‘ব্ল্যাকমেইলার মডেল’ জেরিন-পপি
২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১৮:৪৪ | আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ২০:৩৯
উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
ঢাকা: জেরিন খান। কখনো জেরিন কস্তা কখনো জারিন নামেও পরিচিত। বাড়ি চট্টগ্রামের ইপিজেড সংলগ্ন বন্দর টিলা এলাকায়। পেশায় জেরিন মডেল। আনুষ্ঠানিকভাবে এটিই তার পরিচয়।
অভিযোগ এসেছে জেরিন স্রেফ মডেলই নন। এর পাশাপাশি নানা প্রতারণামূলক কাজেও তিনি জড়িত। সঙ্গে আরেক মডেল রেহেনা জামান পপি। জারিন খানের সহযোগী।
পপি বিবাহিত। তার নিজ বাড়ির পরিচয় জানা যায়নি, তবে স্বামীর বাড়ি মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়িতে।
এক ব্যবসায়ীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি রাতে জেরিন ও পপিকে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জাপান গার্ডেন সিটির একটি ফ্ল্যাট থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। পরে জেরিনের তথ্যের ভিত্তিতে মতিঝিল এজিবি কলোনির একটি বাসা থেকে তাদের সহযোগী রাজ্জাক হোসেন রাজ ও জাকির হোসেন নামে আরো দুজনকে পুলিশ গ্রেফতার করে।
এরপর শুরু হয় আইনি প্রক্রিয়া। পুলিশ রিমান্ড আবেদন করলে আদালত জেরিন-পপিকে দুইদিনের রিমান্ডে পাঠান। রিমান্ডের প্রথম দিনেই জেরিন চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন বলেই সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
গোয়েন্দাদের দাবি, ঢাকায় ও চট্টগ্রামে জেরিন ও পপির একাধিক ফ্ল্যাট রয়েছে। ব্যাংকে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে টাকা। মূলত ব্লাকমেইল করেই তারা এ সব সম্পত্তি করেছেন।
গোয়েন্দারা জেনেছেন, নানা ধরনের ব্ল্যাকমেইলিংয়ের কৌশল জেরিনের রপ্ত। ফাঁদে ফেলে ধনপতি-শিল্পপতিদের কাছ থেকে তারা হাতিয়ে নেন টাকা, লিখিয়ে নেন ফ্ল্যাট-গাড়ি। লোক-লাজের ভয়ে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার ওইসব লোকজন মুখ খোলেন না। নেন না আইনের আশ্রয়। এ সুযোগে একের পর এক প্রতারণা করে আসছিলেন জেরিন ও তার সহযোগীরা।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার (পূর্ব) আতিক ইসলাম মুরাদ রিমান্ডে জেরিনের কাছ থেকে পাওয়া এ সব তথ্য সারাবাংলাকে জানিয়েছেন।
পুলিশের ওই কর্মকর্তা জানান, গুলশানের ব্যবসায়ী ইমতিয়াজ আহমেদ ভূঁইয়া। ঢাকার বাংলামোটর এলাকায় টাইলসের শোরুম রয়েছে তার। ব্যবসায়ী ইমতিয়াজ আহমেদ এ চক্রের খপ্পড়ে পড়ে ১২ লাখ টাকা ও অন্যান্য জিনিসপত্র খুইয়েছেন।
আইনি প্রতিকার চেয়ে ওই ব্যবসায়ী মামলা করেন। সে মামলায় জেরিন, পপিসহ মোট চারজনকে গোয়েন্দা গ্রেফতার করে। এ চক্রের আরও দুই সদস্যকে ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, ইমতিয়াজের কাছ থেকে ১২ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার আগে শাকিল নামে একজনের কাছ থেকে ১২ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল চক্রটি।
মামলা থেকে জানা যায়, জেরিন খানের সঙ্গে প্রথমে তার বন্ধুত্ব হয়। এরপর বিভিন্ন লোকেশনে ঘুরে বেড়ানো, খাওয়া-দাওয়াও করেন তারা। গত ৮ ফেব্রয়ারি ইমতিয়াজকে ফোন করে জেরিন জানান, তার মা অসুস্থ।
খবর পেয়ে ইমতিয়াজ জাপান গার্ডেন সিটির ১২ নম্বর বিল্ডিংয়ের ১০৩ নম্বর ফ্ল্যাটে যান। ফ্ল্যাটে যাওয়ার পর ইমতিয়াজ দেখতে পান সেখানে চারজন সশস্ত্র ব্যক্তি। তারা নিজেদের ডিবি পুলিশের লোক পরিচয় দিয়ে ইমতিয়াজের দিকে পিস্তল তাক করেন।
