করোনাভাইরাস: যেভাবে স্ক্রিনিং চলছে শাহজালালে
৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১৯:১৪
ঢাকা: চীন থেকে শুরু করে বিশ্বের ২৫টি দেশে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস পরিস্থিতির অবনতি ঘটছেই। চীনে প্রতিদিনই এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছেই। এ পরিস্থিতিতে চীনের সঙ্গে যোগাযোগব্যবস্থায় বিশেষ সতর্কতা গ্রহণ করেছে অনেক দেশই। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্পর্কও যথেষ্ট জোরদার। দেশটিতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশি শিক্ষার্থীও পড়ালেখা করছেন।
https://youtu.be/EN-bA0XtMuY
এ পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে চীন থেকে আসা যাত্রীদের মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে কি না— এমন আশঙ্কা ছিল শুরু থেকেই। আর সে কারণেই করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় বাংলাদেশেও। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বসানো হয় থার্মাল স্ক্যানার, যাত্রীদের স্ক্রিনিংয়ে নিয়োজিত করা হয় মেডিকেল টিম। তবে বিমানবন্দরে আগত যাত্রীদের ঠিকমতো স্ক্রিনিং করা হচ্ছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই অভিযোগ করেন, আদৌ স্ক্রিনিং কার্যক্রম চলছে না শাহজালালে। থার্মাল স্ক্যানারের ব্যবস্থাপনা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
বিমানবন্দরে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ধরনের অভিযোগ অমূলক। স্ক্রিনিং কার্যক্রমের সবগুলো ধাপ দৃশ্যমান নয় বলেই অনেকের মনে প্রশ্ন উঠতে পারে। তবে স্ক্রিনিং ছাড়া কোনো যাত্রীই বিমানবন্দর পেরিয়ে আসতে পারছেন না। বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সরেজমিনে পরিদর্শন করেও দেখা গেল তেমন চিত্র। বিভিন্ন ফ্লাইটে আগত যাত্রীদের স্ক্রিনিংয়ের ধাপগুলোও বর্ণনা করলেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা।
স্ক্রিনিংয়ের প্রথম ধাপ থার্মাল স্ক্যানার
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ফ্লাইট বিমানবন্দরে অবতরণের পর যাত্রীদের বিমান থেকে নেমে যেতে হয় ইমিগ্রেশন ডেস্কে। সেই ডেস্কে পৌঁছানোর আগেই চোখে পড়বে দু’টি আর্চওয়ে। কেবল যাত্রী নয়, বিমানে করে আসা পাইলট ও ক্রুসহ সব কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও বিমানবন্দরে আসতে হয় সেই আর্চওয়ে পেরিয়েই। বিমানবন্দরেরর সবগুলো অ্যারাইভাল গেটেই রয়েছে এমন আর্চওয়ে। নিরাপত্তার খাতিরে বিভিন্ন স্থানেই এমন আর্চওয়ে বসানো হলেও বিমানবন্দরের অ্যারাইভাল গেটগুলোতে বসানো এসব আর্চওয়ে হিসেবে স্থান করে নিয়েছে থার্মাল স্ক্যানার।
সরেজমিনে দেখা গেল, পাশাপাশি দুইটি থার্মাল স্ক্যানারের মধ্যে কাজ করছে একটি, অন্যটি বন্ধ রাখা হয়েছে। যেটি চালু আছে, সেটি দিয়েই যাত্রীরা ঢুকছেন ইমিগ্রেশন ডেস্কে। তবে নির্দিষ্ট সময় পর এই স্ক্যানার বন্ধ করে দিয়ে চালু করা হচ্ছে অন্য স্ক্যানারটি। সংশ্লিষ্টরা জানালেন, যাত্রীর চাপ বেশি থাকলে দু’টি স্ক্যানার একসঙ্গেই চালু করে দেওয়া হয়।
যেভাবে কাজ করছে থার্মাল স্ক্যানার
থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে কোনো যাত্রী প্রবেশের সময় সাদা চোখে কোনো ধরনের সিগন্যাল চোখে পড়ল না। স্ক্যানার পেরিয়ে যাওয়ার সময় কোনো সংকেতও চোখে পড়ল না। তবে এই থার্মাল স্ক্যানার করছেটা কী? জবাব দিলেন বিমানবন্দরের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. শাহরিয়ার সাজ্জাদ। আর্চওয়ের ঠিক সামনের ডেস্কটি দেখিয়ে বললেন, সেটি হেলথ ডেস্ক। সেখানে রয়েছে বিশেষ মনিটর, থার্মাল স্ক্যানারের সিগন্যালগুলো মূলত দৃশ্যমান ওই মনিটরে। কোন যাত্রীর শরীরের তাপমাত্রা কেমন, চারটি ভিন্ন ভিন্ন রঙে ওই মনিটরে ফুটে উঠছে তার চিত্র।
কোন রঙের কী অর্থ
নীল: একজন যাত্রীর শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক থাকলে থার্মাল স্ক্যানারের মনিটরে ফুটে ওঠে নীল রঙ। অর্থাৎ মনিটরে নীল রঙ দেখালে বুঝতে হবে, যে ব্যক্তিটি স্ক্যানার পার হয়েছেন, তার শরীরের তাপমাত্রা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।
সবুজ: কারও শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চাইতে একটুখানি বেশি হলে মনিটরে সবুজ রঙ ফুটে ওঠে। হেলথ ডেস্কে কর্মরতরা জানালেন, এ ক্ষেত্রেও যাত্রীর শরীরের তাপমাত্রা থাকতে ৯৯ ডিগ্রি ফারেনহাইটের চেয়ে কম।
হলুদ: থার্মাল স্ক্যানারের মনিটরে হলুদ রঙ ফুটে ওঠার অর্থ হলো স্ক্যানার পার হওয়া যাত্রীর শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকটাই বেশি— সেটা ৯৯ থেকে ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের মধ্যে।
লাল: থার্মাল স্ক্যানারের মনিটরের লাল রঙ হলো বিপদসংকেত। এর অর্থ, ওই ব্যক্তির শরীরের তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের চেয়ে বেশি। অর্থাৎ তার শরীরে জ্বর রয়েছে। এরকম কোনো যাত্রী স্ক্যানার পার হলে একটি অ্যালার্মও বেজে ওঠে। সেক্ষেত্রে হেলথ ডেস্কে কর্মরতরা ওই ব্যক্তিকে নিয়ে যান পর্যবেক্ষণের জন্য।
বাড়তি তাপমাত্রা মানেই কি বিপদ?
থার্মাল স্ক্যানারে কোনো যাত্রীর শরীরের তাপমাত্রা বেশি পাওয়া মানেই তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত, এমন নয়। ডা. শাহরিয়ার সাজ্জাদ জানালেন, ভ্রমণের ধকলের কারণেও অনেকের শরীরের তাপমাত্রা বাড়তি থাকতে পারে। তাই থার্মাল স্ক্যানার পেরিয়ে আসার সময় এমন কাউকে পেলে তখন তাকে নিয়ে হেলথ ডেস্ক কাজ শুরু করে। তবে থার্মাল স্ক্যানার হলো একদম প্রাথমিক ধাপ।
স্ক্রিনিংয়ের দ্বিতীয় ধাপে স্বাস্থ্য পরীক্ষা
শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি— এমন যাত্রীকে শুরুতেই হেলথ ডেস্কে নিয়ে ইনফ্রারেড থার্মোমিটারের মাধ্যমে ফের তার শরীরের তাপমাত্রা নেওয়া হয়। একইসঙ্গে তার মেডিকেল হিস্ট্রিও জেনে নেন হেলথ ডেস্কের দায়িত্বরতরা। তার হেলথ ফরমটিও পূরণ করানো হয়। সব তথ্য নিয়ে ওই ব্যক্তিকে পাঠানো হয় স্ক্রিনিং সেন্টারে। তার শরীরে ভাইরাসজনিত কোনো উপসর্গ রয়েছে কি না, তার সার্বিক একটি পরীক্ষা চলে সেখানে। একইসঙ্গে খবর দেওয়া হয় বিমানবন্দরের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এবং জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানকেও (আইইডিসিআর)। স্বাস্থ্য পরীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্য থেকেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, ওই ব্যক্তির ভাইরাসে আক্রান্ত থাকার আশঙ্কা কতটুকু। সে অনুযায়ী তাকে পর্যবেক্ষণের জন্য হাসপাতালে পাঠানোর বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অবশ্য সরাসরি চীন থেকে আসা কারও শরীরে জ্বর পাওয়া গেলে তাকে বিমানবন্দরের স্ক্রিনিং সেন্টারে না নিয়ে সরাসরি হাসপাতালেই স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয় বলে জানালেন হেলথ ডেস্কের দায়িত্বপ্রাপ্তরা।
একই ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে বিমানবন্দরের ভিআইপি আগমনী গেটেও। সেখানেও ইমিগ্রেশনের আগেই বসানো আছে একটি থার্মাল স্ক্যানারের আর্চওয়ে, এরপর হেলথ ডেস্ক। ভিআইপি টার্মিনাল দিয়ে আসা প্রতিটি যাত্রীকেই সেই আর্চওয়ে আর হেলথ ডেস্ক পেরিয়েই ইমিগ্রেশনে যেতে হয়।
বিমানবন্দরের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. শাহরিয়ার সাজ্জাদ সারাবাংলাকে বলেন, কেবল চীন থেকে আসা বিমানগুলোই নয়, আমরা সব বিমানের যাত্রীদের দিকেই খেয়াল রাখছি। একইসঙ্গে বিভিন্ন কানেক্টিং ফ্লাইটের যাত্রীদেরও মনিটরিং করছি। দেখা গেল, কেউ চীন থেকে ভারতে গেছেন। এরপর সেখান থেকে বাংলাদেশে আসছেন। সেক্ষেত্রেও আমরা একই স্ট্যান্ডার্ড বজায় রেখেই কাজ করে যাচ্ছি।
বিমানবন্দরের হেলথ ডেস্কে কতজন চিকিৎসক নিয়ে কাজ করছেন— এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. সাজ্জাদ বলেন, রোববার (২ ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত তিন জন চিকিৎসক ছিলেন। পরে আরও দু’জন যোগ দেন তাদের সঙ্গে। বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) আরও ১০ জন চিকিৎসক যোগ দিয়েছেন।
বিমানবন্দরে যাত্রীদের স্ক্রিনিং নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এই চিকিৎসক বলেন, থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে কেউ প্রবেশ করলে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু একটা দৃশ্যমান হয়ে উঠবে— এমন একটি ধারণা হয়তো সবার আছে। কিন্তু বাস্তবতা তেমন নয়। থার্মাল স্ক্যানার তো নিজে থেকে কিছু করে না, আলাদা ডিসপ্লে মনিটর দিয়ে তার কাজ মনিটরিং করা হয়। আমরা এটুকু বলতে পারি, আমাদের পক্ষ থেকে যতটুকু সম্ভব, দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। স্ক্রিনিং ছাড়া কোনো যাত্রীই বেরিয়ে যেতে পারছেন না।
ডা. সাজ্জাদ আরও বলেন, হেলথ ডেস্কে আলাদা খাতা মেইনটেইন করা হচ্ছে। বিদেশ থেকে যাত্রীদের হেলথ কার্ড দেওয়া হচ্ছে। সেখানে সংশ্লিষ্ট সব ধরনের যোগাযোগের নম্বর দেওয়া আছে। আবার আমাদের এখানকার তথ্য আমরা আইইডিসিআরকে দিচ্ছি। অর্থাৎ আমাদের পক্ষে যা কিছু করার আছে, আমরা করে যাচ্ছি।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক এয়ার উইং কমান্ডার তৌহিদ উল আহসান সারাবাংলাকে বলেন, করোনাভাইরাস শনাক্ত করতে বিমানবন্দরে স্থাপিত থার্মাল স্ক্যানার একটি যুগোপযোগী ব্যবস্থা। এর বাইরেও স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা আছে। এখানে সবাইকে যথাযথভাবে চেকিং করেই দেশে প্রবেশ করানো হচ্ছে। আমরা সতর্ক আছি, ভবিষ্যতেও সতর্ক থাকব।
বিমানবন্দর সূত্রে জানা গেছ, মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত বিমানবন্দরে চীন থেকে আসা ৭ হাজার ২৮৪ জনকে স্ক্রিনিং করা হয়েছে। তাদের কারও শরীরে করোনাভাইরাস পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে আইইডিসিআর। গত ১ ফেব্রুয়ারি চীন থেকে ফিরিয়ে আনা ৩১২ বাংলাদেশির কারও শরীরেই এখনো করোনাভাইরাস সংক্রমণের কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি।