৩ ঘণ্টায় ২ মিটার করে বাড়ছে সেতুপথ
৩০ জানুয়ারি ২০২০ ১০:৩০
পদ্মা থেকে ফিরে: ২৬ জানুয়ারি সকাল ১০টা। পদ্মার শান্ত চেহারায় রোদের ঝিলিক লেগে যেন চকচক করছিল। নদীর বাতাস সাধারণত ঠান্ডাই হয়। কিন্তু সেই সঙ্গে মাঘের পশ্চিমা বাতাস যোগ হয়ে যেন আরও হিম ঠান্ডা করে দিচ্ছিল। তবে পদ্মা যেমনই হোক, স্পিডবোটে মাওয়া থেকে জাজিরার দিকে যাওয়ার পথে চিত্ত যে সবার চঞ্চল ছিল, তা বোধ করি বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ একটিই— পৃথিবীর ১১তম দীর্ঘ সেতু তৈরির আপডেট স্বচক্ষে দেখা।
মাওয়া থেকে প্রায় আধাঘণ্টা পর টিম সারাবাংলা পৌঁছায় জাজিরা প্রান্তে। স্পিডবোট ভিড়ল ৪২ নম্বর পিয়ারের (খুঁটি) কাছে। নেমেই অবাক হওয়ার পালা শুরু। কারণ টিভি স্ক্রিন বা ক্যামেরার চোখ দিয়ে যে পিয়ার দেখা যায়, বাস্তবে তার প্রস্থ দেখলে মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। মোটামুটি ৫০ জন মানুষ পাশাপাশি দাঁড়ালে যে দৈর্ঘ্য, তার সমান একেকটি পিয়ার। যত বড় আঘাতই আসুন না কেন, সেতুকে স্থির দাঁড়িয়ে রাখতেই এমন পিয়ার বসানো হয়েছে।
বিস্ময় কাটার পর সেতুতে ওঠার পালা। সাময়িকভাবে সেতুতে ওঠার জন্য একটি লোহার সিঁড়ি বানানো হয়েছে। মাটি থেকে প্রায় আট তলা সমান উচ্চতা পেরিয়ে উঠতে হয় মূল সেতুতে। সেতুর ৪২ নম্বর পিয়ারের কাছে রাখা সেই সিঁড়ি বেয়ে ওঠা হলো সেতুর রাস্তা তৈরির কাজ দেখতে।
জাজিরা প্রান্তের ৪২ নম্বর পিয়ার থেকে ৩৯ নম্বর পিয়ার পর্যন্ত স্ল্যাব (পাটাতন) বসানোর কাজ প্রায় শেষ। সে এক বিরাট কর্মযজ্ঞ। মাটি থেকে আট তলা সমান উচ্চতায় ক্রেন দিয়ে স্ল্যাবগুলো তোলা হচ্ছে। এরপর ওপরে রাখা একটি পিকআপের ওপর স্ল্যাবটি রাখা হচ্ছে। অনেকের মনেই প্রশ্ন আসতে পারে, পিকআপ কেন? কারণ, স্ল্যাব বসে বসে রাস্তা বড় হচ্ছে। দূরত্ব যখন লম্বা হচ্ছে, তখন সাড়ে ৬ ফুট প্রস্থ, ৭২ ফুট দৈর্ঘ্য আর ৫২শ কেজি ওজনের স্ল্যাবটি সাধারণভাবে বয়ে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব।
ক্রেন যখন মাটি থেকে স্ল্যাব উঠাচ্ছে, তখন ভারসাম্য বজায় রাখতে কোনো পাশে রডও ব্যবহার করা হচ্ছে। মাটি থেকে ক্রেন দিয়ে স্ল্যাব তুলে ওপরে একটা দু’মুখো পিকআপের ওপর রাখা হয়। দু’মুখো পিকআপ এজন্য যে, তা ঘোরানোর মতো অবস্থা নেই। কাজের জন্য রাস্তার সবদিকে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ছড়িয়ে রাখা হয়েছে। তাই সুবিধামতো রাস্তার দু’দিকে পিকআপটি চালানো যাচ্ছে।
পিকআপে তোলা স্ল্যাবটি যেখানে বসানো হবে সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো। সরেজমিনে সারাবাংলা টিম ৪২ নম্বর থেকে ৩৯ নম্বর পিয়ার পর্যন্ত হেঁটে বেড়ায়। দৈর্ঘ্যের হিসাবে যা ছয়শ মিটার। যেখানে স্ল্যাবটি বসানো হবে, সেখানেও আছে ক্রেন। রিমোটচালিত সেই ক্রেন ধীরে ধীরে পিকআপ থেকে স্ল্যাবটি তুলে বসানোর কাজ করে। প্রতিটি স্ল্যাব একেবারে নির্দিষ্ট মাপে করা। হাতের কাজের কোনো ব্যবহার নেই। শুধু একটার পর একটা বসিয়ে দিলেই হলো।
অবশ্য স্ল্যাব বসালেই কাজ শেষ নয়, দুই স্ল্যাবের মাঝ বরাবর সূক্ষ্ণ যে জায়গাটুকু ফাঁকা থাকছে, তা পূরণ করা হচ্ছে এক ধরনের বিশেষ আঠা দিয়ে। এই আঠা আনা হয়েছে চীন থেকেই। চীনারা এটিকে ‘গ্লু’ বললেও বাংলাদেশি শ্রমিকরা তাকে বলছেন, ‘জিএনপি’। ছাই আর কালোরঙা পাউডার মিলিয়ে বানানো হচ্ছে সেই বিশেষ আঠা, যা শেষ পর্যন্ত রূপ নিচ্ছে অফ হোয়াইট রঙে। কয়েকজন শ্রমিক হাতের সাহায্যে বানাচ্ছে সেই আঠা। আর স্ল্যাব বসানো হয়ে গেলে সূক্ষ্ণ সেই ফাঁকা অংশে লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে সেই আঠা। বলা হচ্ছে আগামি একশ বছরেও এই আঠা উঠবে না!
সবমিলিয়ে পুরো স্ল্যাব বসাতে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ মিনিট সময় লাগে। স্ল্যাব বসানোর সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকরা বলছেন, সাধারণত একদিনে সাত থেকে আটটি স্ল্যাব তারা বসাতে পারেন। তবে একদিনে সর্বোচ্চ ৯টি স্ল্যাব বসাতে পেরেছিলেন তারা। ২৬ জানুয়ারি দুপুর দেড়টার দিকে বসানো হয় সেতুর ২১২ নম্বর স্ল্যাব। স্ল্যাব বসানোর যে তথ্য শ্রমিকরা দিলেন, তাতে প্রতি তিন ঘণ্টায় দুই মিটার করে পূর্ণাঙ্গ হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে পদ্মাসেতু।
বিভিন্ন জায়গায় অনেক স্ল্যাব তৈরি করে রাখা আছে। স্প্যানের ওপর সেগুলো বসানোর পরেই রূপ নিচ্ছে লম্বা পাটাতন বা রাস্তায়।
সেতুর রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে নিচে নদী দেখার আনন্দ একরকম। কিন্তু আড়াই ঘণ্টা পর নিচে নেমে যখন ছয়শ মিটার সেতুর প্রায় পুরো রূপ দেখা যায়, তখন যে কারও মনে হতেই পারে— বিশ্ববাসীকে জেদ দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেওয়া সিদ্ধান্তে একচুলও ভুল ছিল না।
পদ্মাসেতু। শুধু নাম নয়। অত্যন্ত কঠিন একটি পদক্ষেপের দৃশ্যমান অগ্রগতি। দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকাসহ অন্য দাতা সহযোগীরা সরে যায়। পরে কানাডার আন্তর্জাতিক আদালতে দুর্নীতির সেই অভিযোগ ভুল প্রমাণিত হয়।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ বাড়লে অর্থনীতির সম্ভাবনার যে চিত্র প্রধানমন্ত্রীর সামনে ছিল, তা তিনি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলেন বলেই এত সংগ্রাম, প্রতিকূলতার পরও সিদ্ধান্তে ছিলেন অটল। দেশের অপ্রয়োজনীয় অনেক প্রকল্প বাদ দিয়ে পদ্মাসেতু তৈরিতে দেশের প্রায় সব অর্থনীতিবিদ ভিন্নমত দিয়েছিলেন। তবে বলা যায় প্রায় একক সিদ্ধান্তেই পদ্মাসেতু তৈরির সিদ্ধান্ত নেন তিনি। পদ্মাসেতু প্রকল্পের মহাকর্মযজ্ঞের সামনে দাঁড়িয়ে তার সেই সিদ্ধান্তকে শ্রদ্ধা জানাই আরও একবার।