Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘বিবর্ণ’ ক্রিকেটে রঙ ফেরালো খুদে টাইগাররা


১০ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১৫:০৩

ঢাকা: সাকিব আল হাসানের অতিমানবীয় পারফরম্যান্সের পরও বিশ্বকাপের হতাশাজনক ফল, ক্রিকেটারদের ধর্মঘট, আফগানিস্তানের কাছেও টেস্টে পরাজয়, ঘরে-বাইরে তিন ফরম্যাটের ক্রিকেটেই জাতীয় দলের একের পর এক শোচনীয় পরাজয়, এর সঙ্গে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের নিষেধাজ্ঞা— সব মিলিয়ে দেশের ক্রিকেটাঙ্গনকে যেন চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছিল কালো মেঘ। সে মেঘ সহসাই কাটবে— এমন আশাবাদীও খুঁজে পাওয়া যেন দুষ্কর হয়ে পড়েছিল।

বিজ্ঞাপন

পরিস্থিতি এমন যে অনূর্ধ্ব-১৯-এর যুবারা যে বিশ্বমঞ্চ মাতিয়ে তুলতে দক্ষিণ আফ্রিকায় অবস্থান করছে, সে খবরটাই ছিল আলোচনার বাইরে। তবে ‘ক্ষুদ্র’ মস্তিষ্কের ক্রিকেটীয় জ্ঞানকে মাঠে প্রয়োগ করে শেষ পর্যন্ত লাইমলাইটটা নিজেদের দিকে টেনে নিলেন জুনিয়র টাইগাররা। সবাইকে বাধ্য করলেন তাদের দিকে চোখ ফেরাতে। দেশের হয়ে বিশ্বমঞ্চের প্রথম কোনো শিরোপা এনে জানিয়ে দিলেন, ক্রিকেটপ্রেমী এই জাতির আনন্দের ছটা বিবর্ণ হতে দেবেন না তারা। বিশ্বজয়ের গৌরব এনে দেওয়ার পথে এ-ও জানান দিলেন, ক্ষুরধার ক্রিকেট মস্তিষ্ক আর ক্রিকেটীয় জ্ঞান মাঠে প্রয়োগের যে ঘাটতি আমাদের ক্রিকেটারদের আছে, সেই ঘাটতিও হয়তো নিকট ভবিষ্যতে পূরণ হতে পারে তাদের হাত ধরেই।

বিজ্ঞাপন

লক্ষ্যটা অবশ্য সহজ ছিল না। বাংলাদেশের অনূর্ধ-১৯ ক্রিকেট দল বরাবরই সম্ভাবনাময় হলেও তাদের সম্ভাবনার পূর্ণ অনুবাদ আসছিল না মাঠে। আজকের তারকা সাকিব-মুশফিক-তামিমও দেড় দশক আগে অংশ ছিলেন এই স্কোয়াডের। সে দল গ্রুপ পর্ব পেরিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠলেও সে পর্যায় আর অতিক্রম করতে পারেনি। দীর্ঘদিন পর্যন্ত সেটিই ছিল ক্রিকেটে বাংলাদেশের সেরা সাফল্য।

দীর্ঘ বিরতির পর ফের মেহেদী হাসান মিরাজ-নাজমুল হোসেন শান্তদের নিয়ে গড়া স্কোয়াড ঘিরে স্বপ্ন উঁকি দেয় দেশের ক্রিকেট প্রেমীদের মধ্যে। সম্ভাবনার অনুবাদে তারা ছাপিয়ে গিয়েছিলেন সাকিব-মুশফিকদেরও। কোয়ার্টার পেরিয়ে সেমিতে পা রাখেন মিরাজরা। আশাভঙ্গও হয় ওই সেমিতেই। শেষ পর্যন্ত টুর্নামেন্টে তৃতীয় হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। তাই ইতিহাসটাও পক্ষে ছিল না যুব টাইগারদের। তবে প্রকৃত চ্যাম্পিয়নরা তো সব প্রতিকূলতা পেরিয়েই নতুন করে ইতিহাস লেখে। দক্ষিণ আফ্রিকার পচেফস্ট্রুমে সেটাই যেন করে দেখালেন আকবর-শরীফুলরা।

