Sunday 29 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ: ইলিশ উৎপাদনে সাম্প্রতিক অর্জন


২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১১:১৪

ড.ইয়াহিয়া মাহমুদ

আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি হতে ০২ মার্চ ২০১৮ মেয়াদে দেশব্যাপী জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ উদযাপিত হবে। জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহের এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে- জাটকা ধরে করবো না শেষ, বাঁচবে জেলে হাসবে দেশ। ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধিতে জাটকা রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করা এবং প্রচার ও প্রচারণার মাধ্যমে বিষয়টিকে সামাজিক আন্দোলনে রূপ দেয়াই এ সপ্তাহের মূল উদ্দেশ্য। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এ উপলক্ষে দেশব্যাপি ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করেছে।
ইলিশের ডিম পরিস্ফুটনের মাধ্যমে ইলিশের বাচ্চা ‘‘জাটকা” তৈরি হয়। ইলিশের পোনাকে (১০ইঞ্চি/২৫সেন্টিমিটার এর নীচে) জাটকা বলা হয়।

বিজ্ঞাপন

আজকের জাটকাই আগামী দিনের ইলিশ। জাটকা নির্বিচারে ধরা হলে ইলিশের উৎপাদন কমে যায়। জাটকা নদ-নদীতে বিচরণ করে। তখন জেলেরা নির্বিচারে জাটকা আহরণ করতে চায়। নির্বিচারে জাটকা ধরা হলে ইলিশ উৎপাদন ও আহরণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কেননা জাটকা মাছ ইলিশ মাছের নতুন প্রজন্মের প্রবেশন স্তর।

ইলিশের জীবন চক্র বৈচিত্র্যময়। এরা সাগরের লোনাপানিতে বসবাস করে; প্রজনন মৌসুমে ডিম দেয়ার জন্য উজান বেয়ে মিঠা পানিতে মিঠাপানিতে ডিম দেয়ার পর ২২-২৬ ঘণ্টার মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা হয় এবং ৫-১৫ সেন্টিমিটার আকার পর্যন্ত ৫-৭ মাস এরা নদীতে থাকে। পরবর্তীতে আবার সাগরের দিকে ধাবিত হয়। ইলিশ ১-২ বছর বয়সে (২২-২৫ সেন্টিমিটার আকারে পুরুষ ; ২৮-৩০ সেন্টিমিটার আকারের স্ত্রী) প্রজননক্ষম হয়। তখন এরা আবার মিঠাপানির দিকে যায়। তখনই সাগর মোহনায় স্ত্রী ইলিশ মাছ অপেক্ষাকৃত বেশী ধরা পড়ে। ইলিশ মাছ সারা বছরই কম বেশী ডিম দেয়; তবে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরই হচ্ছে ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম। অক্টোবর অর্থাৎ আশ্বিন মাসের ১ম পূর্ণিমার ভরা চাঁদে ওরা প্রধানত: ডিম ছাড়ে। এজন্য আশ্বিনের বড় পূর্ণিমার পূর্বের ৪দিন এবং পরের ১৭ দিন (৪+১+১৭) ইলিশ আহরণ, বিতরণ, বিপণন, পরিবহন, মজুদ ও বিনিময় কার্যক্রম বন্ধ থাকে। এ লক্ষ্যে গত ০১ অক্টোবর হতে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত দেশব্যাপী মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান পালিত হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

দেশের ২৭ জেলায় ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্র প্রায় ৭ হাজার বর্গকিলোমিটার। জেলাগুলো হচ্ছে- চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম,কক্সবাজার, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, শরীয়তপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া,
ঢাকা, মাদারীপুর, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, জামালপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, খুলনা, কুষ্টিয়া ও রাজশাহী। ইলিশ প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত এলাকাসমূহ হচ্ছে-ভোলা জেলার মুনপুরা ও ঢালচর এবং নোয়াখালী জেলার হাতিয়া, কালিরচর ও মৌলভীরচর।

ইলিশের মোট আয়ুষ্কাল ৫-৭ বছর। আহরিত ইলিশের শতকরা ৯০ ভাগ ৩০-৫০ সেন্টিমিটার আকারের হয়ে থাকে। বাংলাদেশে মোট ৩ প্রজাতির ইলিশ পাওয়া যায়; এর মধ্যে ২টি (চন্দনা ও গোর্তা ইলিশ) সারাজীবন উপকূল ও সাগরে কাটায় এবং অপর ১টি মিঠাপানি ও লোনাপানিতে জীবন অতিবাহিত করে। ইলিশ স্রোতের বিপরীতে দৈনিক ৭০ কিলোমিটার অভিপ্রয়ান করতে পারে।

পৃথিবীর মোট ১১টি দেশে বর্তমানে ইলিশ পাওয়া যায়। দেশগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, কুয়েত, বাহরাইন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড। বিশ্বে আহরিত ইলিশের প্রায় ৭০% বাংলাদেশ আহরণ করে; দ্বিতীয় অবস্থানে আছে মিয়ানমার (২০-২৫%) এবং ৩য় অবস্থানে ভারত (১০-১৫%)। ইলিশ উৎপাদনকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়া অপর ১০টি দেশেই ইলিশ উৎপাদন কমেছে। সুষ্ঠু ও সঠিক ইলিশ ব্যবস্থাপনা কৌশল বাস্তবায়নের কারণে একমাত্র বাংলাদেশেই ইলিশ উৎপাদন ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে ৩২ শতাংশ বেড়ে প্রায় ৫ লক্ষ মে.টনে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা তথ্য মতে, ১০ বছর আগে দেশের ২১টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যেত। বর্তমানে ১২৫টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে।

পদ্মার শাখা নদী মহানন্দা ও তিস্তা নদী এবং মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওড় এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেদির হাওড়েও ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, গবেষণা তথ্যের ভিত্তিতে মৎস্য অধিদপ্তর, প্রশাসন ও বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক ইলিশ ব্যবস্থাপনা কৌশল সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করায় দেশব্যাপী ইলিশের বিস্তৃতি ও উৎপাদন বেড়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২.৯৯ লক্ষ মে.টন; ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে তা হয় ৩.৯৫ লক্ষ মে.টন। ২০১৬-১৭ সালে তা ৪.৯৬ লক্ষ মে.টনে উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ বিগত ৮ বছরের ব্যবধানে দেশে ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৬৬ শতাংশ-যা বর্তমান সরকারের অন্যতম একটি সাফল্য। মা ইলিশ ও জাটকা সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণের ফলে দেশে ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় ভারত এখন বাংলাদেশের ইলিশ ব্যবস্থাপনা কৌশল অনেকাংশে অনুসরণ করছে। ইলিশ উৎপাদনকারী অন্যান্য দেশও বর্তমানে বাংলাদেশকে ইলিশ উৎপাদনের রোল মডেল হিসেবে বিবেচনা করছে। গত ২০১৬ সালে ইলিশ ভৌগলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধিতে অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা ফলাফলের ভিত্তিতে দেশে ইলিশের ৬ষ্ঠ অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। প্রস্তাবিত ৬ষ্ঠ অভয়াশ্রমের জন্য চিহ্নিত এলাকাগুলো হচ্ছে- বরিশাল জেলার সদর ও হিজলা উপজেলার কালাবদর নদীর ১৩.১৪ বর্গ কিলোমিটার, মেহেদিগঞ্জ ও হিজলা উপজেলার গজারিয়া ও মেঘনা নদীর যথাক্রমে ৩০ এবং ২৭৪.৮৬ বর্গ কিলোমিটার। প্রস্তাবিত ৬ষ্ঠ অভয়াশ্রম এলাকার নদীসমূহের মোট দৈর্ঘ্য হচ্ছে ৮২ কি.মি. এবং আয়তন ৩১৮ বর্গ কিলোমিটার। প্রস্তাবটি আইনে পরিণত হলে এ এলাকাতেও মার্চ – এপ্রিল মাসে ইলিশ মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকবে। এতে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার জাটকা ইলিশ জনতায় যুক্ত হবে।

বর্তমানে দেশে জেলেদের জীবনমান উন্নয়নের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকৃত মৎস্যজীবী ও জেলেদের প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিতকরণে মৎস্য অধিদপ্তর থেকে ইতোমধ্যে ১৬ লক্ষ ২০ হাজার মৎস্যজীবী ও জেলেদের নিবন্ধন সম্পন্ন হয়েছে এবং ১৪ লক্ষ ২০ হাজার জেলের মাঝে পরিচয়পত্র বিতরণ করা হয়েছে।

ইলিশ সম্পদ ব্যবস্থাপনা বর্তমান সরকারের একটি অগ্রাধিকারমূলক কার্যক্রম। এ লক্ষ্যে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জাটকাসমৃদ্ধ ১৭ জেলার ৮৫টি উপজেলায় জাটকা আহরণে বিরত ২ লক্ষ ৩৮ হাজার ৬৭৩টি জেলে পরিবারকে মাসিক ৪০ কেজি হারে ৪ মাসের জন্য মোট ৩৮ হাজার ১৮৮ মেট্রিকটন চাল প্রদান করা হয়েছে। জাটকা আহরণ নিষিদ্ধ কালীন সময় ছাড়াও ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে মা ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধ কালীন ২২ দিনের জন্য পরিবার প্রতি ২০ কেজি হারে মোট ৩ লক্ষ ৫৬ হাজার ৭২৩টি পরিবারকে মোট ৭,১৩৪ মেট্রিক টন ভিজিএফ খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। অর্থাৎ ২০০৮-০৯ থেকে ২০১৬-১৭ সাল পর্যন্ত এ সরকারের বিগত ৯ বছরে এ সহায়তা দেওয়া হয়েছে ২ লক্ষ ৩৪ হাজার ৭৫৭ মেট্রিকটন। বর্তমান সরকারে যুগোপযোগী এসব সমাজবান্ধব কার্যক্রম বাস্তবায়ন এবং জাটকা ও মা ইলিশ সুরক্ষার ফলে
২০১৬-১৭ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে ৪ লক্ষ ৯৬ হাজার ৪১৭ মেট্রিকটনে উন্নীত হয়েছে।

বিগত বছরে ইলিশ উৎপাদনের সফলতা জেলে সম্প্রদায়ের মাঝে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। জেলেরা অনেকেই এখন বুঝতে পারছে, জাটকা ও মা ইলিশ সঠিকভাবে সুরক্ষা করতে পারলে বর্ধিত হারে ইলিশ উৎপাদনের সুফল তারা নিজেরাই ভোগ করতে পারবে। এজন্য জেলেরাও অনেক ক্ষেত্রে সংঘবদ্ধ হয়ে জাটকা ও মা ইলিশ রক্ষা করছে। এটি একটি ইতিবাচক দিক।

লেখক: বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী

 

সারাবাংলা/এমএ

জাটকা_সংরক্ষণ_সপ্তাহ

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর