যৌথ সংবাদ সম্মেলনে যা বললেন ইশরাক-তাবিথ
৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১৬:৪৩
ঢাকা: ভোটগ্রহণের চারদিন পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এসে ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তরে বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থী ইশরাক হোসেন ও তাবিথ আউয়াল ভোটের নানা ‘অনিয়ম’ ও ‘কারচুপি’ তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেছেন। নিজেদের বক্তব্যের পক্ষে কিছু প্রমাণাদিও উপস্থাপন করেছেন তারা।
বুধবার (০৫ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে গুলশানে ইমানুয়েলস হলে এ সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা হয়। ইশরাক হোসেন ও তাবিথ আউয়ালের সঙ্গে সংবাদ সম্মেলন মঞ্চে ছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
ইশরাক হোসেন বলেন, ‘নগরবাসীর কাছে আমি প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিতে চাই। পহেলা ফেব্রুয়ারি সিটি নির্বাচনে কথা দিয়েছিলাম, ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে নির্বিঘ্নে যাওয়ার, ভোট দেওয়ার এবং বাসায় ফেরার ব্যবস্থা করব। আমি কথা দিয়েছিলাম, জনগণের অধিকার জনগণকে ফিরিয়ে দেব এবং প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে তাদের জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করব। আমি এবার ব্যর্থ হয়েছি, আমি সফল হতে পারিনি।’
তিনি বলেন, ‘গেল সিটি নির্বাচনের দিন নগরবাসীর সঙ্গে অন্যায় করা হয়েছে, তাদের হক কেড়ে নেওয়া হয়েছে। নির্বাচনি প্রচারণার শুরু থেকে আমাদেরকে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছিল। কিন্তু কোনো বাধাকেই বাধা মনে করিনি।’
সদ্যপ্রয়াত পিতার স্মৃতিচারণ করে ইশরাক বলেন, ‘আমার বাবার চলে যাওয়ার তিনমাস পূর্ণ হয়েছে। আমি যখন জেগে থাকি, তখন আমার বাবার কথা আমি মনে করি। উনার কষ্টের শেষ দিনগুলো আমার চোখে ভেসে ওঠে। যখন আমি ঘুমাতে যাই, আমার ঘুমের মধ্যেও আমি তার সেই কষ্টের দিনগুলো, স্মৃতিগুলো আমার চোখে ভেসে ওঠে।’
‘কিন্ত এর মধ্যেও প্রতিদিন সকালে আমি ঘুম থেকে উঠে হাসিমুখে নির্বাচনের প্রচারণা চালিয়েছি টানা ২১ দিন। হেঁটেছি প্রায় ৬০০ কিলোমিটার। যতদিন পার হয়েছে প্রচারণার, আমাদের ভালাবাসা বেড়েছে, জনগণের কাছ থেকে আমরা ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। ধানের শীষের পক্ষে ব্যাপক গণজোয়ার সৃষ্টি করতে পেরেছিলাম আমরা’— বলেন ইশরাক।
তিনি বলেন, ‘এগুলো দেখে ক্ষমতাসীনরা নানা কূট-কৌশল প্রয়োগের চেষ্টা করেছে। সব কিছুতে ব্যর্থ হয়ে নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রগুলো তারা সকাল সকাল দখল করার পাঁয়তারা করেছে। আমরা দেখেছি, ভোটের আগের রাতে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল থেকে বহিরাগত সন্ত্রাসীদের ভাড়া করে এনে ঢাকায় জড়ো করা হয় এবং ভোটের দিন সকাল বেলা সন্ত্রাসীরা নৌকার ব্যাজ পরে বিভিন্ন কেন্দ্রে মহড়া দিতে থাকে। এ সব দেখে আমাদের ভোটাররা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে।’
ইশরাক বলেন, ‘আমি সকাল বেলা ভোট দিয়ে সারাদিন কেন্দ্র থেকে কেন্দ্র ঘুরে বেড়িয়েছি। দখলমুক্ত করেছি একের পর এক ভোটকেন্দ্র। কিন্তু আমি বেরিয়ে যাওয়ার পর সেগুলো আবার দখল হয়ে যায় এবং চলে জাল ভোটের মচ্ছব। পুরোটা দিন আমি পুলিশ প্রশাসন, নির্বাচনি কর্মকর্তা এবং নির্বাচনে সহায়তাকারী অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে অসহায়ত্ব ও হতাশা দেখেছি। তাদের কিছু করার ছিল না। কারণ, ওপর থেকে নির্দেশ এসেছে।’
