নিরাপদ সড়ক আন্দোলন করে পেল ১০ স্কুলবাস, শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাস
২৫ জানুয়ারি ২০২০ ১৪:৫৪
চট্টগ্রাম ব্যুরো: নিরাপদ সড়ক চেয়ে আন্দোলন গড়ে তোলা চট্টগ্রামের শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে ১০টি দ্বিতল বাস পাঠিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসব বাস শুধু চট্টগ্রাম মহানগরীর বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীদের তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আনা-নেওয়া করবে। বছরের শুরুতে প্রধানমন্ত্রীর এই উপহার পেয়ে উচ্ছ্বসিত শিক্ষার্থীরা।
শনিবার (২৫ জানুয়ারি) সকালে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ১০টি বাসের যাত্রা উদ্বোধন করেন। রোববার থেকে নগরীতে বাসগুলো চলাচল করবে।
দেড় বছর আগে নিরাপদ সড়কের আন্দোলনের সময় চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনি’র মধ্যস্থতায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বৈঠকে বসছিলেন জেলা প্রশাসক। এসময় শিক্ষার্থীরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্কুলবাসসহ বিভিন্ন দাবি জানিয়েছিলেন। বৈঠকের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামে স্তিমিত হয় আন্দোলন। দেড় বছর পর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ১০টি বাস চট্টগ্রামে চালু করতে যাচ্ছে। মাত্র পাঁচ টাকায় শিক্ষার্থীরা যেকোনো রুটে যাতায়াত করতে পারবেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, ‘কিছুদিন পরেই এই বাংলাদেশ আমরা যে মহান নেতার জন্য পেয়েছি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ শুরু হচ্ছে। সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তকে সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাতৃস্নেহে চট্টগ্রামের শিক্ষার্থীদের জন্য ১০টি বাস উপহার হিসেবে পাঠিয়েছেন। সেই উপহার আমি তোমাদের কাছে পৌঁছে দিয়ে গেলাম।’
শিক্ষার্থীদের বাসগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে যত্নশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়ে নওফেল বলেন, ‘এই বাস তোমাদের সম্পদ। তোমরা নিজেদের দায়িত্বে তোমাদের সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ করবে। আমি প্রধানমন্ত্রীকে গিয়ে বলব, উনার মাতৃস্নেহে পাঠানো উপহার, ভালোবাসার নিদর্শন তোমরা দেখভাল করে রাখছ। তোমরা অবশ্যই বাস ব্যবহারের যে নিয়মকানুন করা হয়েছে, সেগুলো পালন করবে। স্কুলের ইউনিফর্ম পরে বাসে উঠতে হবে। পাঁচ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে, সততার সাথে সবাই সেটা দেবে। কারণ, তোমরাও একদিন মন্ত্রী-এমপি-বিচারক-জেলা প্রশাসক হবে, সেদিন যাতে তোমরা সততার সাথে দায়িত্ব পালন করতে পার, এই শিক্ষাটা স্কুল থেকে নিতে হবে।’
শিক্ষাখাতে সরকারের বিভিন্ন অর্জন তুলে ধরে তিনি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ‘তোমাদের বয়সে যখন আমরা স্কুলে পড়তাম, আমরা আমাদের বড় ভাইবোনদের, আত্মীয়স্বজনের বই ব্যবহার করতাম। সঠিক সময়ে আমরা বইখাতা পর্যন্ত পেতাম না। এখন বছরের প্রথমদিন সারাদেশে ৩৫ কোটি বই শেখ হাসিনার কারণে আমরা পাই। এটা তখন আমরা চিন্তাও করতে পারিনি। আমরা যেসব স্কুলে পড়েছি, তখন আমরা স্কুলে কম্পিউটার দেখব সেটা কখনো চিন্তাও করতে পারিনি, চোখেও দেখিনি। আজ প্রাইমারি স্কুলে পর্যন্ত কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ইন্টারনেট আসছে। যতই আমরা পাচ্ছি, ততই শেখ হাসিনার কাছে আমাদের প্রত্যাশা বেড়ে যাচ্ছে, এই প্রত্যাশার অংশ হিসেবে তোমরা চেয়েছ বাস। বঙ্গবন্ধু কন্যা মাতৃস্নেহে তোমাদের জন্য উপহারটা পাঠিয়েছেন। ’
নুরুল আজিম রনিসহ ছাত্রলীগ নেতাদের ধন্যবাদ জানিয়ে উপমন্ত্রী নওফেল বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুলবাসের দাবি তোলা এবং সেটা আদায় করে নেওয়া, এটা ছাত্রলীগের গঠনমূলক রাজনীতির চমৎকার প্রতিফলন। এভাবে গঠনমূলক রাজনীতি নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের সন্তানেরা-ছাত্রছাত্রীরা কি চায়, সেই বিষয় মাথাই রেখেই ছাত্র রাজনীতি করতে হবে। মনে রাখতে হবে- ছাত্রদের জন্যই ছাত্র রাজনীতি, শুধু দলের নেতাদের পেছনে ঘোরার নাম ছাত্র রাজনীতি নয় ‘
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি আরও বলেন, ‘স্কুল-কলেজ থেকে পাস করে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে, বড় পদে যেতে হবে, এই চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পড়ালেখা শেখার পরও সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপনে কোনো লজ্জা নেই। কোনো পেশাকে ছোট করে দেখবে না। আমরা যারা বিদেশে পড়ালেখা করেছি, দিনে তিনটা চাকরি করতে হত, সেই আয়ে পড়ালেখা করতে হত। আমরা কেউ রেস্টুরেন্টে বার্গার বানিয়েছি, কেউ বা সিকিউরিটির কাজ করেছে, এতে কোনো লজ্জা নেই। পড়ালেখা করে একজন বাসচালক হওয়া, একটা কৃষিখামার করা, মাছ চাষ করা- এসব করা যাবে না, এমন চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যা করলে আমি আমার জীবনকে সাজাতে পারব, সেটাই আমার করা উচিত।’
বিআরটিএ চট্টগ্রামের ব্যবস্থাপক এম জেড রহমান বলেন, ‘মাত্র পাঁচ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। আজকের দিনে পাঁচ টাকা ভাড়া দেওয়া কোনো বিষয় নয়। বাসে কোনো ভাড়া কালেক্টর থাকবে না। দুটি বক্স থাকবে, শিক্ষার্থীরা নিজ দায়িত্বে সেখানে ভাড়া ফেলে যাবেন। বাসে ওঠানামার জন্য শুধু দুজন সাহায্যকারী থাকবেন। এই বাস থেকে কোনো লাভের চিন্তা আমাদের নেই। শিক্ষার্থীরা যদি সঠিকভাবে এই বাসের রক্ষণাবেক্ষণ করে, তাহলে প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিক এই উদ্যোগ টিকে থাকবে।’
সভাপতির বক্তব্যে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন বলেন, ‘নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন স্তিমিত করে ছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গে শিক্ষার্থীরা আমার কাছে এসেছিলেন এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্কুলবাস চেয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর উপহার আশা করি, শিক্ষার্থীরা পরম যত্নে আগলে রাখবে। প্রতিটি বাসে ৬টি সিসি ক্যামেরা থাকবে। কেউ যদি ভাড়া পরিশোধ না করেন, সেটা সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়বে। সেই শিক্ষার্থীকে শনাক্ত করে স্কুল কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে, এমনকি তাকে বহিষ্কারও করা হতে পারে।’
অনুষ্ঠানে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. সৈয়দ গোলাম ফারুক, বাস পরিচালনায় সহায়তাকারী জিপিএইচ ইস্পাত লিমিটেডের কর্মকর্তা আলমাস শিমুলও বক্তৃতা করেন।
নগরীর এম এ আজিজ স্টেডিয়াম সংলগ্ন জিমনেশিয়াম প্রাঙ্গনে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর শিক্ষা উপমন্ত্রী বিভিন্ন স্কুল থেকে আসা শিক্ষার্থীদের নিয়ে সামনের মাঠে রাখা বাসগুলো ঘুরে ঘুরে দেখেন। এসময় হাজারো শিশুর কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠে পুরো এলাকা। কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কিছুক্ষণ আনন্দময় সময় কাটান উপমন্ত্রী। পরে ১০টি বাস সারিবদ্ধভাবে শিক্ষার্থীদের নিয়ে জিমনেশিয়াম প্রাঙ্গন ত্যাগ করে।
ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী তাজফিয়া তারেক সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্কুলে আসা-যাওয়ার সময় রিকশা কিংবা বাসের জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। অনেক সময় ইভটিজিংয়ের শিকার হতে হত। এখন বাসে সহপাঠী, বন্ধুদের সঙ্গে আসা-যাওয়া করব। আর গাড়ির জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না।’
তাজফিয়ার সহপাঠী জারিফা হাসান বলেন, ‘এখন তো রাস্তায় প্রচুর জ্যাম থাকে। বিশেষত স্কুল ছুটির পর এমন জ্যাম হয়, খুবই বিরক্ত লাগে। বাসগুলো যেহেতু আমাদের স্কুলের সামনে নামিয়ে দেবে এবং স্কুলের কাছাকাছি জায়গা থেকে তুলে নেবে, এখন আশা করি আর সেই সমস্যায় পড়তে হবে না।’
চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র আবরার আল সামিত সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটা আমাদের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। আমার বাসা দূরে। ২-৩ টা গাড়ি পাল্টে তারপর স্কুলে আসতে হয়। এখন স্কুলবাস পেয়েছি, আমাদের জন্য অনেক সুবিধা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।’
২০১৮ সালের ২৯ জুলাই দুপুরে রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের অদূরে বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী দিয়া খানম মিম ও আবদুল করিম রাজিব নিহত হয়। এ ঘটনার পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে সারাদেশে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা।
সেদিন শিক্ষার্থীদের নিয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে যাওয়া নগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘কোনো দাবি যদি যৌক্তিক হয় এবং কোনো সরকার যখন গণমুখী হয় তখন সেই সরকার অবশ্যই যৌক্তিক দাবি মেনে নেয়। প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামের শিক্ষার্থীদের জন্য ১০টি বাস পাঠিয়ে এটাই প্রমাণ করেছে, বাংলাদেশে এখন একটি গণমুখী সরকার ক্ষমতায় আছে। একইভাবে এটাও প্রমাণ হয়েছে যে, আন্দোলন মানে বিশৃঙ্খলা নয়, আন্দোলনের মানে হচ্ছে যৌক্তিক দাবি আদায় করে নেওয়া।’