আব্বাস দম্পতির ‘স্নেহছায়ায়’ নির্ভার খোকাপুত্র ইশরাক
১৯ জানুয়ারি ২০২০ ১১:৩৩
ঢাকা: ঢাকা মহানগর কার নিয়ন্ত্রণে থাকবে? মির্জা আব্বাস, না সাদেক হোসেন খোকার?— গত তিন দশক ধরে ঢাকায় বিএনপির রাজনীতিতে এটি ছিল বিরাট ইস্যু। দুজনের দ্বন্দ্ব নিরসন এবং মন রক্ষায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে কম ঝামেলা পোহাতে হয়নি। ঢাকায় আব্বাস ও খোকার জনপ্রিয়তা, দাপট বা প্রভাব সমানে সমান থাকায় দুই কুলই রক্ষা করতে হয়েছে বিএনপির চেয়ারপারসনকে।
অবিভক্ত ঢাকায় আব্বাস-খোকা, দুজনই ছিলেন বিএনপি সমর্থিত মেয়র। খালেদার কেবিনেটে দুজনকেই মন্ত্রী হিসেবে দেখা গেছে। ২০০৯ সালে বিএনপির পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলের পর যুগ্ম-মহাসচিব থেকে এক লাফে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটিতে ঠাঁই হয় মির্জা আব্বাসের। সাদেক হোসেন খোকাকে করা হয় ভাইস চেয়ারম্যান। এতে কিছুটা হলেও পিছিয়ে পড়েন খোকা। ২০১১ সালের ১৪ মেয়ে ঢাকা মহানগর বিএনপির দায়িত্ব সাদেক হোসেনর খোকার ওপর ছেড়ে দিয়ে তার মনোবেদনা দূর করেন বিএনপির চেয়ারপারসন।
তারপরও ঢাকায় বিএনপির রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে মির্জা আব্বাস-সাদেক হোসেন খোকার দ্বন্দ্ব বহুবার, বহুকারণে সামনে এসে পড়ে। দুইজনের অনুসারী এবং সমর্থকদের মধ্যে প্রকাশ্য ঝগড়া-বিবাদ অনেক সময় এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, গোটা দল তাতে বিব্রত হয়েছে। অসংখ্যবার সাদেক হোসেন খোকা এবং মির্জা আব্বাসকে ডেকে শাসিয়েছেন খালেদা জিয়া।
তবে গত বছর ৪ নভেম্বর সাদেক হোসেন খোকার মৃত্যু আগ মুহূর্তে আব্বাস-খোকার বৈরি সম্পর্কের অবসান ঘটে। মৃত্যুর ৩৪ দিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেওয়া একটি পোস্টে মির্জা আব্বাস লেখেন, ‘প্রিয় খোকা, এই মাত্র আমি জানতে পারলাম যে তোমার শরীর খুব খারাপ। তুমি হাসপাতালে শয্যাশায়ী। জানার পর থেকে আমার মানসিক অবস্থা যে কতটা খারাপ এই কথাটুকু কারো সঙ্গে শেয়ার করব সেই মানুষটা পর্যন্ত আমার নেই। তুমি আমি একসঙ্গে রাজনীতি করেছি। অনেক স্মৃতি আমার চোখের সামনে এই মুহূর্তে ভাসছে। তোমার আর আমার দীর্ঘ এই পথচলায় কেউ কেউ তাদের ব্যক্তি স্বার্থে তোমার আর আমার মাঝে একটা দুরত্ব তৈরি করে রেখেছিল।’
তিনি আরও লেখেন, ‘আমি জানি না, তোমার সাথে আমার আর দেখা হবে কিনা। আমার এই লেখাটি তোমার চোখে পড়বে কি না বা তুমি দেখবে কি না তাও আমি জানি না। তবে বিশ্বাস কর, তোমার শারীরিক অসুস্থতার কথা জানবার পর থেকেই বুকের ভেতরটা কেন যেন ভেঙে আসছে। আমি বার বার অশ্রুসিক্ত হচ্ছি। মহান আল্লাহ্ তায়ালার কাছে দুহাত তুলে তোমার জন্য এই বিশ্বাস নিয়ে দোয়া করছি, তিনি অবশ্যই তোমাকে সুস্থ করে আমাদের মাঝে ফিরিয়ে আনবেন।’
‘তুমি আর আমি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, বুকে বুক মিলিয়ে রাজনীতির মাঠে কাজ করে যাব। না হয় সেই আগের মতোই স্বার্থপর কোনো মানুষদের জন্য আব্বাস আর খোকা বাইরে বাইরে দূরত্বের সেই অভিনয়টা করে যাবে।…তুমি ফিরে এসো খোকা, তুমি ফিরে এসো। আমি অপেক্ষায় থাকব।’- এভাবেই লেখাটি শেষ করেন আব্বাস।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাদেক হোসেন খোকার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আব্বাস-খোকার দ্বন্দ্বের অবসান হলেও অনেকেই ধারণা করছিলেন মাঠের রাজনীতিতে এ দ্বন্দ্ব সহজেই দূর হবে না। বিশেষ করে খোকার অবর্তমানে তার পুত্র ইশরাক হোসেন যেহেতু দোর্দণ্ড প্রতাপে বিএনপির রাজনীতিতে আবির্ভূত হয়েছেন, সেহেতু মহানগরে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে আব্বাস-খোকা পরিবারে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব রয়েই যাবে। এটা সহসা মিটবে না।
