Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ব্রুনাই হাইকমিশনের ‘দুর্নীতিবাজ’দের বিরুদ্ধে তদন্তে দুদকের চিঠি


৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:২০

ঢাকা: ব্রুনাইয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশনের একাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রবাসী শ্রমিক বা ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সুরক্ষা না করে উল্টো তাদের শোষণের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগটি তদন্ত করতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে সম্প্রতি চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযোগের তদন্ত করে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে মন্ত্রণালয়কে দুদকে প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য বলা হয়েছে চিঠিতে।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উচ্চ পর্যায়ের একটি সূত্র সারাবাংলাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। যে দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের কথা বলেছে দুদক, তারা হলেন— ব্রুনাই হাইকমিশনের প্রথম সচিব (লেবার কাউন্সিলর) জিলাল হোসেন ও লেবার উইংয়ের কর্মকর্তা (দোভাষী) আবু নাঈম।

বিজ্ঞাপন

দুদক সূত্রে জানা গেছে, গত ২৭ জানুয়ারি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর দুদকের মহাপরিচালক (বিশেষ তদন্ত) সাঈদ মাহবুব খানের সই করা চিঠিটি পাঠানো হয়েছে। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর ওই দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ জমা পড়ে। প্রায় মাসখানেক পর এ অভিযোগ তদন্ত করতে মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয় দুদকে। এ সম্পর্কিত নথিপত্র সারাবাংলার গোচরে এসেছে।

দুদকের ‍সূত্র বলছে, জিলাল হোসেন ও আবু নাঈম সিন্ডিকেট প্রবাসী শ্রমিক বা ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সুরক্ষার পরিবর্তে তাদের শোষণ করছেন। তারা নিজেদের দুর্নীতি ও ব্যর্থতা ঢাকতে প্রবাসীদের হয়রানি করছেন। প্রবাসী মজুরি সংক্রান্ত জটিলতা কিংবা হয়রানির বিষয়ে হাইকমিশনে অভিযোগ করলে সমাধান পাওয়া যায় না— এমন অভিযোগও তোলা হয়েছে। তাদের অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ যারা করেছেন, তাদের মানবপাচার বা চুরির মিথ্যা মামলার আসামি হয়ে দেশে ফিরতে হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

দুদক সূত্র আরও বলছে, গত অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্ধ শতাধিক প্রবাসী শ্রমিক ও ব্যবসায়ী দেশে ফিরেছেন বিভিন্ন মামলার আসামি হয়ে। অনেকের পাসপোর্ট বাতিল করা হয়েছে মানবপাচারসহ নানা অভিযোগে। ভুক্তভোগীরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোতে অভিযোগ করে প্রতিকার না পেয়ে দুদকের শরণাপন্ন হয়েছেন বলে অভিযোগে বলা হয়েছে।

দুদকে দায়ের করা অভিযোগে বলা হয়েছে, হাইকমিশনের কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ করলে প্রবাসীদের পাল্টা আক্রমণ ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। এমন ১৫ প্রবাসীর পাসপোর্ট নম্বরসহ নামের তালিকাও রয়েছে। সেই তালিকার একজন কামরুল হাসান। অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় তাকে ব্রুনাই হাইকমিশনের ভেতরেই নির্যাতন করা হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে অভিযোগ। তাতে বলা হয়, নির্যাতনের শিকার কামরুল হাসান হাইকমিশনের কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলাও করেন। পরে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য হাইকমিশন থেকে চাপ দেওয়া হয়।

অভিযোগে মনির হোসেন নামে এমন আরও একজনের নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথঅ উল্লেখ আছে। মনির ২০১৮ সালের ৭ মার্চ অন্যায়ভাবে হাইকমিশন ভবনের ভেতরে তাকে নির্যাতন করা হয়। ঘুষ না দেওয়া ও অনৈতিক দাবির প্রতিবাদ করায় তাকে মারধর করা হয়। এ ঘটনায় মনির হোসেন বাদী হয়ে ব্রুনাই ব্রাকাস থানায় মেডিকেল রিপোর্টসহ ২০১৮ সালের ৮ মার্চ মামলা করেন। মামলা তুলে নেওয়ার জন্য তার ওপরও চাপ প্রয়োগ করা হয়। মামলা তুলে না নেওয়ায় মানবপাচারের অভিযোগ সাজানো হয় তার নামে। পরে তাকে জোর করে দেশে ফেরত পাঠানো হয়।

দুদকে দায়ের হওয়া অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, হাইকমিশনের ওই সিন্ডিকেট সরকার নির্ধারিত ভিসা সত্যায়িত ফি ১৫ ডলারের পরিবর্তে ৫০০ ডলার থেকে ৬০০ ডলার পর্যন্ত নিয়ে থাকে। কেউ ছাড়পত্রের জন্য টাকা কম দিতে চাইলে কিংবা বেশি টাকা দিতে অপরাগতা প্রকাশ করলে লেবার কাউন্সিলর ছাড়পত্র দেয় না, কিংবা তার ছাড়পত্রের আবেদন বাতিল করে দেওয়া হয়। ছাড়পত্রের জন্য টাকা না দিয়ে প্রতিবাদ করায় কোম্পানিকে কালো তালিকাভুক্ত করাসহ নানাভাবে বিতর্কিত করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় জিলাল ও আবু নাঈম সিন্ডিকেট কয়েক বছরের ব্যবধানে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন বলে অভিযোগ বলা হয়েছে।

