Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিরল রোগী আব্বাসের চিকিৎসা নিয়ে সন্দিহান চিকিৎসকরা


২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১৮:২৪

জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট‘

ঢাকা: ‘আমার এক পাও মোডা (মোটা), সারা শরীরে গোডা (গোটা-ঘাঁ) ,পাও থেইক্যা দিয়া পানি পরে, সারা শরীরে গন্ধ-কেউ আমার কাছে আসতে চায় না। ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়ছি, কিন্তু যেই না পানি পড়া শুরু করছে আর যাই নাই স্কুলে। ফোরের বই বাড়িতে আছে, কিন্তু স্কুলে যাইতে পারি না, হাঁটতে পারি না’ —হাসপাতালের বেডে বসে বলে ১২ বছরের আব্বাস শেখ।

মাদারীপুরের রাজৈর থেকে বিরল রোগ নিয়ে আসা আব্বাস শেখ বর্তমানে ভর্তি আছে ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল লিমিটেডে। তবে জানা গেল, এর আগে ঢাকার কয়েকটি হাসপাতাল থেকে ফেরত যেতে হয়েছে আব্বাসের পরিবারকে। রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে ফেরত গিয়ে দরিদ্র এই পরিবারটি নির্ভর করতে হয়েছিল গ্রামের হাতুড়ে চিকিৎসক এবং ফকির-ওঝার প্রতি। আজ ২২ ফেব্রুয়ারি হাসপাতালে কেবিনে বসে সারাবাংলাকে এসব কথা বলেন আব্বাস এবং তার বাবা আব্দুর রাজ্জাক শেখ।

আব্বাসের বাবা আব্দুর রাজ্জাক শেখ সারাবাংলাকে বলেন, ‘জন্মের ছয়ঘণ্টা পরই ছেলের দুই পা দুই রকম দেখতে পেয়ে রাজৈর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান, সেখানে একটি ওষুধ দিয়ে বলা হয়, আর কিছু করতে হবে না। কিন্তু সত্যি হয়নি সেই চিকিৎসকের কথা। ধীরে ধীরে ১২ বছরের আব্বাসের ডান পা ফুলে শরীরের চেয়ে বড় হয়েছে, ফুলেছে ডান হাত, মুখসহ পুরো শরীরে গোটা। হাঁটতে গেলে ক্লান্ত হয়ে যায় এবং পায়ে ব্যথা হয়। তাই ঘরেই শুয়ে বসে দিন কাটে আব্বাসের। হাঁটতে পারে না বলে বাদ দিতে হয়েছে স্কুলে যাওয়া।’

পা থেকে পানি পড়ছে গত পাঁচ বছর ধরে, কিন্তু গত দুই-তিন বছর ধরে সেটা বেড়েছে বলে জানান আব্বাসের বাবা আব্দুর রাজ্জাক শেখ। অল্প সময়ের জন্য হাঁটতে পারে, কিন্তু সেটা বেশি সময়ের জন্য না। ডান পায়ের এত ওজন।

বিজ্ঞাপন

২০০৫ সালে আব্বাসের বয়স যখন ১ বছরের মতো, তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ছেলেকে ভর্তি করান রাজ্জাক শেখ। সেখানে এক মাস ভর্তি থাকার পর আব্দুর রাজ্জাক শেখকে বলা হয়, তিনমাস পর পর সেখানে আসার জন্য।

আব্দুর রাজ্জাক শেখের বলেন, ‘তারা বলছে এত ছোট বাচ্চার অপারেশন করা হলে জটিলতা আরও বাড়বে। তারা কোনো ওষুধও দেয় নাই আমাদের। তারা বলে, কোনো মেডিসিন লেখা যাবে না, আমাদের কিছু করার নাই। তখন আর কী করমু, গরিব মানুষ-বাড়ি চলে যাই।’

আব্দুর রাজ্জাক শেখ আরও বলেন, ‘এরপরে আবার ঢাকার সোহ্‌রাওয়ার্দী হাসপাতালে (শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল) নিয়া আইলাম। কিন্তু সেখানে পোলারে ভর্তিই নিল না হাসপাতাল। এক ডাক্তার কেবল আরেক ডাক্তারের কাছে পাডায় (পাঠায়)। ভর্তি করাইতে না পাইরা এলাকার থেইকা এমপির চিঠি নিয়া আবার গেলাম, কিন্তু তারা এইবার আমারে এক বস্তা কাগজপত্র বাইর কইরা ধমক দিল। কইলো, এইগুলা সব এমপি-মন্ত্রীর চিঠি, এমপি-মন্ত্রীর চিঠি দেখমু নাকি রোগীর চিকিৎসা করামু। ফিরত আইলাম সেইখান থেইক্যাও। এরপর ২০১২-এর দিকে শ্বাসকষ্ট শুরু হলে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই, সেখানে চিকিৎসা হয়। কিন্তু হাত পায়ের কোনো চিকিৎসা তারা দিতে পারে নাই।’

সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাদারীপুরের রাজৈরের এক সাংবাদিক আব্বাসের পুরো অবস্থা জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেন যা চোখে পড়ে ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ডা. এমএ আজিজের। এরপরই তিনি উদ্যোগ নেন আব্বাস শেখকে ঢাকায় নিয়ে আসার। এরপরই গতকাল ২১ ফেব্রুয়ারি দুপুরের দিকে আব্বাসকে নিয়ে হাসপাতালে আসেন তার বাবা আব্দুর রাজ্জাক শেখ। হাসপাতালে পৌঁছার পরই আব্বাসকে ভর্তি করা হয় এবং তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়েছে। আব্বাসের চিকিৎসায় আজ ২২ ফেব্রুয়ারি ৬ সদস্যের একটি সার্জিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে। হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) অধ্যাপক ডা. এমএ বাকীকে প্রধান করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

টিমের অন্য সদস্যরা হলেন— হাসপাতালের উপপরিচালক (প্রশাসন) ডা. আব্দুল মালেক মৃধা, অ্যানেস্থেশিয়া বিভাগের প্রধান ডা. মেহতাব আল ওয়াদুদ খান, সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. একেএম রুহুল আমীন, সহকারী অধ্যাপক ডা. সানজানা শারমিন শশী ও সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. মো. ওবাইদুর রহমান।

সার্জারি বিভাগের প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) ডা. এম  এ বাকী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আব্বাসের ক্ষেত্রে আমাদেরকে একটি মাল্টিডিসিপ্লিনারি অ্যাপ্রোচে আগাতে হবে। একজনের মাধ্যমে এই রোগের চিকিৎসা করার সম্ভব না। আগামী সপ্তাহ নাগাদ ওর রোগের নামটি আমরা জানাতে পারব।’

ইতোমধ্যেই ভারত এবং সিঙ্গাপুরের হাসপাতালের সঙ্গেও আব্বাসের বিষয়ে যোগাযোগ করা হয়েছে জানিয়ে ডা. বাকী বলেন, ‘দেশের বিশেষজ্ঞ ভাসকুল্যার সার্জন, পেডিয়াট্রিক সার্জন, প্লাস্টিক সার্জনদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের আমরা ডাকব। এখন পর্যন্ত রোগটিকেও শনাক্ত করতে পারিনি, সবার সঙ্গে বসেই আমাদেরকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ’

সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কেবলমাত্র এই বিরল রোগই নয়— ১২ বছরের আব্বাস ভুগছে রক্তস্বল্পতা, ফুসফুসসহ রয়েছে চর্মরোগ। তারা বলছেন, “এটা ‘রেয়ার এবং কমপ্লিকেটেড কেস’ হিসেবেই আমরা দেখছি।”

চিকিৎসকরা আরও বলছেন, ‘তবে আদৌ এ রোগের শতভাগ চিকিৎসা বাংলাদেশে আছে কিনা এবং বাংলাদেশে সেটি চিকিৎসা সম্ভব কিনা সেটাও ‘কোয়েশ্চেনেবল’। কেবল বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর অন্য দেশেও এটি একটি বিরল রোগ। এর  ‘সেটিসফেক্টরি ট্রিটমেন্ট’ সত্যিকার অর্থে নাই— এটা বলা যায়।’

এ ধরনের রোগী যদি পৃথিবীতে থাকত তাহলে আমাদের সেটি জানা থাকত বলে জানান সার্জারি টিমের আরেক সদস্য সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. ওবাইদুর রহমান। আমরা ধারণা করছি, এটি একটি রেয়ার কন্ডিশন এবং সে হিসেবে আব্বাসই হচ্ছে বাংলাদেশে এবং বিশ্বে এই রোগের প্রথম রোগী— এমনও হতে পারে। সব ধরনের ডায়াগনোসিস শেষ হলেই কেবল রোগটি সর্ম্পকে বলা যাবে।

যদিও আব্বাসের বাবা আব্দুর রাজ্জাক শেখ জানান, তার ৪০ বছরের বোন ছোট মেয়ে একই ধরনের অসুখে ভুগছে, একই ধরনের রোগে ভুগে মারা গিয়েছে তার আরেক মেয়ে। ঢাকার শিশু হাসপাতালে এনে তাদের চিকিৎসা করাতে চাইলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদেরকে ভর্তি নিতে চাননি, অস্বীকৃতি জানিয়েছেন চিকিৎসা করতে। কিন্তু আব্বাসের চিকিৎসকরা পরিবারের অন্য সদস্যের অসুখের সঙ্গে আব্বাসের অসুখকে মেলাতে চাচ্ছেন না-তারা সব পরীক্ষার পর এ বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্ত জানাবেন।

সারাবাংলা/জেএ/আইজেকে

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর