বোনের বিয়েতে এসে বাড়ি ফেরা হলো না মা-মেয়ের
২৯ জানুয়ারি ২০২০ ১০:২৫
মৌলভীবাজার: মৌলভীবাজার শহরের সাইফুর রহমান সড়কের একটি দোতালা ভবন। দুদিন আগেও এখানে ছিল ভরপুর আনন্দ আয়োজন। সেই আয়োজনে যোগ দিতে প্রাণের টানে বিভিন্ন জায়গা থেকে ছুটে এসেছিলেন স্বজনেরা। বিয়ের বাদ্যিতে মুখর ছিল পুরো বাড়ি। কিন্তু আজ সেই বাড়িতেই কেবল কান্নার রোল। স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে পুরো বাড়িটি যেন মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছে।
এই বাড়িতেই হবিগঞ্জের উমেদনগর থেকে মেয়ে বৈশাখীকে (৩) নিয়ে মামাতো বোনের বিয়েতে এসেছিলেন দীপা রায় (৩৫)। সোমবার (২৭ জানুয়ারি) ছিল বিয়ের বৌ-ভাত। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে মেয়েকে নিয়ে হবিগঞ্জে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল মঙ্গলবার। কিন্তু মেয়েকে আর বাড়ি ফেরা হলো না দীপা রায়ের। ভয়াবহ এক অগ্নিকাণ্ডে পরিবারের আরও তিনজনের সঙ্গে চলে যেতে হলো পরপারে।
মঙ্গলবার (২৮ জানুয়ারি) সকাল সোয়া ১০টার দিকে সাইফুর রহমান রোডের ওই বাসার নিচে পিংকি স্টোরের গ্যাসের রাইজার থেকে আগুন লাগে। সেই আগুনেই স্বজনদের সঙ্গে মারা যান মা দীপা রায় ও মেয়ে বৈশাখী। ওই দোকানের ওপরের বাসাতেই আত্মীয়দের সঙ্গে তার এক ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে অবস্থান করছিলেন দীপা। আগুন লাগার পর বাসার অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে দীপা রায় মেয়ে বৈশাখীকে ওই বাসায় আটকা পড়েন। প্রাণ বাঁচাতে দীপার ছেলে বাসার বাইরে বেরিয়ে আসতে পারলেও মেয়ে বৈশাখীকে নিয়ে বের হতে পারেননি মা। ফলে অন্য তিনজনের সঙ্গে তাদেরও মৃত্যু হয়।
অগ্নিকাণ্ডে নিহতরা হলেন- পিংকি সু স্টোরের মালিক দীপার মামা সুভাষ রায় (৬৫), সুভাষ রায়ের মেয়ে প্রিয়া রায় (১৯) এবং তার ভাইয়ের বউ দীপ্তি রায় (৪৮)।
ভয়াবহ আগুন থেকে বেঁচে ফেরা সুভাষ রায়ের স্ত্রী জয়ন্তী রায়ের দুচোখ এখন অন্ধকার। অগ্নিকাণ্ডে হারিয়েছেন স্বামী সুভাষ রায় ও মেয়ে পিয়া রায়কে। বড় মেয়ে পিংকির বিয়ে হওয়ায় শ্বশুর বাড়িতে থাকায় বেঁচে যায় সে। এদিকে মেয়েসহ দগ্ধ হবেন এমনটা হয়তো ভাবেননি দীপা রায়ের স্বামী সজল রায়। তিনিও ছেলেকে নিয়ে স্ত্রী ও মেয়ের জন্য পাগল প্রায়।
নিহতদের পরিবারের নিকটাত্মীয় কল্পনা রায় বলেন, ‘বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা প্রায় শেষের দিকে ছিল। সোমবার বৌ-ভাত শেষ করে রাতে আমরা সবাই আনন্দ করেছি। এর মধ্যে আমি অন্যত্র চলে আসি। আর ওই বাসাতে তাদের পরিবারের সদস্য ও আত্মীস্বজনসহ ১২ জন অবস্থান করছিলেন। সকালে অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে আমরা এসে কয়েকজনকে উদ্ধার করি। কিন্তু আগুনের তীব্রতা এমন ছিল যে, পাঁচজনকে বের করে আনা যায়নি।’
স্থানীয় বাসিন্দা রুপম আচার্য্য জানান, ‘বাসার অবস্থা এমন ছিল যে, ঘর থেকে বেরিয়ে আসার বিকল্প ছিল না। সদর দরজা দিয়ে তাৎক্ষণিক যাদের সম্ভব হয়েছে বের করে এনেছি। কিন্তু আগুন এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল যে পুরো ভবন ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে যায়। এরপর আর ভেতরে কিছুই দেখা যায়নি। পিংকি সু-স্টোরের দোতলায় সুভাষ রায় তার পরিবার নিয়ে থাকতেন। তাদের নিচে নামার সিঁড়িও একটি। সেটাও দোকানের ভেতর দিয়ে। তাই তারা নামতে পারেনি।’
প্রত্যক্ষদর্শী ব্যবসায়ী শেখ রুমেল আহমেদ বলেন, ‘পিডিবি ও জালালাবাদ গ্যাস এ ঘটনায় চরম অবহেলা করেছে। আগুন লাগার দুই ঘণ্টা পরও বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়নি। এমনকি পৌর মেয়র ও ব্যবসায়ীরা বারবার অভিযোগ করার পরও কোনো সাড়া দেয়নি।’
এদিকে ফায়ার সার্ভিস মৌলভীবাজারের উপ-পরিচালক আব্দুল্লাহ হারুন পাশা বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে দোকানের ভেতরেই ছিল গ্যাস লাইনের রাইজার। সেখান থেকেই আগুনের উৎপত্তি হয়েছে।’
এ ঘটনায় পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন ও পৌরসভা। মঙ্গলবার বিকেলে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে এই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।