সামান্য কয়েকটি কথাই যথেষ্ট। প্রথমত: ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বহু মার্কিন সেনা হতাহত হয়েছে, তাদের ঘাঁটি গুঁড়িয়ে গেছে, তাদের রাডার সিস্টেম ধ্বংস হয়েছে- এসব কথা স্বীকার করলে আমেরিকার সম্মান থাকে না। সারাবিশ্বে তাদের একচ্ছত্র অস্ত্র ব্যবসা থাকবে না। কোনো দেশই আর মার্কিন অস্ত্র বিশেষ করে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ও রাডার সিস্টেম কিনতে চাইবে না। ফলে অস্ত্রখাতে আমেরিকার মোড়লিপনা থাকবে না। অথচ এই অস্ত্রখাত আমেরিকার অর্থনীতি টিকিয়ে রাখার মুখ্য হাতিয়ার। দ্বিতীয়ত: যারা বলতে চাইছেন ইরানের হামলায় আমেরিকার কিছু হয়নি তারা মূলত ইরানের সক্ষমতাকে তুচ্ছ করার চেষ্টা করছেন। প্রকারান্তরে ইরানকে এক রকমের কপট বা মুনাফেক প্রমাণের চেষ্টা করছেন। আমেরিকা এটা করছে তাদের মান-ইজ্জত, অস্ত্র ব্যবসা এবং মোড়লিপনা টিকিয়ে রাখার জন্য। মিত্ররাও তাদের সুরে সুর মিলিয়েছে হয়ত এই জন্য যে, ইরানি হামলায় যে লজ্জা ও ক্ষতির মুখে পড়েছে আমেরিকা তা পুরো পশ্চিমা জগতেরই মান-সম্মানের প্রশ্ন; তাদের সবার শ্রেষ্ঠত্ব ও কর্তৃত্ব এখন চ্যালেঞ্জের মুখে।

কেউ কেউ বলছেন, ইরান আমেরিকাকে আগেই বলে দিয়েছে ৮ জানুয়ারির হামলার কথা। এমন কথা শুনে মনে হতেই পারে, ইরান ও আমেরিকা যেন মামা-ভাগ্নে। মিল-মহব্বতে ভরা দুটি হৃদয়! কিন্তু বাস্তবে তা নয়। ইরান আমেরিকাকে আগেই বলে দিয়েছে, এই বক্তব্য দিয়ে মূলত মার্কিন ও ইসরাইলের বিরুদ্ধে ইরানের শক্তিশালী প্রতিরোধমূলক অবস্থানকে দুর্বল করে মুসলিম বিশ্বে ইরানকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা চলছে। এমন প্রচেষ্টা বহু যুগ ধরেই চলছে। মুসলিম বিশ্বে ইরান যেন প্রভাবশালী হয়ে উঠতে না পারে সেজন্য একটা তৎপরতা আছে। নতুন এই প্রচারণা তারই অংশ হতে পারে। সেজন্য তারা ইরানকে ইসরাইল ও আমেরিকার গোপন বন্ধু হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করে থাকতে পারে। এ চেষ্টা চলছে প্রধানত মধ্যপ্রাচ্যেরই মুসলিম দেশ থেকে।

লেখক: রেডিও তেহরানের সাংবাদিকর

ইরাক ইরান ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন সামরিক ঘাঁটি হামলা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর