Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ঢাকা সিটিতে প্রথম মুখোমুখি নৌকা-ধানের শীষ


১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৮:০৪

ঢাকা: ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ বইয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘মনে মনে সকলেই যাহা জানে, মুখ ফুটিয়া তাহা বলিবার অধিকার কাহারও নাই’। ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ক্ষেত্রে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই কালোত্তীর্ণ উক্তিটিই ছিল বাস্তবতা। ওই বছরের আগ পর্যন্ত দেশের সব স্থানীয় সরকার নির্বাচনেই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীরা ছিলেন প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নিজ নিজ পর্যায়ের শীর্ষ নেতারাই। কিন্তু ওই নির্বাচনগুলো ছিল ‘নির্দলীয়’। ফলে প্রার্থীরা ‘দলীয় প্রার্থী’র বদলে দলের ‘সমর্থিত’ প্রার্থী বলে বিবেচিত হতেন।

বিজ্ঞাপন

২০১৬ সালে এসে সেই ধারাবাহিকতা ভাঙে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনও দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠানের বিধি পাস হয় ওই বছর। সিদ্ধান্ত হয়, সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের প্রার্থী দিতে পারবেন দলীয় প্রতীকে। সে বিধান অনুযায়ী নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে প্রথম দলীয় প্রতীকে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর একে একে গাজীপুর, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট ও বরিশালেও সিটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

সিটি করপোরেশনে দলীয় প্রতীকে একটি নির্বাচন হয় উত্তর-দক্ষিণে বিভক্ত ঢাকাতেও, তবে সেটা ছিল উপনির্বাচন। সে নির্বাচনেই প্রথমবারের মতো ঢাকার কোনো সিটিতে নৌকা প্রতীক প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, প্রার্থী ছিলেন আতিকুল ইসলাম। তবে ওই নির্বাচনে কোনো প্রার্থী দেয়নি বিএনপি। ফলে ওই নির্বাচনে নৌকা মাঠে থাকলেও তার মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়নি বিএনপিকে।

সেই হিসাবে, আজ ঢাকার দুই সিটিতে নির্বাচনের মাধ্যমেই এই প্রথমবারের মতো ঢাকা সিটিতে মুখোমুখি হতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি, তথা নৌকা ও ধানের শীষ। ফলে এর আগে ঢাকা সিটিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও তা ‘নির্দলীয়’ মোড়কে থাকায় দল প্রত্যক্ষভাবে সক্রিয় হতে পারেনি। এবারে সেই বাধা না থাকায় প্রার্থীদের পক্ষে সরাসরি মাঠ চষে বেড়িয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি।

ঢাকা পৌরসভা থেকে ঢাকা সিটি করপোরেশন

১৮৬৪ সালে ঢাকাকে প্রথম পৌরসভা ঘোষণা করা হয়। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ওই সময় ঢাকা পৌরসভার চেয়ারম্যান মনোনীত করা হয় মি. স্কিনার নামের একজনকে, যিনি ছিলেন এক্স-অফিসিও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। এরপর ড. লিয়াল ও জে ব্র্যাডবেরি নামে আরও দু’জন মনোনীত চেয়ারম্যান দায়িত্ব পালন করেন। ১৮৮৫ সালে প্রথম ভোটারদের প্রত্যক্ষ ভোটে ঢাকা পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন রায় বাহাদুর আনন্দ চন্দ্র রায়। ওই নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যান হয়েছিলেন খান আব্দুল্লাহ। ১৯৪০ সাল পর্যন্ত ভোটাধিকার প্রয়োগ করে ভোটাররা ঢাকা পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচনের সুযোগ পান।

বিজ্ঞাপন

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর বাংলাদেশ পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হিসেবে পাকিস্তান রাষ্ট্রে যুক্ত হয়। ১৯৪৭ সালের শেষের দিকে সরকার ঢাকা পৌরসভা বাতিল ঘোষণা করে। ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত পৌরসভায় কোনো নির্বাচন হয়নি। এ সময়ে সরকার মনোনীত ব্যক্তিরাই পৌরসভা পরিচালনা করেছেন। ১৯৬০ সালে সরকার মিউনিসিপ্যাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অর্ডিন্যান্স জারি করে। এই অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী নির্বাচিত চেয়ারম্যানের বদলে সরকারি পদস্থ কর্মকর্তাদের চেয়ারম্যান পদে মনোনীত করার আদেশ হয়। স্বাধীনতার পরেও সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত প্রশাসকদের অধীনেই পরিচালিত হয় ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটি।

