প্রচারণায় মাইকের ব্যবহার: বিধি মানছেন না প্রার্থীরা
২৩ জানুয়ারি ২০২০ ২২:২৫
ঢাকা: ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রচার-প্রচারণা প্রায় সব প্রার্থীর পক্ষেই উচ্চস্বরে সাউন্ড বক্স ও মাইক ব্যবহার করতে দেখা গেছে। নিয়ম অনুযায়ী দুপুর ২টার আগে মাইক বা সাউন্ড বক্স ব্যবহার করা না গেলেও সকাল থেকেই বাজছে এসব যন্ত্র। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন প্রার্থীর পক্ষে ভোট চাওয়ার জন্য জনপ্রিয় সব গানের কথা বদলে দেওয়া হচ্ছে, যুক্ত করা হচ্ছে প্রার্থীর পক্ষে প্রশংসার ফুলঝুড়ি। একদিকে এতে করে নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘনের যেমন অভিযোগ উঠেছে, তেমনি নগরবাসীও জানিয়েছেন, তারা শব্দের ‘অত্যাচারে’ অতীষ্ঠ হয়ে পড়েছেন। বিশেষ করে সামনে এসএসসি পরীক্ষা থাকায় পরীক্ষার্থীদের নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন অভিভাবকরা।
তেজগাঁওয়ের শাহীনবাগ এলাকার বাসিন্দা মো. জোবায়ের সারাবাংলাকে বলেন, ‘সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিকৃত গানে মেয়র ও কাউন্সিলরদের পক্ষে ভোট চাওয়া হচ্ছে। তাদের তো দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তারা পশ্চাৎপদ গানের মাধ্যমে পেছনে পড়ে থাকছে। নির্বাচন কবে শেষ হবে, তা নিয়েই ভাবছি! কারণ পুরো ঢাকায় মাইক আর সাউন্ড বক্সের বদৌলতে শব্দ দূষণে টিকে থাকা দায় হয়ে উঠেছে।’
বাংলামোটরের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শফিক আল মামুন সারাবাংলাকে বলেন, ‘কিছুক্ষণ পর পর রাস্তা দিয়ে মাইক বাজিয়ে ভোট চাওয়া হচ্ছে। কখনও উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সাউন্ড বক্স বাজানো হচ্ছে। একেক সময় একেক প্রার্থীর। আমরা কাজের সময় মনযোগ দিতে পারছি না। এতে কর্মক্ষমতা নষ্ট হচ্ছে।’
নির্বাচনি প্রচারে ব্যবহৃত সাউন্ডবক্সের উচ্চস্বরে অতীষ্ঠ হয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন অনেকেই। সাংবাদিক আহমেদ মুশফিকা নাজনীনও তুলে ধরেছেন তার ক্ষোভের কথা। ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, ‘….মানুষকে বিরক্ত করে এভাবে ভোট চাওয়ার অধিকার কি কারও আছে? কার কাছে যাব মাইক বন্ধ করতে? শেষমেষ খুবই বিরক্ত হয়ে ভাবছি, কাল সকাল থেকে যদি আবার গান বাজে তাহলে যে দল বাজাবে তাদের ভোটই দেবো না। নির্বাচনের আগেই যারা নাগরিকদের কথা ভাবে না, শিশুদের কথা ভাবে না, নির্বাচনের পর কি তারা কখনো ভাববে?’
কাকরাইলের বাসিন্দা নাজনীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘সকাল থেকে রাত পর্যন্ত উচ্চস্বরে গান বাজছে। এত জোরে বাজছে যে কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার মতো অবস্থা। কোনো একটি গান শেষ হতে না হতেই শুরু হচ্ছে আরেকটি। নাগরিক হিসেবে এই শব্দ দূষণের শিকার আমি কেন হব? এই বাসায় অনেকেই আছে, যারা এসএসসি পরীক্ষার্থী। তারা শব্দ দূষণের কারণে ঠিকভাবে লেখাপড়া পর্যন্ত করতে পারছে না।’
ফেসবুকে সাইফুল ইসলাম তানভীর লিখেছেন, ‘ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যারা কাউন্সিলর ক্যান্ডিডেট হয়েছেন, তাদের অধিকাংশজনই সমাজের অপরাধী। মদ, জুয়া, ব্যাভিচার চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধে তারা জড়িত। নির্বাচন উপলক্ষে তারা কোটি কোটি টাকা উড়াচ্ছে। তারা এর হাজার গুণ টাকা কাউন্সিলর হয়ে উঠাবেন— সে টার্গেট তো আছেই!! বর্তমানে তারা প্রচণ্ড শব্দ দূষণ করে চলছেন। চারদিকে প্রচণ্ড শব্দ। চলছে তাদের নামে গান! প্রশংসা!! …. এতে বিশেষ করে শিশুদের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। তাছাড়া সামনে এসএসসি পরীক্ষা।’
মেহেদি হাসান নামে একজন লিখেছেন, ‘চলছে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনি প্রচারণা। সংবাদমাধ্যমগুলোতে বলা হচ্ছে, শেষ মুহূর্তে প্রচারণা জমে উঠেছে!! আদৌ কি জমে উঠেছে? পুরো শহরটা পোস্টার দিয়ে ঠাসা। মুখে বলছে শহরকে ডিজিটাল করবে, অথচ নিজেরাই মান্ধাতা আমলের ক্যাম্পেইন করছে। পোস্টারে শহরের বারোটা বাজাচ্ছে, উচ্চস্বরে মাইকিং করছে, দলবেঁধে ভোট চাইছে।’ এখনকার তথ্যপ্রযুক্তির সময়ে এমন মার্কেটিং কতটুকু যুক্তিযুক্ত— সে প্রশ্নও তুলেছেন তিনি।
এদিকে, সিটি করপোরেশন (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালা ২০১৬-এর মাইক্রোফোন ব্যবহার সংক্রান্ত বিধি-নিষেধের ধারা ২১-এ বলা আছে, কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বা তার পক্ষে কোনো রাজনৈতিক দল, অন্য কোনো ব্যক্তি, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান একটি ওয়ার্ডে পথসভা বা নির্বাচনি প্রচারের কাজে একের বেশি মাইক্রোফোন বা শব্দের মাত্রা বর্ধনকারী অন্য যন্ত্র ব্যবহার করতে পারবেন না।
