চসিক: ভোটের আগেই হাল ছেড়ে দিচ্ছে ‘হতাশ’ বিএনপি
৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১১:২৬
চট্টগ্রাম ব্যুরো: ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন এবং চট্টগ্রামের উপ-নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় বন্দরনগরীতে বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে। ফলে আসন্ন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে (চসিক) অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহ হারিয়েছেন বিএনপি নেতারা। নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষেই অধিকাংশ স্থানীয় নেতা। এমনকি তারা কেন্দ্রীয় পর্যায়েও তাদের নেতিবাচক মনোভাবের কথা জানিয়ে দিচ্ছেন।
স্থানীয় নেতাদের মতে, সম্প্রতি হয়ে যাওয়া তিনটি নির্বাচনের পর তারা উপলব্ধি করতে পেরেছেন, দলীয় সর্বোচ্চ সক্ষমতা দেখিয়েও তারা চসিক নির্বাচনে জিততে পারবেন না। এছাড়া মামলায় পর্যদুস্ত নেতাকর্মীদের নির্বাচনের মাঠে আনাও কঠিন হবে। এসব বিবেচনায় ভোটের আগেই হাল ছেড়ে দিচ্ছেন চট্টগ্রাম বিএনপি নেতারা।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতি শাহাদাত হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা হাল ছেড়ে দিচ্ছি না। তবে আমাদের মধ্যে হতাশা আছে। কারণ আমরা ঢাকায় দেখলাম, বিএনপির প্রার্থীদের গণজোয়ার; সেখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের নাম-নিশানাও ছিল না। অথচ মাত্র ১৫ শতাংশ ভোটে তাদের বিজয়ী দেখানো হয়েছে, তা-ও জালিয়াতির ভোটে। যেখানে মানুষ ভোটকেন্দ্রে যাচ্ছে না, সেখানে বিএনপির ভোটে অংশ নেওয়া মানে আওয়ামী লীগের এই জালিয়াতির নির্বাচনকে বৈধতা দেওয়া।’
ঢাকার দুই সিটির পর দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তোড়জোড় এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। চলতি সপ্তাহেই নির্বাচনের তারিখ নিয়ে সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে জানা গেছে। এর আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা মার্চে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগ্রহের কথা জানিয়েছিলেন। এ অবস্থায় নির্বাচনে সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থী কারা হচ্ছেন, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।
১৯৯৪ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোশেনের প্রথম নির্বাচনে বিএনপির সমর্থনে মেয়রপ্রার্থী হয়েছিলেন মীর মো. নাছির উদ্দিন। তাকে হারিয়ে মেয়র হন আওয়ামী লীগের এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। ১১ বছর পর ২০০৫ সালে দুই নেতা আবারও মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। সেবারও নাছিরকে হারান মহিউদ্দিন। ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ নেতা এম মনজুর আলম দলবদল করে বিএনপির সমর্থনে মেয়র পদে মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হন। সেবারই প্রথম বিএনপি চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে জয়ের স্বাদ পায়। কিন্তু ২০১৫ সালে মনজুরকে ফের প্রার্থী করা হলেও তিনি আওয়ামী লীগের আ জ ম নাছির উদ্দীনের কাছে পরাজিত হন। নির্বাচনের দিনই তিনি বিএনপির রাজনীতি ছাড়ার ঘোষণা দেন এবং পরে আবারও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন।
এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সম্ভাব্য মেয়রপ্রার্থী হিসেবে যাদের নাম আলোচনায় আছে তারা হলেন- চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতি শাহাদাত হোসেন, সহ-সভাপতি সৈয়দ আজম উদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম বক্কর ও পোশাক ব্যবসায়ী এরশাদ উল্লাহ।
বিএনপি নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলটির কেন্দ্রীয় এবং স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা শাহাদাত হোসেনকে মেয়রপ্রার্থী করার বিষয়ে আগহী। ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে তিনি চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালী-বাকলিয়া) আসন থেকে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে থেকেই তাকে নির্বাচন করতে হয়। শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের কাছে পরাজিত হলেও শাহাদাতের প্রতি সহানুভূতি রয়েছে দলটির কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাদের।
মামলা কিংবা অন্য কোনো কারণে শাহাদাত প্রার্থী হতে না পারলে আজম উদ্দিন ও আবুল হাশেম বক্করের নাম আলোচনায় আছে বিকল্প হিসেবে। ছাত্রদলের রাজনীতি থেকে উঠে আসা বক্করের শক্ত সাংগঠনিক বলয় আছে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপিতে।
এরশাদ উল্লাহ ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৮ আসন থেকে প্রার্থী হয়ে দলের একাংশের বিরোধিতার মুখে হেরে গিয়েছিলেন। এরপর থেকে নিজস্ব বলয় তৈরি করে এরশাদ দলীয় কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখলেও বিভিন্ন সময় বিরোধে জড়িয়ে তিনি একাধিকবার বহিষ্কার হন। তার বিষয়ে চট্টগ্রামের নেতাকর্মীদের মধ্যে আলোচনা আছে। এছাড়া এরশাদ উল্লাহর সঙ্গে দেশের বাইরে থাকা বিএনপির হাইকমাণ্ডের যোগাযোগ ভালো। সেই হিসেবে দল নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে এরশাদ উল্লাহ মনোনয়ন পেয়ে চমক তৈরি করতে পারেন।
তবে বিএনপির মেয়রপ্রার্থী কে হচ্ছেন, সেই আলোচনা ছাপিয়ে এখন স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে জোরালো হয়েছে দল আদৌ নির্বাচনে যাবে কি-না সেই মনোভাব। গত ২৮ জানুয়ারি রাতে নগরীর নাসিমন ভবনে বিএনপির দলীয় কার্যালয়ে ছাত্রদলের এক বৈঠকে অভিযান চালায় পুলিশ। এ সময় কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় মিলে ছাত্রদলের পাঁচ নেতাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এর প্রতিবাদে ডাকা এক সংবাদ সম্মেলনে শাহাদাত হোসেন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিয়ে তার নেতিবাচক মনোভাবের কথা জানান।
বিএনপি নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আগে তারা সাংগঠনিক শক্তির বিষয়টিও বিবেচনায় নিচ্ছেন। কারণ অধিকাংশ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা আছে, নিয়মিত জেলে যাচ্ছেন, আবার জামিনেও বেরিয়ে আসছেন। সব মিলিয়ে এই মুহূর্তে পরিস্থিতি বিএনপির অনুকূলে নেই বলে মনে করছেন তারা।
এছাড়া শতভাগ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট হবে এমন চিন্তা বিএনপি নেতারা করছেন না। তবে প্রশাসনের বিরূপ মনোভাব এবং আওয়ামী লীগের সংগঠিত শক্তির বিপরীতে দাঁড়ানোর মতো সামর্থ্য এই মুহূর্তে যে তাদের নেই সেটা সদ্যসমাপ্ত তিনটি নির্বাচনে প্রমাণিত বলে মনে করছেন বিএনপি নেতারা।
জাসদ নেতা মঈনউদ্দিন খান বাদলের মৃত্যুতে গত ১৩ জানুয়ারি চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী-চান্দগাঁও) আসনে উপ-নির্বাচন হয়েছে। সেখানে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান। বিএনপি নেতাদের মতে, সেই নির্বাচনে চান্দগাঁও এবং আশপাশের কিছু এলাকায় বিএনপির নেতাকর্মীরা কেন্দ্রে অবস্থান নিলেও অধিকাংশ কেন্দ্রে তারা দাঁড়াতেই পারেননি। বোয়ালখালীতে শুরু থেকেই ভোটের মাঠ আওয়ামী লীগকে ছেড়ে দেয় বিএনপি।
জানতে চাইলে সেই উপ-নির্বাচন অংশ নেওয়া বিএনপির প্রার্থী আবু সুফিয়ান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার নির্বাচনে দেখেছি, মৃত ব্যক্তি পর্যন্ত ভোট দিয়েছে। হামলা-সন্ত্রাস করে আমার সমর্থক-এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে যেতে দেওয়া হয়নি। এতকিছু করেও ২৫ শতাংশ মানুষকেও তারা ভোটকেন্দ্রে আনতে পারেনি। আমাকে যেভাবে হারানো হয়েছে, এরপর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিলে একই ফলাফল আসবে। সেক্ষেত্রে চসিক নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে আমি একবাক্যে বলব- না। কারণ এই নির্বাচনে যাবার কোনো যুক্তি নেই। ন্যাড়া বেলতলায় কয়বার যায়?’
চসিক নির্বাচন নিয়ে নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম বক্কর সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এবং চট্টগ্রামের উপ-নির্বাচনে অংশ নিয়ে আমরা জনগণকে দেখিয়ে দিয়েছি যে, এই সরকারের অধীনে নির্বাচন মানে একটা তামাশা। জনগণই ভোট দিতে আসছে না। তারা মনে করছে, এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে গিয়ে লাভ নেই। নির্বাচন নিয়ে জনগণ যেমন হতাশ, তেমনি হতাশ আমরাও। এরপরও দল যদি সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে আমাদের নির্বাচন করতে হবে।’
নগর বিএনপির সভাপতি শাহাদাত হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার ব্যক্তিগত এবং আমাদের অধিকাংশ নেতাদের মত হচ্ছে- নির্বাচনে না যাওয়া। এরপরও কেন্দ্র থেকে যদি কিছু চাপিয়ে দেয়, সেটা ভিন্ন কথা।’
সর্বশেষ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল। নির্বাচিত মেয়র হিসেবে আ জ ম নাছির উদ্দীন ও কাউন্সিলরেরা শপথ নেন ওই বছরের ২৫ জুলাই। পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্তির পূর্ববর্তী ১৮০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেই হিসেবে ফেব্রুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচন করতে হবে।
চট্টগ্রাম বিএনপি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন চসিক নির্বাচন চসিক নির্বাচনে বিএনপি শাহাদাত হোসেন