শুধু তাই নয়, হাইকমিশনের ওই সিন্ডিকেট দিয়ে জনশক্তির ব্যবসাও করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে দুদকে। বলা হয়েছে, নির্ধারিত এজেন্ট মোরশেদ আলম শাহীন, শাহজালাল মাসুদ, মো. রতন, মো. আব্দুল্লাহ, ফারুক সরকারসহ একটি সিন্ডিকেটকে হাতে নিয়ে নিজেরাই জনশক্তি ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন জিলাল। সরকারিভাবে কর্মী পাঠাতে পারে সরকারি প্রতিষ্ঠান বোয়েসেল কিংবা সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে লাইসেন্সপ্রাপ্ত রিক্রুটিং এজেন্সির লোকজন। কিন্তু জিলাল হোসেন বাংলাদেশ থেকে নিজেই কর্মী পাঠানোর ব্যবসা করছেন। জনপ্রতি হাতিয়ে নিচ্ছেন ৩ থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা। যে টাকার অর্ধেকই নিচ্ছেন কাউন্সিলর নিজেই।

নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফেরত আসা একজন প্রবাসী নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, গত ৩০ অক্টোবর আমাকে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ব্রুনাইতে প্রায় ১৫ বছর ধরে ব্যবসা করেছি। সেখানে আমার পুরো পরিবার থাকে। আমার পাঁচটি দোকান ছিল। গত ২৭ অক্টোবর হঠাৎ ব্রুনাই পররাষ্ট্র দফতর জানায়, আমার বিরুদ্ধে অবৈধ মানবপাচার ব্যবসা ও ভিসা জালিয়াতির অভিযোগ করেছে বাংলাদেশি হাইকমিশন। আমাকে দোকান থেকে তুলে নিয়ে ২৮ ও ২৯ অক্টোবর জেলে রেখে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ব্রুনাই বাংলাদেশি হাইকমিশনে লেবার কাউন্সিলার জিলাল ও তার বিশ্বস্ত সহযোগী আবু নাইমসহ কয়েকজন কর্মকর্তা এর জন্য দায়ী বলে অভিযোগ করেন তিনি।

এদিকে মানবপাচারসহ বিভিন্ন মামলার আসামি হয়ে দেশে ফেরত এসেছেন এমন ১৩ জন হলেন— আসিফ, শাহেদ মজুমদার মুন্না, জাকির হোসেন, জসিম সরকার, সোহরাব খান, মো. মেহেদী হাসান, মো. মনির হোসেন, আব্দুর রহিম, মো. ইসমাইল সরদার, জাজ মিয়া, সবুজ মির্জা, কামরুল হাসান ও  মো. আনোয়ার হোসেন।

গত নভেম্বরে দেশে ফেরত এসেছেন জাজ মিয়া। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, গত নভেম্বর আমাকে চুরির মামলা দিয়ে ফেরত পাঠানো হয়েছে। প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টাকা খরচ করে ব্রুনাই গিয়েছিলাম। নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করতাম। হঠাৎ একদিন এজেন্ট খোরশেদ লোক পাঠিয়ে বলে তোমার নামে চুরির মামলা আছে। তোমাকে দেশে ফিরে যেতে হবে। আমি আগে ও পরে কিছু জানি না। অথচ মিথ্যা মামলা দিয়ে দেশে পাঠিয়ে দিল খোরশেদ। এই খোরশেদ হাইকমিশনের কয়েকজন কর্মকর্তার বিশ্বস্ত এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। তার নামে চার থেকে পাঁচটি লাইসেন্স রয়েছে। আমি শুনেছি, গত বেশ কিছুদিন ধরে ব্রুনাই থেকে মানবপাচার ও চুরির মামলা দিয়ে হয়রানি করে দেশে ফিরে এসেছে অনেক বাংলাদেশি। আমাদের সঙ্গে যে অন্যায় হয়েছে, আমি তার বিচার চাই।

এ বিষয়ে দুদকের একজন উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, অভিযোগটি পাওয়ার পর কমিশনে সিদ্ধান্ত হয় তদন্তের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর। আর মন্ত্রণালয় ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার পরে কমিশন পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত সারাবাংলাকে বলেন, ব্রুনাই হাইকমিশনের কয়েকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়েছি। সেটি তদন্ত করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে দিয়েছি। মন্ত্রণালয়ের তদন্তের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তদন্তের নির্দেশ দুদকে অভিযোগ প্রথম সচিব প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী প্রবাসীদের নির্যাতন ব্রুনাই হাইকমিশন ব্রুনাই হাইকমিশনে দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট

বিজ্ঞাপন

নামেই শুধু চসিকের হাসপাতাল!
২২ নভেম্বর ২০২৪ ২২:০৬

আরো

সম্পর্কিত খবর