কারাগারে খালেদার ২ বছর: কী ভাবছেন বিএনপি নেতারা?
৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০১:১৭
ঢাকা: বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কারাবাসের দুই বছর পূর্ণ হচ্ছে শনিবার (৮ ফেব্রুয়ারি)। ২০১৮ সালের এই দিনে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে যান তিনি। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন খালেদা জিয়া।
দলের চেয়ারপারসনকে মুক্ত করতে গত দুই বছর ধরে আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি বেশকিছু রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি। কিন্তু কোনো সুবিধা করতে পারেনি। বিএনপির আইনি লড়াই ও আন্দোলন-সংগ্রাম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা তো দূরের কথা সরকারের ওপর ন্যূনতম চাপও সৃষ্টি করতে পারেনি।
খালেদা জিয়ার কারাবন্দির ১১ মাসের মাথায় অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং দুই বছর পূর্তির প্রাক্কালে অনুষ্ঠিত ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। এ দুটি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দলটির নেতারা বলেছেন-‘গণতন্ত্র ও খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলনের অংশ হিসেবেই বিএনপি নির্বাচনে গেছে।’
খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে গত দুই বছর ধরে জনসভা, প্রতিবাদসভা, বিক্ষোভ সমাবেশ, গণঅনশন, প্রতীকী অনশন, গণস্বাক্ষর, গণসংযোগ, মানববন্ধন, বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে ব্রিফসহ ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি। সর্বোপরি জামিনে মুক্তির জন্য আইনি লড়াই অব্যাহত রেখেছে শুরু থেকেই। কিন্তু খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে পারেনি দলটি। ফলে ৩৭ বছরের রাজনৈতিক জীবনে শেষ দুই বছর কারাগারে রয়েছেন খালেদা জিয়া।
খালেদা জিয়ার কারাবন্দির ২ বছর সামনে রেখে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের অন্তত ২০ জন নেতার সঙ্গে কথা হয় সারাবাংলার। দলের চেয়ারপারসনের মুক্তি এবং শারীরিক অবস্থা নিয়ে বিএনপি নেতাদের মধ্যে শঙ্কা যেমন আছে, তেমনি আছে আত্মসমালোচনা ও ব্যর্থতার গ্লানি।
দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতারা মনে করেন, সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিহিংসামূলক আচরণের কারণেই খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা সম্ভব হয়নি। তবে মধ্যম সারি ও মাঠ পর্যায়ের নেতারা মনে করেন, কেবল সরকারের দমননীতি নয়, বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা, সঠিক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারা এবং সরকারের মনোভাব বুঝতে দেরি হওয়ার কারণেই খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা সম্ভব হয়নি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন শুক্রবার সন্ধ্যায় (৭ ফেব্রুয়ারি) সারাবাংলাকে বলেন, ‘নির্বাচনে যাওয়াসহ আমরা সব কিছুই খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলনের অংশ হিসেবে করছি। দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে শনিবার প্রোগ্রাম দিয়েছি। আপাতত এটাই আমাদের কর্মসূচি। এর পরের কর্মসূচি কী হবে— সেটা আগাম বলা যাবে না।’
দলটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত সারাবাংলাকে বলেন, ”ম্যাডাম কবে বের হবেন, কোন প্রক্রিয়ায় বের হবেন— সে বিষয় নিয়ে কথা বলার মতো বড় নেতা আমি নই। তবে মাঠের একজন কর্মী হিসেবে আমার মনে হয়, রাজনৈতিকভাবে বিষয়টি যেভাবে মোকাবিলা করার কথা ছিল বিএনপি সেভাবে করতে পারেনি। দল মনে করেছিল- আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই ম্যাডাম মুক্ত হতে পারবেন। তাই তিনি আটক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনে না গিয়ে আইনি লড়াইয়ে গেছে বিএনপি। বিএনপির বোঝা উচিত ছিল খালেদা জিয়াকে সাজা দেওয়া হয়েছে আইনি প্রক্রিয়ায় মুক্তি দেওয়ার জন্য নয়। এটা বুঝতে আমাদের অনেক সময় লেগেছে। মাঠের একজন কর্মী হিসেবে আমার নিজের দায়িত্বটাও আমি ঠিক মতো পালন করতে পারিনি। আমরা সবাই মিলে ব্যর্থ হয়েছি। এখন যেটা করণীয়, সেটা হলো- দ্রুত দলকে সংগঠিত করে ‘অলআউট’ আন্দোলনে যেতে হবে।”
বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আব্দুস সালাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আন্দোলন-সংগ্রাম বিএনপি কম করেনি। এটা করতে গিয়ে বিএনপির যত নেতাকর্মী আহত হয়েছে, খুন হয়েছে, গুম হয়েছে অন্য কোনো দলের নেতাকর্মীদের বেলায় তা হয়নি। তারপরও বলা হয় বিএনপি আন্দোলন জানে না। আন্দোলন করে না। একটা ফ্যাসিস্ট সরকার যদি ঘাড়ের ওপর চেপে বসে, তাকে নামানোর জন্য আন্দোলন ছাড়া আর কী করার থাকে। বিএনপি তো সশস্ত্র বা বিপ্লবী কোনো পার্টি নয়। নিয়মের মধ্যে থেকেই বিএনপিকে সব কিছু করতে হবে।’
বিএনপির নির্বাহী সদস্য আবু নাসের মোহম্মদ রহমত উল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিএনপি সাংগঠনিকভাবে দুর্বল। আমাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে হবে। আর সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের মূল্যায়ন করতে হবে। তাদের আস্থায় আনতে হবে। বিএনপির কোনো কর্মী গ্রেফতার হলে বা আহত হয়ে হাসপাতালে গেলে দলের শীর্ষ নেতারা তাদের খবর নেয় না। তাদের সহযোগিতা করে না। মাঠ-পর্যায়ের কর্মীদের বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়াতে হবে। তারাই আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করে আনবে।’
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্যাহ বুলু সারাবাংলাকে বলেন, ‘মিথ্যা মামলা আর ফরমায়েশি রায়ের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে আটক রাখা হয়েছে। রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগ যখন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, তখন আর অবশিষ্ট কিছু থাকে না। রাষ্ট্র যদি ন্যূনতম নিরপেক্ষ অবস্থান নিত, তাহলে খালেদা জিয়ার জামিন একদিনের মধ্যেই হয়ে যেত। আমরা আইনে লড়াইয়ে ছিলাম, রাজপথে ছিলাম। কিন্তু সরকার ও বিচার বিভাগের সদিচ্ছার অভাবে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে পারিনি। আমরা তো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, বিপ্লবী বা সশস্ত্র সংগঠন নই। সুতরাং নিয়মতান্ত্রিক পন্থায়-ই আমাদের এগোতে হবে।’
‘তাছাড়া আমরা মনে করি, সুষ্ঠু ভোট হলেই খালেদা জিয়া মুক্ত হতে পারতেন। কারণ, সুষ্ঠু ভোটের মাধ্যমেই ক্ষমতার পরিবর্তন হবে। ক্ষমতার পরিবর্তন হলে খালেদা জিয়াকে কেউ আটক রাখতে পারবে না। সেজন্যই আমরা ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ঢাকা সিটি নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলাম। সেই নির্বাচন কেমন হয়েছে, তা সবাই দেখেছে। এখন আমরা চেষ্টা করছি দল গোছাতে। দল গোছানো হলেই আন্দোলনে যাব’— বলেন বরকত উল্যাহ বুলু।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব চাপাইনবাবগঞ্জ-৩ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘খালেদা জিয়ার মুক্তি কোন পথে হবে— সেটা নিয়ে কথা বলার জন্য দলের দায়িত্বশীল নেতারা আছেন। তারাই এসব ব্যাপারে কথা বলবেন। ফোনে আমি কোনো কথা বলতে পারব না, বলা ঠিক হবে না। কারণ, ফোন ট্রাক হয়।’
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আন্দোলনের মাধ্যমে বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে হলে সবার আগে ঢাকা ঠিক করতে হবে। আর ঢাকা ঠিক করার জন্য একটা ভালো সুযোগ আমাদের সামনে এসেছে। সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ঢাকার মানুষ যেভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, এটাকে কাজে লাগাতে হবে। দ্রুত সংগঠন গোছাতে হবে। আমাদের যে দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে উঠতে হবে। ঢাকা ঠিক হলে সারাদেশ ঠিক হয়ে যাবে। ঢাকায় একটা ম্যাসিভ প্রোগ্রাম দিতে হবে। মানুষের আবেগ, ভালো লাগা কাজে লাগাতে হবে।’