কিন্তু সব হিসাব-নিকাশ বদলে দিয়ে খোকাপুত্র ইশরাক হোসেনের মাথার ওপর স্নেহের ছায়া মেলে ধরেছেন ঢাকা দক্ষিণে গতবারের মেয়রপ্রার্থী মির্জা আব্বাস এবং তার পত্নী আফরোজা আব্বাস। নির্বাচন প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই আব্বাস দম্পত্তির পূর্ণ সমর্থন, দোয়া এবং সহযোগিতা পেয়ে আসছেন এবারের প্রার্থী ইশরাক হোসেন।
নির্বাচনে প্রার্থী হতে দলের প্রাথমিক ফরম তোলার পর খোকাপুত্র ইশরাক হোসেন প্রথম দোয়া নিতে যান আফরোজা আব্বাসের কাছে। নয়াপল্টন কার্যালয়ে দলের মহাসচিবের রুমে তখন মহিলা কাউন্সিলরদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন আফরোজা আব্বাস। ইশরাকের মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিয়ে প্রাণভরে দোয়া করেন তিনি।
মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় ইশরাকের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনে যান আব্বাস দম্পতি। ইশরাকের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব গ্রহণ করেন মির্জা আব্বাস। প্রচারণার প্রথম দিন বায়তুল মোকাররম মসজিদে গিয়ে খোকাপুত্র ইশরাকের পাশে দাঁড়ান তিনি। আর চলমান প্রচারণার বেশিরভাগ দিন ইশরাকের সঙ্গেই থাকছেন আফরোজা আব্বাস।
শুধু আব্বাস দম্পত্তি নয়, তাদের অনুসারীরাও ইশরাকের প্রচার-প্রচারণায় পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছেন। মির্জা আব্বাসের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিতি হাবীবুর রশিদ হাবিব, ইউনুস মৃধা তাদের অনুসারীদের নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই ইশরাকের নির্বাচনি প্রচারণায় হাজির হচ্ছেন। দিয়ে যাচ্ছেস সবরকম সমর্থন-সহযোগিতা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিএনপির রাজনীতিতে ‘ঢাকার কিং’ হিসেবে খ্যাত মির্জা আব্বাস এবং তার সহধর্মিণী আফরোজা আব্বাসের পূর্ণ সমর্থনের কারণে অনেকটাই নির্ভার ইশরাক হোসেন। খোকা-আব্বাস ‘গ্রুপ থিওরি’ ভুলে মাঠের কর্মীরাও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছেন। ফলে বাড়তি কোনো চাপ নিতে হচ্ছে না খোকাপুত্র ইশরাককে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মির্জা আব্বাস বলেন, ‘আমি মেয়র ছিলাম। খোকাও মেয়র ছিল। খোকা নেই। ওর ছেলেটা দাঁড়িয়েছে। দায়বদ্ধতা থেকেই ইশরাকের জন্য কাজ করছি। এটা বড় কোনো মহৎ কাজ কি না জানি না। তবে ইশরাকের পাশে থাকাটা আমাদের কর্তব্য। সেই কর্তব্যই আমরা পালন করছি।’
অবশ্য বিষয়টিকে মহৎ কাজ হিসেবেই দেখছেন অনেকে। তারা বলছেন, স্বার্থপরতার রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিতজনরা তরুণদের উঠে আসাটাকে খুব ভালোভাবে নেন না। আর সেই তরুণ যদি হন প্রতিপক্ষ বা প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যক্তির উত্তরসূরি, তাহলে তো কোনো কথাই নাই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মহত্বের পরিচয়টাই দিয়েছেন মির্জা আব্বাস দম্পত্তি।
এ প্রসঙ্গে রাজনীতি বিশ্লেষক এবং বিএনপির চেয়ারপারসনের প্রেসউইং কর্মকর্তা শায়রুল কবির খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘অতীতে মির্জা আব্বাস এবং প্রয়াত সাদেক হোসেন খোকার মধ্যে কী দ্বন্দ্ব বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল, সেটা এখন আলোচনার বিষয় নয়। বরং এখন আমাদের ভাবতে হবে- ইশরাকের জন্য মির্জা আব্বাস এবং আফরোজা আব্বাস যেটা করছেন, সেটা অনন্য, অসাধারণ।’
আফরোজা আব্বাস ইশরাক হোসেন ডিএসসিসি মির্জা আব্বাস মেয়র নির্বাচন সাদেক হোসেন খোকা