বাংলাদেশের সকল প্রতিষ্ঠানকে আজ্ঞাবহ হতে বাধ্য করা হয়েছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু ভোটার সাহস করে ভোটকেন্দ্রে যেতে থাকে। এটি দেখে ক্ষমতাসীনরা ধরে নেয়, হয়ত ধানের শীষকে আর আটকে রাখা যাবে না। তাই বেলা ১২টার মধ্যে ভোটকেন্দ্রগুলোর গেট বন্ধ করে দেয় এবং আমাদের পোলিং এজেন্টদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে বের করে দেওয়া হয়। প্রিসাইডিং অফিসাররা অসহায় হয়ে আমাদের বলেছেন, তাদের কিছু করার নেই। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থেকেছেন একে অপরের দিকে।’
ইভিএম মেশিনে ভোটগ্রহণ পুরোপুরি ব্যর্থ প্রমাণ হয়েছে মন্তব্য করে ইশরাক বলেন, ‘প্রথমত কন্ট্রোল ইউনিটিতে ফিঙ্গার প্রিন্ট দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা বুথে ঢুকে ভোটটি দিয়ে দেয়। অথবা তারা সেখানে আগে থেকেই বসে থাকে। কনফার্মেশন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা ভোটটি দিয়ে দেয়। দ্বিতীয়ত অনেক কেন্দ্রে ইভিএম এ ধানের শীষ প্রতীক রাখাই হয়নি, প্রোগ্রামিং করা হয়।’
‘ইভিএমকে ত্রুটিযুক্ত ও সম্পূর্ণ অকার্যকর মেশিন হিসেবে আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘ভোটার উপস্থিতি একেবারেই কমে যাওয়াতে কাস্টেড ভোট ১০ শতাংশের অনেক কম হয়েছে। যার কারণে পরবর্তীতে বিশেষ কোড ব্যবহার করে প্রিসাইডিং অফিসারদের ভোট দিতে বাধ্য করা হয়েছে।’
নগরবাসীর উদ্দেশে ইশরাক বলেন, ‘আমাদের অর্জন কম নয়। আমরা নগরবাসী ও দেশবাসীকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি, তাদের মৌলিক অধিকার আজ আর নেই। আমি আশা করি, মানুষ তাদের মৌলিক অধিকার রক্ষায় আবারও স্বোচ্চার হবে। আমি সেই দিনটির অপেক্ষায় রইলাম।’
ঢাকা উত্তরের বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল বলেন, ‘গত ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রাথমিক যে ফলাফল ঘোষণা হয়েছে, সেটা আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাখান করছি। আজ অফিসিয়ালি আমি ফলাফল প্রত্যাখান করছি। পাশাপাশি দাবি করছি নির্বাচন সংক্রান্ত সব কর্মকাণ্ড নির্বাচন কমিশন বন্ধ রাখবে এবং ইভিএম-এর কন্ট্রোল ইউনিট স্লিপসহ সব তথ্য জনগণের সামনে পরিস্কারভাবে পেশ করবেন।’
নির্বাচনের দিনটা শুরু হয়েছে ব্যাপক পরিকল্পিত হামলার মাধ্যমে—এমন অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘ওই দিন গণমাধ্যমের অনেক কর্মী আহত হয়েছেন। আমাদের পোলিং এজেন্ট যারা যথা সময়ে কেন্দ্রে হাজির হয়েছিলেন, তাদেরকে কেন্দ্রে থেকে জোর করে বের করে পেটানো হয়েছে।’
হামলার নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে জোরাল দাবি পেশ করছি, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে আসামিদের যতদ্রুত সম্ভব গ্রেফতার করুন। আমি উল্লেখ করতে চাচ্ছি, কেবল পুলিশকে মারার অভিযোগে একজন কারাগারে যাবে, কিন্তু সাংবাদিক মারার অভিযোগে কারো কোনো শাস্তি হবে না, সেটা কোনো গণতান্ত্রিক দেশে মেনে নেওয়া যাবে না। আমরা মেনে নেবও না।’
তাবিথ বলেন, ‘ইলেকশনের আগে থেকেই হুমকি ছিল ভোট কেন্দ্র আওয়ামী লীগ দখল করবে, পেশিশক্তি ব্যবহার করবে। এমন মন্তব্য আমরা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের মুখ থেকে শুনেছি। সেই ঘোষণা অনুযায়ী ভোটের দিন সকাল থেকেই সব ভোট কেন্দ্রের বাইরে হাজার হাজার গুণ্ডার অবস্থান ছিল। গেট ভেঙে ফেলা হয়। কেন্দ্রের ভেতরে ভোটার প্রবেশ করতে দেওয়া হয় নাই। আওয়ামী লীগের পরিকল্পনা ছিল কোনো ভোটাররা যেন ভোট দিতে না পারে। কারণ, তাদের সব চেয়ে বড় ভয় ভোটারদের।’
কেন্দ্রের সামনে কৃত্রিম লাইন তৈরি করে ভোটারদের ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ করেন তাবিথ। তিনি বলেন, ‘একজন পোলিং এজেন্ট এসেই যদি দেখে পোলিং এজেন্টদের ওপর হামলা হচ্ছে তাহলে পোলিং এজেন্ট সেখানে থাকবে কী করে? সাংবাদিকরা যদি এসে দেখে সাংবাদিকদের ওপর হামলা হচ্ছে, তাহলে উনারা ওখানে থাকবেন কী করে? সকাল ৮ টার মধ্যে হামলার চিত্র দেখে সবার মধ্যে ধারণা জন্মেছিল যে, ভোট কেন্দ্রে নিরাপত্তা নেই, সেখানে যাওয়া যাবে না।’