এরপর ওই চারজন ইমতিয়াজকে মারধর করেন। জঙ্গি অভিযোগ দিয়ে তাকে গ্রেফতারের ভয় দেখানো হয়। এমনকি মেরে ফেলারও হুমকি দেওয়া হয়।
ওই চারজন অস্ত্রধারী ইমতিয়াজ ও জেরিনকে নগ্ন করে ছবি তোলেন এবং ভিডিও ধারণ করেন। জেরিনকে ধর্ষণের চেষ্টা করেছে এমন প্রমাণ ইমতিয়াজের পরিবার, আত্মীয় স্বজনসহ বন্ধু বান্ধবদের দেখানোর কথা বলা হয়। তবে শর্ত পূরণ করলে এ ঘটনা কাউকে জানাবে বলে ইমতিয়াজকে আশ্বস্থ করেন তারা।
শর্তানুযায়ী ইমতিয়াজ ওইদিনই ১২ লাখ টাকা ও পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার প্রদান করেন। ইমতিয়াজের কাছ থেকে ব্যক্তিগত গাড়ি, সিটি ব্যাংকের একটি ক্রেডিট কার্ড এবং ঢাকা ব্যাংকের একটি ডেবিট কার্ড, দুটো আইফোন এবং মূল্যবান নথিপত্র ছিনিয়ে নেয় তারা।
এরপর ইমতিয়াজ ৯ ফেব্রুয়ারি বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে জাপান গার্ডেন সিটির ওই ফ্ল্যাট থেকে মুক্তি পান। পরদিন ১০ ফেব্রুয়ারি ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে এক লাখ ২৫ হাজার টাকা তোলেন। সেই টাকা দিয়ে যমুনা ফিউচার পার্কের ফ্যান্সি জুয়েলারি থেকে ২৬ হাজার ১১০ টাকা মূল্যের স্বর্ণালঙ্কার ক্রয় করেন। এছাড়া ১১ ফেব্রুয়ারি বসুন্ধরা শপিং মলের বিভিন্ন দোকানে ওই ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে বিভিন্ন কেনাকাটা করেন।
কার্ড দুটি ফেরত চেয়ে ও শারীরিক নির্যাতনের ঘটনায় ১৭ ফেব্রুয়ারি মোহাম্মদপুর ধানায় মামলা করেন ইমতিয়াজ।
গোয়েন্দাদের কাছে জেরিন স্বীকার করেছেন, তিনি শুধু মডেল অভিনেত্রী নন। ছদ্মবেশে অনেক শীর্ষ শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে ফাঁদে ফেলেন। বিশেষ করে যারা সম্প্রতি ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের লোন পেয়েছেন, যাদের অ্যাকাউন্টে প্রচুর পরিমাণে নগদ অর্থ আছে। তাদের মোবাইল নম্বর, অফিস ও বাসার ঠিকানা এবং ব্যক্তিগত অন্যান্য তথ্যাদি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন। জারিনের নেতৃত্বে এ জালিয়াতি চক্র গড়ে ওঠে।
জেরিন জানান, ব্ল্যাকমেইলিংয়ের এ চক্রে বেশকিছু মডেল ও অভিনেত্রী জড়িত রয়েছেন।
জেরিনের দাবি, তিনি একজন স্বশিক্ষিত। তিনি নাটকে অভিনয় করেন। শ্যুটিং চলাকালে একজন বিখ্যাত পরিচালকের কাছে নির্যাতিত হন। এরপর নাটকের নায়কের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই নায়কও তাকে ছেড়ে যান। এরপর তিনি প্রতারণায় নামেন।
জেরিন ও পপি শিল্পপতি ও তাদের সন্তানদের সঙ্গে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও হংকংয়ে বেড়াতেও প্রস্তুত থাকতেন। বিদেশ থেকে তারা অনেক টাকাও সঙ্গে নিয়ে আসতেন।
জিজ্ঞাসাবাদের সময় পপি জানান, নতুন মডেল ও অভিনেত্রী যারা আছেন তারাও এই চক্রে জড়িত। বিনিময়ে ওই সব মডেল ও অভিনেত্রীদের বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রদান করা হয়। এ সব কাজের তদারকিও করতেন জেরিন ও পপি।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দাবি, পপিও চক্রের গুরুত্বপূর্ণ একজন সদস্য এবং শ্যামলীর এলাকায় তার ভাড়া ফ্ল্যাটে টার্গেট করা ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের এনে ব্ল্যাকমেইলিং করা হতো। তিনি একজন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে একটি ফ্ল্যাটও লিখিয়ে নিয়েছেন।
সারাবাংলা/ইউজে/একে