১৯৭৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকা নগরীকে ৫০টি ওয়ার্ডে বিভক্ত করে নির্বাচনের মাধ্যমে ঢাকা পৌরসভা গঠন করা হয়। ওই বছর ওয়ার্ড কমিশনারদের নির্বাচন শেষে কমিশনারদের ভোটে মিউনিসিপ্যাল মেয়র নির্বাচিত হন ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত। পরে ১৯৭৮ সালে ঢাকাকে উন্নীত করা হয় মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনে। এসময়ও ঢাকা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের প্রথম মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত। ১৯৮২ সালে সামরিক আইন জারি করা হলে তিনি পদচ্যুত হন। ফের প্রশাসকদের নেতৃত্বে চলে যায় ঢাকা।

১৯৯০ সালে ঢাকা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের নাম পরিবর্তন করে ঢাকা সিটি করপোরেশনে নামকরণ করা হয়। ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত মনোনীতদের দিয়েই চলে সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম। এসময় পর্যায়ক্রমে দায়িত্ব পালন করেন ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত ও মির্জা আব্বাস। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৪ সালে এসে প্রথমবারের মতো ঢাকা সিটিতে মেয়র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ

ঢাকাকে প্রথম পৌরসভা ঘোষণার ১৩০ বছর পর ১৯৯৪ সালে ৩০ জানুয়ারি ঢাকা সিটি করপোরেশনে প্রথমবারের মতো ভোট দিয়ে মেয়র বেছে নেওয়ার সুযোগ পান ভোটাররা। ওই নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ-উৎসাহ ছিল দেশজুড়ে। নির্বাচনে ওই সময়কার ক্ষমতাসীন বিএনপির সমর্থনপুষ্ট প্রার্থী ছিলেন মির্জা আব্বাস। আর বিরোধী দল আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী ছিলেন মোহাম্মদ হানিফ। তবে নির্বাচনে মাছ প্রতীক নিয়ে মোহাম্মদ হানিফ একলাখেরও বেশি ভোটে হারিয়েছিলেন সাইকেল প্রতীকের মির্জা আব্বাসকে। ৫ বছর মেয়াদে নির্বাচিত হলেও তিনি মেয়র পদে ছিলেন ৯ বছর।

অবিভক্ত ঢাকার শেষ মেয়র খোকা

ঢাকা সিটি করপোরেশনের দ্বিতীয় নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয় ২০০২ সালে। ২৫ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনের সময়ও সরকারে ছিল বিএনপি। নির্বাচনে তাদের সমর্থন পাওয়া প্রার্থী ছিলেন ওই সময়কার ঢাকার বিএনপি নেতা এবং সরকারের মৎস্য ও পশুসম্পদমন্ত্রী সাদেক হোসেন খোকা। আওয়ামী লীগ সমর্থিত কোনো প্রার্থী ওই নির্বাচনে অংশ নেননি। নির্বাচনে খোকার বিজয় তাই ছিল অবধারিত। হয়ও তাই। ৬ লাখ ৯০ হাজার ৪৭৪ ভোট পেয়ে মেয়র হন খোকা। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ইসলামী আন্দোলনের সমর্থন পাওয়া এ টি এম হেমায়েত উদ্দীন। তিনি পেয়েছিলেন ৯৪ হাজার ৭২৭ ভোট।

উত্তরদক্ষিণে বিভক্ত ঢাকা সিটি

২০১১ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে বিভক্ত করা হয়। এক নির্বাচনে জয়ী হয়েও টানা ১০ বছর দায়িত্ব পালন করেন খোকা। ওই বছরের ২৯ নভেম্বর সংসদে বিল পাসের মাধ্যমে ঢাকাকে দুই ভাগে ভাগ করলে খোকার মেয়র পদেরও দায়িত্বেরও অবসান ঘটে। এরপর প্রশাসকের অধীনে ঢাকার দুই সিটি চলে আরও প্রায় সাড়ে তিন বছর।

বিভক্ত ঢাকা সিটির প্রথম নির্বাচন

২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল প্রথমবারের মতো ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দীর্ঘ বিরতির পর আয়োজিত এই নির্বাচন নিয়েও সরব হয়ে ওঠে রাজনীতির মাঠ। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন বর্জন করা বিএনপি ঢাকার দুই সিটিতেই প্রার্থী দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আগে থেকেই এই নির্বাচনে ছিল ‘ফেভারিট’।

