চসিক নির্বাচন: আ.লীগে পাল্লা ভারী নাছিরের, সক্রিয় সুজন-মাহবুবও
৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১০:০৬
চট্টগ্রাম ব্যুরো: ঢাকার দুই সিটির পর দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচনের ডামাডোলও শুরু হয়েছে। কবে নাগাদ নির্বাচন হতে পারে, চলতি সপ্তাহেই তার সিদ্ধান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার সামনের মাসে, অর্থাৎ মার্চে নির্বাচন করতে আগ্রহের কথা জানিয়েছিলেন। এ অবস্থায় নির্বাচনে সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থী কারা হচ্ছেন, এ নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা।
তবে জোরালো আলোচনা চলছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ কাকে মেয়র প্রার্থী করছে, তা নিয়েই। বর্তমান মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনকে নিয়েই আওয়ামী লীগ নির্বাচনের মাঠে নামবে, নাকি নতুন কাউকে প্রার্থী করবে, কিংবা ঢাকার মেয়র আতিকুল ইসলামের মতো রাজনৈতিক অঙ্গনের বাইরের কাউকে প্রার্থী করে চমক দেবে— এ নিয়ে চট্টগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতাকর্মী থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের মধ্যে বিস্তর কৌতূহল।
তবে সম্ভাব্য প্রার্থীদের পক্ষে-বিপক্ষে যতই আলোচনা হোক, যতই সমীকরণ উঠে আসুক, শেষ সমাধান আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতেই— এ বিষয়ে একমত সবাই।
১৯৯৪ সালে প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন। টানা ১৭ বছর মেয়র হিসেব দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে বিএনপিতে যাওয়া এম মনজুর আলমের কাছে তিনি হেরে যান। পাঁচ বছর আওয়ামী লীগের হাতছাড়া থাকার পর ২০১৫ সালে জয়ী হয়ে ফের চসিক আওয়ামী লীগের কাছে ফিরিয়ে আনেন আ জ ম নাছির উদ্দীন, যিনি চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন।
দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর, ব্যবসা-বাণিজ্যের মূলকেন্দ্র চট্টগ্রাম দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত। দেশের প্রথম টানেলসহ একাধিক মহাপ্রকল্পও বাস্তবায়ন হচ্ছে এই চট্টগ্রামকে ঘিরেই। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, এই সিটির নিয়ন্ত্রণ অক্ষুন্ন রাখতে দল এমন কাউকে মেয়র প্রার্থী করবে যার গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা আছে এবং যিনি প্রার্থী হওয়ার পর দলের ভেতরে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন না।
আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় আছেন আ জ ম নাছির উদ্দীন, প্রয়াত মহিউদ্দিন চৌধুরীর সন্তান শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খোরশেদ আলম সুজন, কোষাধ্যক্ষ ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) সাবেক চেয়ারম্যান মো. আবদুচ ছালাম এবং চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মো. মাহবুবুল আলম।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র জানিয়েছে, তিনটি সমীকরণে এই মুহূর্তে মেয়র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পাওয়ার পাল্লা ভারি আছে আ জ ম নাছির উদ্দীনের। এর মধ্যে একটি হচ্ছে— ২০১৫ সালে মনোনয়ন পাওয়ার সময় নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তাকে যাদের বিরোধ মোকাবিলা করতে হয়েছে, তারা এখন আর নাছিরের বিরুদ্ধে সক্রিয় নন। দ্বিতীয়ত, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগও এই মুহূর্তে দৃশ্যমানভাবে নাছিরের একক নিয়ন্ত্রণে আছে। এছাড়া মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল স্থানীয় সরকারের কর্মকাণ্ডে জড়াবেন না বলে তাদের ধারণা।
আ জ ম নাছির উদ্দীন অবশ্য এই তিনটি সমীকরণের সঙ্গে যোগ করছেন তার পাঁচ বছরের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডও। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগের ২৫ বছরে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে উন্নয়ন কাজ হয়েছে দুই হাজার ৫৫০ কোটি টাকার। আমি মেয়র হওয়ার পর গত সাড়ে চার বছরে হয়েছে তিন হাজার কোটি টাকার কাজ। অনুমোদন হয়েছে আরও আড়াই হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। এছাড়া ছয় হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প জমা আছে। মোট কথা, আমি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে একটি টেকসই ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছি।’
রাজনৈতিক প্রসঙ্গে আ জ ম নাছির সারাবাংলাকে বলেন, ‘অতীতে আমাকে অনেকে ভুল বুঝতেন। কিন্তু গত চার বছরে আমাকে নিয়ে শীর্ষ পর্যায়ের অনেকের ভুল ভেঙেছে। আমার উদারতা, সবাইকে নিয়ে চলার মানসিকতাটুকু তারা এখন অনুধাবন করতে পারছেন। সেজন্য দূরত্ব এখন নেই বললেই চলে। আর চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগকে আমরা সবার মতামতের ভিত্তিতে পরিচালনা করছি। এখানে সবাই বক্তব্য রাখতে পারেন, নিজস্ব মতামত দিতে পারেন। একক কিছু নয়, যৌথভাবে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে কর্মকাণ্ড করছি। এর ফলে মহানগর আওয়ামী লীগেও কেউ যদি অতীতে আমাকে ভুল বুঝতেন, তারাও এখন সেটা বুঝতে পারছেন।’
