মরণফাঁদ সিলেট-আখাউড়া রেলপথ, কর্তৃপক্ষের দায়সারা আশ্বাস
২২ জানুয়ারি ২০২০ ১০:৩৪
মৌলভীবাজার: শত বছরের পুরনো লক্কড়-ঝক্কড় রেললাইন আর মেয়াদোত্তীর্ণ রেল ব্রিজ। গুরুত্বপূর্ণ অনেক স্থানেই নেই স্লিপার, এমনকি নাট-বল্টুও। সামান্য ঝড়বৃষ্টি হলেই রেল লাইন থেকে মাটি সরে গিয়ে রেল সড়ক পরিণত হয় মরণফাঁদে। এতে কখনো কখনো ব্রিজ ভেঙে ঘটছে ছোট বড় দুর্ঘটনা। তবে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হয়ে। এ দৃশ্য সিলেট-আখাউড়া রেল লাইনের।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ত্রুটিপূর্ণ এমন লাইন ব্যবহার করেই বছরের পর বছর ধরে যাতায়াত করছেন সিলেট বিভাগের চার জেলার কয়েক লাখ মানুষ। বিভিন্ন সময় রেল দুর্ঘটনায় একাধিক মানুষের মৃত্যু, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বা দিনের পর দিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও তা নিয়ে তেমন পদক্ষেপ দেখা যায়নি রেল কর্তৃপক্ষের। শুধু আশ্বাস দিয়ে গেছেন তারা।
গত বছরের ২৪ জুন কুলাউড়ায় বরমচালে রেল দুর্ঘটনায় চার জন নিহত ও প্রায় শতাধিক আহত হন। সেই ঘটনার দ্বিতীয় দিন ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে রেল মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, সিলেটের আখাউড়ায় রেল সড়কে ডুয়েল ব্রডগেজ হবে আর তখন সবই পরিবর্তন হয়ে যাবে। এখনো এ নিয়ে কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
বরমচালের ওই রেল দুর্ঘটনায় নিহত কুলাউড়া শহরের বাসিন্দা নিহত মনোয়ারা বেগমের এক আত্মীয় আব্দুল কাইয়ুম সারাবাংলাকে বলেন, ১৭৬ কিলোমিটার ঢাকা-সিলেট রেলপথটি সেই ব্রিটিশ আমলের তৈরি। সম্প্রতি ঢাকা থেকে ভৈরব পর্যন্ত ডাবল লাইন স্থাপন করা হলেও ভৈরব থেকে সিলেট পর্যন্ত লাইনটি রয়েছে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। শত বছরের পুরনো এ সড়কটি মাঝে-মধ্যে নামমাত্র সংস্কার করা হলেও অধিকাংশ স্থানের অবস্থাই অত্যন্ত নাজুক। নড়বড়ে প্রতিটি সেতুতে ট্রেন উঠলেই কাঁপতে শুরু করে বগি।
স্থানীয় সিনিয়র সাংবাদিক কাউছার ইকবাল সারাবাংলাকে বলেন, গত তিন বছরে অন্তত ২০ থেকে ২৫টি দুর্ঘটনা ঘটেছে এই রেল পথে। কয়েকদিন পরপর এই রুটে স্লিপার লাইনচ্যুত হলেও দুর্ঘটনা কবলিত এসব স্থানে কোনোরকম জোড়া-তালি দিয়ে সংস্কার করে ফের চালু করে দেওয়া হয় লাইন।
স্থানীয় সমাজকর্মী তারিক হাসান অপু সারাবাংলাকে বলেন, ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে প্রতিদিন ছয়টি আন্তঃনগর ও দুইটি লোকাল ট্রেন অন্তত ১৫ থেকে ১৬ বার যাতায়াত করে। এতে অন্তত ২০ থেকে ২৫ হাজার মানুষ যাতায়াত করেন। আর দুর্বল রেল লাইন ও বগির কারণে এসব যাত্রীরা প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হন বলে ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, এসব নিয়ে কর্তৃপক্ষ শুধু আশ্বাসই দেন। বাস্তবে কিছু চোখে পড়ে না।
ভবিষ্যতে দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পেতে এই রেল লাইন এবং রেললাইনের শতবর্ষী ব্রিজগুলো দ্রুত সংস্কার করার দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
রেলওয়ে সূত্র থেকে জানা যায়, সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনাটি ঘটে গত বছরের জুন মাসের ২৩ তারিখ রাতে। সিলেট থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসা ‘উপবন এক্সপ্রেস’টি মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল এলাকায় পৌঁছালে প্রায় পাঁচটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে ছিটকে পড়ে। আরও একটি বগি ছিটকে খালে পড়ে যায়। এ ঘটনায় চার জন মারা যান, আহত হন শতাধিক যাত্রী।
গত বছরেরই ২ জুন সকালে হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার রশিদপুরে ‘কুশিয়ারা’ ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে। এতে সিলেটের সঙ্গে সারাদেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। পরে ১৬ ঘণ্টার দুর্ভোগ শেষে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়।
এর আগে, একই বছরের ৬ এপ্রিল সিলেটের মাইজগাঁওয়ে মালবাহী একটি ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হয়ে সিলেটের সঙ্গে সারাদেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ওইদিন রাত সাড়ে ১০টার দিকে দুর্ঘটনাটি ঘটে। এ সময় সিলেট থেকে ছেড়ে যায় যাত্রীবাহী ‘উপবন এক্সপ্রেস’ মোগলাবাজার স্টেশনে আটকা পড়ে।
২০১৭ সালের ৬ এপ্রিল বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সিলেট থেকে ছেড়ে আসা ‘পাহাড়িকা এক্সপ্রেস’ মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের রেলওয়ের ১৪১ নম্বর সেতুর মাটি সরে রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
একই বছরের ২৯ মার্চ হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার ইটাখোলা এলাকার ৫৬ নম্বর ব্রিজে বৃষ্টির পর মাটি সরে যায়। পরদিন মেরামতের সময় একটি পিলার ধসে গেলে সারাদেশের সঙ্গে সিলেটের ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। চার দিন বন্ধ থাকার পর সারাদেশের সঙ্গে সিলেটের রেল যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়। কিন্তু একদিন পর ফের বন্ধ হয়ে পড়ে যোগাযোগ।
এর আগে, একই বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের ভাড়াউড়া এলাকায় ১৫৭ নম্বর সেতুর পিলারের নিচ থেকে মাটি সরে সেতুটি দেবে যায়। এতে রেল যোগাযোগ ১৪ ঘণ্টা বন্ধ থাকে।
২০১৬ সালের ৭ অক্টোবর হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার নোয়াপাড়ায় ‘পারাবত এক্সপ্রেস’ ট্রেনের তিনটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে ইঞ্জিনে আগুন লেগে যায়। এতে বেশ কয়েকজন আহত হন।
এসব বড় বড় দুর্ঘটনা ছাড়াও ঢাকা-সিলেট রেলপথে প্রায় প্রতিনিয়তই ঘটছে দুর্ঘটনা। বিষয়টি নিয়ে যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক থাকলেও উদাসীন রেল কর্তৃপক্ষ। দেশের জনপ্রিয় ও বৃহত্তম এই যোগাযোগ ব্যবস্থায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাধারণ যাত্রীরা চলাচল করলেও রেল কর্তৃপক্ষ লাইন সংস্কারের কোনো উদ্যোগই না নেওয়ায় বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন যাত্রীরা।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে কুলাউড়া রেলের ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী (সড়ক) জুলহাস মাহমুদ সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের লোকজন বসে থাকে না। রিপেয়ারিংয়ের কাজ বরাবরই চলমান আছে। তাছাড়া রেল গাড়ি চলাচলের জন্য অনেকগুলো বিভাগ রয়েছে। এটা শুধু আমাদের একার কাজ না।