পদ্মাসেতুর ছোঁয়ায় বদলে যাওয়া অনন্য ভাঙ্গা
৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৯:৫৯
ফরিদপুর থেকে ফিরে: দীর্ঘ সাত বছর পর প্রবাস জীবন কাটিয়ে বাড়ি ফিরেছেন নান্নু মিয়া (৩৫)। ঢাকার বিমানবন্দর থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গায় পৌছে হতভম্ব তিনি। গাড়ি থেকে ভাঙ্গা মোড়ে নেমে দিক হারিয়ে ফেলেছেন। যেন চিনতেই পারছেন না, কোথায় এসেছ পৌঁছেছেন। সাত বছর আগে যেমন দেখে গেছেন, তার ছিটেফোটা কোনো চিহ্নও নেই যেন।
নান্নু মিয়ার গ্রামের বাড়ি ভাঙ্গা উপজেলার আতাদী গ্রামে। ভাঙ্গা মোড়ের পাশেই তার গ্রাম, তার ভাষ্যে একসময় যেটি ছিল কেবলই এক চার রাস্তার মোড়। অথচ আজ কেবল বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যেই অনন্য দৃষ্টিনন্দন একটি মোড়ে রূপ নিয়েছে এই ভাঙা। দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ের প্রথমার্ধ শেষ হয়েছে এখানে এসে।
কুমার নদীর পাড়ে অবস্থিত ভাঙ্গা ফরিদপুরের একটি উপজেলা। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র বন্দর মোংলা, সাগরকন্যা কুয়াকাটা আর বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোলের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার যোগাযোগের প্রবেশদ্বার বলা হয় এই উপজেলাটিকে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ২১ জেলার মধ্যে সড়কপথে যোগাযোগ স্থাপন করেছে উপজেলাটি।
ভাঙ্গার গোলচত্বর থেকে ফরিদপুর জেলা সদর, মাদারীপুর, শরিয়তপুর, গোপালগঞ্জ, বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, ভোলা,খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা, মেহেরপুর, নড়াইল, রাজবাড়ী— সবগুলো জেলাতেই যাতায়াত করা যায় খুব সহজে। এসব এলাকার উন্নয়নের কথা মাথায় রেখে বর্তমান সরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নেয়। তারই আলোকে নতুন ও আধুনিক রূপে গড়ে তোলা হয় ভাঙ্গা মোড়।
আলাদা আলাদা চারটি সুপরিসর লেন রয়েছে ভাঙ্গা মোড়ে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই মোড় থেকে যেহেতু প্রায় ২০টির মতো জেলায় যাওয়ার সুযোগ রয়েছে, তাই এই মোড় ঘিরে গাড়ির চাপও থাকে অনেক। ফলে এই মোড়ে এসে যেন যানবাহনকে ট্রাফিক জ্যামে আটকে থাকতে না হয়, সেটি নিশ্চিত করবে লেনগুলো। আলাদা আলাদা লেন হয়ে নির্বিঘ্নে গাড়ি পৌঁছে যাবে গন্তব্যে। তবে হ্যাঁ, লেন ভুল করলে কম করে হলেও ১০ কিলোমিটার সড়ক বাড়তি ঘুরে আসতে হবে।
স্থানীয়রা বলছেন, একটি সড়কের মোড় এত সুন্দর হতে পারে, ভাঙ্গা মোড়ের এখনকার চিত্র না দেখলে তা বিশ্বাস করাই কঠিন। নান্নুর মিয়া বলছেন, প্রবাস জীবনে তিনি ছিলেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে। ভাঙ্গা মোড়কে তিনি সেখানকার দুবাই শহরের এক্সপ্রেসওয়ের মোড়গুলোর সঙ্গে তুলনা করছেন। দেশে ফিরে বাড়ির পাশেই এইরকম একটি দৃষ্টিনন্দন সড়ক পাবেন, সেটি কল্পনাতেও ছিল না বলে জানান নান্নু মিয়া।
ভাঙ্গা মোড়ের এমন বদলে যাওয়ার খবর অবশ্য চাপা নেই। ফরিদপুর শুধু নয়, আশপাশের জেলাগুলোর অনেকেই ভাঙ্গা মোড়ের এমন অভাবিত উন্নয়নের কথা জেনেছেন। আর সে কারণেই এই মোড়টি দেখতেই প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন অনেকেই। নান্নু মিয়ার মতো তাদেরও চোখ ধাঁধিয়ে যায় ভাঙ্গা মোড়ের চেহারায়।
ঢাকা থেকে পদ্মাসেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলা পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার পথ হচ্ছে দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে। এশিয়ান হাইওয়ের করিডোর-১-এর অংশ এই সড়কটি।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, চারটি রাস্তা এসে মিলেছে ভাঙ্গা মোড়টিতে। এর মধ্যে উত্তর দিকের সড়কটি ফরিদপুর জেলা সদর হয়ে দৌলতদিয়া ঘাট পেরিয়ে ঢাকায় যুক্ত হয়েছে। পশ্চিম দিকের সড়কটি খুলনা-বাগেরহাট-যশোর হয়ে বেনাপোলের সঙ্গে মিশেছে। দক্ষিণের সড়কটি গোপালঞ্জ-মাদারীপুর হয়ে চলে গেছে বরিশাল। আর পূর্ব দিকের সড়কটি পদ্মাসেতু হয়ে ঢাকায় এসে মিলেছে। এই অংশটুকুই এক্সপ্রেসওয়ের অংশ।
ভাঙ্গা গোল চত্বরটির চারপাশে চারটি আন্ডারপাস, একটি ফ্লাইওভার ও চারটি করে পৃথক লেন নির্মাণ করা হয়েছে, যেন কোনো গাড়িকে সিগন্যালে না পড়তে হয়। প্রতিটি লাইনের গাড়ি তার লেন ধরে চললে কোনো ধরনের যানজটে না আটকেই চলে যেতে পারবে গন্তব্যে।
এদিকে ঢাকা থেকে পদ্মাসেতু হয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের কর্মযজ্ঞও চলছে। ভাঙ্গায় একটি জংশনসহ ঢাকার কেরাণীগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর, মাওয়া, শিবচর ও সিরাজদিখানের নিমতলায় একটি করে স্টেশন নির্মাণের কাজ চলছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে নতুন দিগন্তের উন্মোচন হবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
ভাঙ্গা থানার সদরদি গ্রামের বাসিন্দা ভ্যানচালক সেলিম ব্যাপারি বললেন, ভাঙ্গায় যে উন্নয়ন, জীবনে কোথাও দেখেনি। উন্নত সড়ক দেখতে আমাগো আর বিদেশ যাওয়া লাগব না। বিদেশের মতো সড়ক এখন আমাগো বাড়ির পাশেই।
এক্সেপ্রেসওয়েতে ভ্যান চালানোয় নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সেলিম ব্যাপারি বলেন, সমস্যা নাই। আমাগো ভ্যান চালানোর জন্য তো পৃথক লেন আছে। আমরা সেখান দিয়েই চালাব।
রেলসহ এক্সেপ্রেসওয়ে চালু হলে কেবল ভাঙ্গা নয়, এর আশপাশের গোটা অঞ্চলের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় আসবে পরিবর্তন। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ অত্যন্ত অল্প সময়ে চলে আসতে পারবেন ঢাকায়। পণ্য পরিবহনের সময় প্রত্যাশার অতীত কমে যাওয়ায় এ অঞ্চলের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে। এরই মধ্যে এই সম্ভাবনা আঁচ করতে পেরেই বদলে যেতে শুরু করেছে অঞ্চলটি। পদ্মাসেতুকে কেন্দ্র করে মাদারীপুর, ফরিদপুর, শরীয়তপুরসহ আশপাশের জেলাগুলোতে গড়ে তোলা হচ্ছে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান, নির্মাণ করা হচ্ছে শপিংমলসহ হোটেল-মোটেল। স্থানীয়রা বলছেন, পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ অঞ্চলটিকে পর্যটনের গন্তব্য হিসেবেও পরিণত করে তোলা সম্ভব।