সূত্রমতে, গত অক্টোবরে কেন্দ্রীয় সম্মেলনের পর আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে মহিবুল হাসান চৌধুরীকে চট্টগ্রামের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে মেয়র নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নওফেল কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তিনি সেই প্রস্তাবে রাজি হননি বলে তার ঘনিষ্ঠজনেরা জানিয়েছেন। এরপরও শীর্ষ পর্যায়ের আগ্রহে নওফেল প্রার্থী হবেন— এমন প্রত্যাশা আছে তার অনুসারীদের মধ্যে।
রাজনৈতিক-সামাজিক বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে এ মুহূর্তে বন্দরনগরীতে মাঠে সক্রিয় নেতা হিসেবে আলোচনায় আছেন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খোরশেদ আলম সুজন। ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে সুজন বন্দর আসন থেকে মনোনয়ন পেলেও পরে আবার সেটি ফিরিয়ে নেওয়া হয়। এরপর গত দু’টি সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন না পেলেও মাঠ ছেড়ে যাননি সুজন। ২০১৫ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও মনোনয়ন চেয়ে বিফল হন। সামনের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আবারও মনোনয়নের আশায় মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন তিনি। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি সামাজিক সংগঠন গড়ে প্রতি সপ্তাহে বিভিন্ন নাগরিক সংকট নিরসনের দাবিতে কর্মসূচি পালন করছেন সুজন।
জানতে চাইলে খোরশেদ আলম সুজন সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঢাকার দুই সিটিতে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে এবং সেখানে দু’জন জনপ্রিয় প্রার্থী ছিল বলে তারা জিতে এসেছেন। অনুরূপভাবে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনও নিরপেক্ষভাবে হবে এবং এখানেও জিততে হলে জনভিত্তি ও জনপ্রিয়তা আছে— এমন প্রার্থী দেওয়া প্রয়োজন। সেই বিবেচনা করা হলে আমি সবার চেয়ে এগিয়ে আছি। কারণ আমার চেয়ে জনসম্পৃক্ততা বেশি— চট্টগ্রামে এমন কোনো নেতা নেই। মহিউদ্দিন ভাই যে ১৭ বছর মেয়র ছিলেন, আমি ছিলাম উনার নিবিড় সহচর। এই নগরীর নাড়ি-নক্ষত্র আমার জানা আছে। সার্বিক বিবেচনায় আমি মনোনয়ন পাব বলে আশা করছি।’
সূত্রমতে, টানা ১০ বছর সিডিএ চেয়ারম্যান হিসেবে বেশকিছু উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এবং দলের শীষপর্যায়ে যোগাযোগকে পুঁজি করে মেয়র নির্বাচনের দৌড়ে আসতে চান আবদুচ ছালাম। পেশায় পোশাক ব্যবসায়ী ছালাম দেড় দশক আগে এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর হাত ধরে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছিলেন। তবে দলের ভেতরে নাছির, নওফেল কিংবা সুজনের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো কোনো শক্ত সাংগঠনিক বলয় তিনি তৈরি করতে পারেননি। সিডিএ চেয়ারম্যানের পদ থেকে বিদায় নেওয়ার পর মাঝে মাঝে কিছু রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নিজের উপস্থিতি জানান দেওয়া ছাড়া সে অর্থে তিনি অনেকটা সক্রিয়ও নন।
বেশ কয়েকবার আবদুচ ছালামকে ফোন করেও যোগাযোগ সম্ভব না হওয়ায় তার বক্তব্য জানতে পারেনি সারাবাংলা।
তবে এর মাঝে এক সপ্তাহ আগে বন্দরনগরীর উন্নয়ন নিয়ে একটি গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে জোরালো আলোচনায় এসেছেন চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম। ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতি করা মাহবুবুলকে সামনে আনার পেছনে চট্টগ্রামের দু’জন সংসদ সদস্য ও কয়েকজন ব্যবসায়ী নেতা আছেন বলে সূত্র জানিয়েছে।
জানতে চাইলে মাহবুবুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রথম কথা হচ্ছে, গোলটেবিল বৈঠকের সঙ্গে মেয়র নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই। আমি অবশ্যই প্রার্থী হব যদি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চান। এই চট্টগ্রাম হচ্ছে ব্যবসায়ীদের শহর, একসময় বলা হত সওদাগরদের শহর। ঢাকায় যদি একজন ব্যবসায়ী আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে পারেন, তাহলে ব্যবসায়ীদের শহরে একজন ব্যবসায়ী কেন মেয়র হতে পারবে না? এই বিবেচনায় আমি মনে করছি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে প্রার্থী করবেন।’
সর্বশেষ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল। নির্বাচিত মেয়র হিসাবে আ জ ম নাছির উদ্দিন ও কাউন্সিলরেরা শপথ নেন ওই বছরের ২৫ জুলাই। পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্তির পূর্ববর্তী ১৮০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ হিসেবে ফেব্রুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচন করতে হবে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন চসিক চসিক নির্বাচন চসিক মেয়র সিটি নির্বাচন