নির্বাচনে ঢাকা উত্তর সিটিতে পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি আনিসুল হককে সমর্থন দেয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে বিএনপি সমর্থন দেয় তাদের দলের ব্যবসায়ী নেতা আব্দুল আউয়াল মিন্টুর ছেলে তাবিথ আউয়ালকে। এই নির্বাচনটিও ‘নির্দলীয়’ হওয়ায় আনিসুল হকের প্রতীক ছিল টেবিল ঘড়ি, তাবিথ আউয়ালের প্রতীক ছিল বাস। ভোটের দিন দুপুরেই নির্বাচন বর্জন করা তাবিথ আউয়ালকে এক লাখ ৩৫ হাজারেরও বেশি ভোটে হারিয়েছিলেন আনিসুল হক।

এদিকে, ঢাকা দক্ষিণে আওয়ামী লীগ সমর্থন দেয় তাদের সমর্থনে ঢাকা সিটিতে প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফের ছেলে সাঈদ খোকনকে। অন্যদিকে বিএনপির সমর্থন ছিল সেই মোহাম্মদ হানিফেরেই প্রতিদ্বন্দ্বী মির্জা আব্বাসের প্রতি। নির্বাচনে বাবার মাছ না পেলেও সাঈদ খোকনের প্রতীক ছিল ‘ইলিশ’। আর মির্জা আব্বাস আগের নির্বাচনে ‘সাইকেল’ নিয়ে হেরে যাওয়ার পর এ নির্বাচনে বদলি প্রতীক নেন ‘মগ’। তবে ভাগ্য বদলায়নি মির্জা আব্বাসের। প্রায় আড়াই লাখ ভোটের ব্যবধানে হেরে যান সাঈদ খোকনের কাছে।

দলীয় প্রতীক ঢাকা সিটিতেও

২০১৫ সালের ঢাকা সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যেই মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলেও নৌকা-ধানের শীষ লড়াই করার সুযোগ পায়নি। শেষ পর্যন্ত সেই সুযোগ হয় ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আনিসুল হকের অকালপ্রয়াণে। যদিও সে সুযোগও বাস্তব রূপ পায়নি। কারণ ২০১৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলের নৌকা প্রতীকে আতিকুল ইসলামকে প্রার্থী করলেও ওই নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীই দেয়নি। ফলে প্রথম সুযোগেও নৌকা-ধানের শীষের লড়াইটা দেখাতে পারেননি ঢাকা সিটির ভোটাররা।

অবশেষে ঢাকা সিটিতে মুখোমুখি নৌকাধানের শীষ

উত্তর ও দক্ষিণ সিটির মেয়াদ শেষ হওয়ায় গত বছরের শেষভাগেই বেজে ওঠে ঢাকার দুই সিটিতে নির্বাচনের ডঙ্কা। এবার আর নির্বাচন বর্জনের পথে হাঁটেনি বিএনপি। উত্তর ও দক্ষিণ— দুই সিটিতেই প্রার্থী দিয়েছে জাতীয় নির্বাচনে ভরাডুবির পর মাঠের লড়াইয়েও ক্রমশই দুর্বল হতে থাকা দলটি। তাতে নিশ্চিত হয়, এই নির্বাচনের মাধ্যমেই ঢাকা সিটিতে নৌকা আর ধানের শীষের লড়াই দেখার সুযোগ পাবে দেশবাসী।

নির্বাচনে উত্তর সিটিতে আগের উপনির্বাচনে জিতে আসা আতিকুলেই আস্থা রেখেছে আওয়ামী লীগ। তবে দক্ষিণের সাঈদ খোকন বদলে গেছেন। তার জায়গায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী করেছে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সন্তান ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসকে। আতিকুল আর তাপসই তাই ঢাকার দুই সিটিতে নৌকার হাল ধরবেন।

বিএনপিও হেঁটেছে মোটামুটি একই পথে। উত্তরে তাবিথ আউয়ালেই ভরসা রেখেছে দলটি। আর দক্ষিণে এবার আর মির্জা আব্বাস পাননি মনোনয়ন। তার বদলে অবিভক্ত ঢাকার শেষ মেয়র সদ্যপ্রয়াত সাদেক হোসেন খোকার ছেলে প্রকৌশলী ইশরাক হোসেনকে বেছে নিয়েছে তারা। তাবিথ আর ইশরাক তাই ধানের শীষের প্রতিনিধি নির্বাচনে।

সব জল্পনা-কল্পনা শেষে শেষ পর্যন্ত নৌকা-ধানের শীষ মুখোমুখি হওয়া ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচন শুরু হলো বলে। ২২ ডিসেম্বর তফসিল ঘোষণার পর সব ধরনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেছে নির্বাচন কমিশন। এবার কেবল ভোটারদের রায় জানানোর পালা। দেখার বিষয়, ঢাকা সিটির নির্বাচনে নৌকা-ধানের শীষের লড়াই কতটা জমে।

আওয়ামী লীগ ঢাকা সিটিতে মুখোমুখি ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন বিএনপি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর