ফেসবুকে লাইভ, ১০ বছর পর বাবা-মাকে খুঁজে পেল ছেলে
২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ২১:৫৮
মৌলভীবাজার: ছেলেটির বয়স তখন ৭ বছর। অনেকটা দুষ্টুমির ছলেই সে ঢাকাগামী একটি গাড়িতে উঠে ঘুমিয়ে পড়ে। এরপর নিজেকে আবিষ্কার করে সম্পূর্ণ অচেনা এক জায়গায়। কোথা থেকে এসেছে বা জেলার নাম কিছুই বলতে পারে না শিশুটি। তাই পথচারীরা কেউ তাকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে পারেনি। নিরুপায় হয়ে রাস্তার পাশে কাঁদছিল সে।
দশ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া, এই তরুণের নাম শফিক (১৭)। এখন সে থাকছে শ্রীমঙ্গলের পুরানগাঁও এ। সম্প্রতি স্থানীয় শেখ জসিম নামের এক সমাজকর্মী শফিককে সাহায্য করেন তার বাবা-মাকে খুঁজে পেতে। শফিক জানতে পারে তার বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার হুসেনপুর উপজেলায়। আর এ সবই সম্ভব হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের কল্যাণে।
হারিয়ে যাওয়া শফিক যখন ঢাকার রাস্তায় কাঁদছিল তখন তাকে আশ্রয় দেন শ্রীমঙ্গলের ব্যবসায়ী কাবুল মিয়া। কাবুল জানান, শফিক এত ছোট ছিল যে, সে বাবা-মায়ের নাম ও শুধু নান্দাইল নামক এলাকা ছাড়া কিছুই বলতে পারেনি।
অসহায় বাচ্চাটিকে রাস্তায় ফেলে আসতে বিবেকে বেধেছিল কাবুল মিয়ার। ছেলেটি খারাপ কোনো মানুষের হাতে পড়তে পারে এই বিপদের আশঙ্কা থেকে তিনি শফিককে বাড়ি নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন।
তিনি বলেন, যখন আমি ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করি, আমার সঙ্গে বাড়িতে যাবে কি না, সে মাথা নেড়ে সায় দেয়। তাকে আমার নিজ বাড়ি শ্রীমঙ্গলের পুরানগাঁও মহালদারবাড়িতে নিয়ে আসি।
কাবুল মিয়ার পরিবারে আট মেয়ে দুই ছেলে রয়েছে। তাদের সঙ্গে খেয়ে-পরে বড় হয়েছে শফিক। দশ বছর পেরিয়ে সে এখন সতের বছরের তরুণ।
কয়েকদিন আগে শেখ জসিম নামের এক যুবক শফিকের হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা জানতে পারেন। তিনি শফিককে নিয়ে ফেসবুক লাইভে এসে শফিকের কথা সবাইকে জানান। সে ভিডিও শেয়ার হতে থাকে। কিশোরগঞ্জ জেলার হুসেনপুর উপজেলার দুনিয়ার গ্রাম থেকে কিছু লোক জসিমের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তারা শফিককে চিনেন বলে জানান।
তারা বলেন, শফিক দুনিয়া গ্রামের শহীদ মিয়া এবং সুফিয়া খাতুনের হারিয়ে যাওয়া সন্তান। তার বাবা শহীদ মিয়া এবং মা সুফিয়া কান্নায় ভেঙে পড়েন শফিককে ভিডিওতে দেখে। শফিক তাদের হারিয়ে যাওয়া সন্তান বলেই শনাক্ত করেন তারা। শফিককে ফিরিয়ে নিতে শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশে রওনা হন। রোববার (২ ফেব্রুয়ারি) রাত ১০টা নাগাদ তারা ফিরে পান তাদের হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে।
শফিকের বড় ভাই সুজন সারাবাংলাকে বলেন, এটি স্বপ্নের বাইরে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর আমরা তাকে পাওয়ার আশা হারিয়ে ফেলেছিলাম। এখানে সে যে ভালোবাসে পেয়েছে, তাতে সবার প্রতি আমরা চির কৃতজ্ঞ।
বাবা মোহাম্মদ শহীদ মিয়া সন্তানকে ফিরে পেয়ে শুধু কেঁদেই চলেন। তিনি বলেন, সন্তানকে ফিরে পাবেন তা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি।
মহালদারবাড়িতে শফিক ও তার পরিবার আরও কয়েকদিন থাকবেন। এদিকে শফিকের পালকপিতা কাবুল মিয়াও চেয়েছেন শফিক তার মা-বাবাকে ফিরে পাক। তিনি বলেন, সেই ছোটবেলায় তাকে রাস্তায় পেয়েছিলাম। বাড়িতে এনে নিজের সন্তানের মতো বড় করেছি। আমিও চাই শফিক তার বাবা মাকে ফিরে পাক। কিন্তু আমার মন মানছে না। শফিক চলে যাবে ভাবলেই প্রচণ্ড কষ্ট হয়। তাকে হয়ত আমি জন্ম দেইনি কিন্তু বাবা-মায়ের অভাব তাকে বুঝতে দেইনি।
শফিক জানান, তার বর্তমান বাবা মা তাকে নিজ সন্তানের মতোই আদর মমতা দিয়ে বড় করে তুলেছেন।
চলে যাবে শুনে শফিকের বন্ধুদেরও মন খারাপ। গ্রামবাসী শফিককে নম্র ও ভদ্র হিসেবে চিনে। এতগুলো বছরে সে সকলের মন জয় করে নিয়েছে।
ফেসবুকে লাইভ করা শেখ জসিম জানান এর আগেও তিনি এভাবে এক মহিলাকে তার স্বামীর খোঁজ দেন। তিনি বলেন, সেই প্রেরণা থেকেই আমার বিশ্বাস ছিল শফিক তার বাবা-মাকে হয়ত ফিরে পেতে পারে। এই বিশ্বাস থেকেই তাকে নিয়ে ফেসবুকে লাইভে আসি এবং সফল হই।
এ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে সিন্দুরখান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল আল হেলাল সারবাংলাকে বলেন, শফিক যখন ছোট তখন কাবুল মিয়া তাকে বাড়িতে নিয়ে আসে। এরপর তিনি তাকে সন্তানের মতোই লালন-পালন করেছেন। ফেসবুক লাইভে সে তার বাবা-মাকে খুঁজে পেয়েছে। আমাদের সে ছেড়ে যাচ্ছে। তাই কষ্ট হলেও আমরা তাকে বাবা-মায়ের হাতে তুলে দিব।