ওই ধারায় আরও বলা হয়েছে, কোনো নির্বাচনি এলাকায় মাইক বা শব্দের মাত্রা বর্ধনকারী যন্ত্রের ব্যবহার দুপুর ২টার আগে ও রাত ৮টার পরে করা যাবে না।’
তবে নির্বাচনি এই আচরণবিধি কোনো প্রার্থীই মানছেন না বলে অভিযোগ রাজধানীবাসীর। তারা বলছেন, সকালে ঘুম থেকে উঠেই তারা পাচ্ছেন মাইকের আওয়াজ, তা চলছে গভীর রাত পর্যন্ত।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ হালিম সারাবাংলাকে বলেন, নির্বাচনে বহু আগে থেকেই মাইকের ব্যবহার হয়ে আসছে। তবে ডিজিটাল প্রযুক্তির আবির্ভাবের ফলে বিকৃত করে গান কিংবা গানের সিডি বাজিয়ে ভোট চাওয়া হচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশে এই প্রচারণা অন্য রকম হওয়া উচিত ছিল।
শরীফ বলেন, নির্বাচনি বিধিনিষেধ থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। সারাবিশ্বে প্রচার-প্রচারণায় যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, আমাদের দেশে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে হচ্ছে উল্টো। নির্বাচনে বিধিমালার অনেক কিছুই ভঙ্গ হচ্ছে। যেগুলা সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলো আমলে নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু জনগণ বা মানুষের জন্য যা গুরুত্বপূর্ণ, নির্বাচন কমিশন বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তা আমলে নিচ্ছে না। এক্ষেত্রে সরকারের যেমন সহযোগিতা দরকার, তেমনি প্রার্থীসহ সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, নির্বাচনকে ঘিরে এখন পুরো শহরেই শব্দ দূষণের আবহ তৈরি হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে ঢাকায় শব্দ দূষণের যে মাত্রা থাকা উচিত, এর চেয়ে দ্বিগুণ, আড়াইগুণ বা তিনগুণও থাকছে কোনো কোনো স্থানে। এমনিতেই ঢাকায় বসবাস করা অসহনীয় হয়ে উঠছে, এই শব্দ দূষণ এখন বোঝার ওপর শাকের ওপর আঁটির মতো হয়ে গেছে।
ডা. লেলিন বলেন, এসএসসি পরীক্ষার্থী, শিশু ও যাদের শব্দ দূষণের বাইরে রাখা উচিত, তাদের ক্ষেত্রে এই শব্দ দূষণ অসহনীয় মাত্রার হয়ে উঠছে। যারা আমাদের শহরকে নিয়ে নানা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, অন্তত শুরুতে তাদের শব্দ দূষণ কমানো উচিত। একই সঙ্গে পোস্টারে যে পলিথিনের ব্যবহার হচ্ছে, নির্বাচনের পর এই পলিথিন কোথায় যাবে, এর ফলে ক্ষতি কতটুকু হচ্ছে— সে বিষয়টিও আমাদের খতিয়ে দেখা উচিত।
মেয়র প্রার্থীরা অবশ্য এ বিষয়ে নিজেদের দায়মুক্ত বলে মনে করছেন। জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) আওয়ামী লীগের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রচার-প্রচারণার ক্ষেত্রে আমরা তো নিয়ম মেনে চলছি। কিন্তু জনতার ঢল থামাব কিভাবে? নির্বাচন কমিশনাররা এটা নিয়ন্ত্রণ করবেন। আমি বারবার বলে আসছি, প্রচারণার সময় কেউ যেন জনদুর্ভোগ তৈরি না করে। আমি জানিও না অনেকে বড় বড় পোস্টার টানাচ্ছে, শুভাকাঙ্ক্ষীদের সবাইকে তো আমরা জানা বা চেনা নেই।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণে বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থী ইশরাক হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রচার-প্রচারণার সঙ্গে যুক্ত আমাদের সবগুলো ইউনিটকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে আচরণবিধি অনুযায়ী প্রচারণা চালাতে। নগরবাসীকে কোনো ধরনের দুর্ভোগের মধ্যে ফেলতে চাই না আমরা। মাইক বা শব্দযন্ত্রের ব্যবহারের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা ও সহনশীলতা অবলম্বের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তারপরও কোথাও কোনো ধরনের শব্দ দূষণ বা জনদুর্ভোগ তৈরি হলে আমরা সে ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেব।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা আবুল কাসেম সারাবাংলাকে বলেন, ‘দুপুর ২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত মাইক বা সাউন্ড বক্স ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু কেউ যদি এর ব্যাত্যয় ঘটায়, তাহলে তিনি নির্বাচনি বিধি লঙ্ঘণ করছেন। তা যদি আমাদের চোখে পড়ে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তিনি বলেন, ‘এটি দেখার দায়িত্ব নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের। ১৮ জন ম্যাজিস্ট্রেট উত্তরে এ নিয়ে কাজ করছেন।’ উত্তরের বক্তব্য পেলে এ বিষয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তার মন্তব্য জানা যায়নি।
আচরণবিধি প্রচারণা মাইকের ব্যবহার সিটি করপোরেশন নির্বাচন সিটি নির্বাচন