সাফল্যের রহস্য অবশ্য ম্যাচ শেষে জানিয়ে দিয়েছেন টাইগার ক্যাপ্টেন আকবর আলী। গেল বছর দেড়েক সময়ে তারা একটি ‘টিম’ হয়ে উঠেছেন, এমন একটি টিম যেখানে ব্যক্তিগত সাফল্য মূখ্য নয়। একজন ক্রিকেটার প্রতিটি ম্যাচে উইনিং পারফরম্যান্স দিতে পারবেন না, তবে প্রতিটি ম্যাচেই কেউ না কেউ দাঁড়িয়ে যাবেন বুক চিতিয়ে, সতীর্থদের ওপর সেই বিশ্বাস রাখেন এই টিম বাংলাদেশের যুবারা। আকবর আরও বললেন কঠোর পরিশ্রমের কথা। কে না জানে, কঠোর পরিশ্রম অমিত প্রতিভাকেও ছাপিয়ে যেতে সক্ষম।

এসব কথা নতুন কিছু নয়। যেকোনো টিম গেমে পারস্পরিক বোঝাপড়ায় দল হয়ে ওঠা সবকালেই সবার জন্য চ্যালেঞ্জ। তত্ত্ব মেনে আমরা তেমন দল হয়ে খুব একটা পারফর্ম করতে দেখিনি জাতীয় ক্রিকেট দলকে। কোনোদিন ব্যাটিং ভালো তো কোনোদিন বোলিং, কোনোদিন উল্টোটা। কোনোদিন টানটান উত্তেজনার ম্যাচে করুণ ফিল্ডিং— এই তো আমাদের চিরচেনা চিত্র। তারপরও ২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের পরের কিছুদিন ছিল জাতীয় ক্রিকেট দলের জন্য স্বপ্নের মতো। সেই সময়কার দলটি ‘টিম বাংলাদেশ’ হয়ে উঠেছিল বলেই সাফল্য ধরা দিয়েছিল একের পর এক। তবু সেই দলটিই চাপ উৎরে যেতে পারেনি অনেক স্নায়ুচাপের ম্যাচেই। আর তাই দ্বিপাক্ষিক একাধিক সিরিজে ভালো করলেও তিন-জাতি বা বিশ্ব মঞ্চে আসছিল না কাঙ্ক্ষিত ফল। একই ধরনের অবকাঠামো থেকে আকবর-শরীফুলরা সিনিয়রদের ছাপিয়ে যেতে পারবে কি না— এমন শঙ্কাও তাই অমূলক ছিল না।

শেষ পর্যন্ত বিশ্ব শিরোপা জয় করে আকবররা দেখালেন, তত্ত্বকে তারা হাতে-কলমেই প্রমাণ করতে শিখিয়েছেন। দুর্বল প্রতিপক্ষকে কিভাবে ডোমিনেট করতে হবে ম্যাচে, তার নজির যেমন রেখেছেন, তেমনি সমান সক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিপক্ষে প্রেশার সিচুয়েশনে কিভাবে ম্যাচ বের করে আনতে হয়, দেখিয়েছেন সেটিও। আর চূড়ান্ত স্নায়ুচাপের মধ্যেও ভেঙে না পড়ে হাল ধরে রেখে কিভাবে জয়ের বন্দরে নোঙর করতে হয়, ফাইনালে তারই ছাপ রাখার স্মৃতি তো একদমই টাটকা।

যুবাদের এবারের বিশ্বকাপ ক্রিকেটের যাত্রাটি আরেকটু খতিয়েই দেখা যাক। গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচ ছিল জিম্বাবুয়ের সঙ্গে। যুবাদের দলটি তেমন খারাপ নয়। তবে বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচটিতে ২৮ ওভারে ১৩৭ রানের বেশি তুলতে দেননি টাইগার বোলাররা। পরে ২২ ওভারে ১৩০ রানের লক্ষ্য দাঁড়ালেও রীতিমতো ব্যাটিং ঝড় তুলে ১১ ওভার ২ বলেই সে লক্ষ্য পেরিয়ে যান তানজিদ-ইমন-জয়রা। পরের ম্যাচে বোলাররা আরও ভয়ংকর। স্কটল্যান্ডকে বেঁধে ফেলেন মাত্র ৮৯ রানে। সে রান তুলতেও ১৭ ওভারের বেশি খরচ করেননি ব্যাটসম্যানরা। পাকিস্তানের বিপক্ষে গ্রুপের শেষ ম্যাচটি বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত হয়। প্রথম দুই ম্যাচে বড় ব্যবধানে জয় পাওয়ায় তাই রান রেটের ব্যবধানে গ্রুপ সেরা হয় টাইগার যুবারা।

নকআউটের প্রথম ম্যাচ কোয়ার্টার ফাইনালে প্রতিপক্ষ ছিল স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকা। তানজিদ, তৌহিদ আর শাহাদতের ব্যাটে দারুণ ব্যাটিংয়ের ডিসপ্লে ছিল ওই ম্যাচেও। ২৬১ রানের পুঁজি এমনিতেই ছিল চ্যালেঞ্জিং, সেটা যে একেবারেই নাগালের বাইরে, তা পরে প্রমাণ করলেন বোলাররা। দক্ষিণ আফ্রিকা অলআউট ১৫৭ রানে। এমন সহজ জয়ের পর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেমিফাইনাল অবশ্য ততটা সহজ ছিল না। এদিন নিউজিল্যান্ডকে দফায় দফায় চেপে ধরে ১৪১ রানেই ৬ উইকেট তুলে নেন টাইগার বোলাররা। পরে ১৮৪ রানে অষ্টম উইকেটেরও পতন হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ২১১ রান স্কোরবোর্ডে জমা করে কিউই যুবারা।

জবাবে টাইগার যুবাদের শুরুটাও ভালো হয়নি। ৩১ রানেই দুই ওপেনারের ফিরে যাওয়ায় ২১১ রানের লক্ষ্যটা বেশ কঠিন মনে হচ্ছিল। কিন্তু চাপের মুখেও ভেঙে না পড়ার যে মন্ত্র জুনিয়র টাইগারদের মনে-মগজে প্রোথিত, সেটা দেখিয়ে দিলেন ব্যাটসম্যানরা। জয় মিললো ৬ উইকেটে, প্রায় ৬ ওভার হাতে রেখে। নকআউট ম্যাচের যে প্রেশার, সে তথ্য অবশ্য এই স্কোরবোর্ডে বোঝার উপায় নেই।

সেমিতে এই জয়ের পরই মূলত ক্রিকেটপ্রেমীরা জেগে ওঠেন, খোঁজ নিতে শুরু করেন যুবাদের নিয়ে। ফাইনালের দিন তো টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া— গোটা বাংলাদেশ একাত্ম ক্রিকেট আবেগে। টিএসসিতে বড় পর্দা, মোড়ে মোড়ে চায়ের দোকানে ঝড় কিংবা টিভির শোরুমগুলোর সামনে রাস্তাভর্তি দর্শক— সেই ২০১৫-১৬ সালের জাতীয় ক্রিকেট দলের সোনালি সময়ের স্মৃতিকেই যেন ফিরিয়ে আনছিল। আর পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকা শ্বাসরুদ্ধকর ফাইনাল ম্যাচটি ঘাম ছুটিয়েছে অনেক দর্শকেরই। স্নায়ুচাপের চূড়ান্ত পরীক্ষায় যখন আকবর-রাকিবুল উত্তীর্ণ, গোটা বাংলাদেশ তখন ক্রিকেট পতাকার নিচে একত্রিত। বিশ্ব শিরোপার গৌরবে গভীর রাতেও আলোকিত বাংলাদেশ।

শিরোপার স্বাদে কে না খুশি হয়। তবে টাইগার ফ্যান আর বোদ্ধারা বলছেন, শিরোপার কথা বাদ দিয়েই এই জয়ের মাহাত্ম্যটা অন্যরকম। বয়সে তরুণ হলেও এই যুবারা বিশ্বকাপ শুরুর পর থেকেই যেভাবে কথা বলছেন, তাতে পরিচয় দিয়েছেন ক্রিকেটীয় পরিপক্কতার। কেউ কেউ ‘ছোট মুখে’ এমন কথা শুনে ইঁচড়েপাকা ভাবতে পারেন, তবে মাঠে তারা প্রমাণ দিয়েছেন, বয়সের তুলনায় তাদের খেলোয়াড়সুলভ ভাবনাগুলো একটু বেশিই পরিণত। স্নায়ুচাপের লড়াইয়ে যেভাবে তারা এই টুর্নামেন্টজুড়ে সাফল্য দেখিয়েছেন, এমন পরিণতবোধ ‘বড়’রাও দেখাতে পারেননি বলেই মত বিশ্লেষকদের।

ছোটদের ক্রিকেটীয় দক্ষতা আর জ্ঞানের পাশাপাশি তা প্রয়োগের যে সাফল্য, তাতে এটুকু বলাই যায়— জাতীয় দলে ক্রিকেটারদের জন্য পাইপলাইনটা নেহায়েত কম শক্তিশালী নয়। শরীফুলের মতো পেসার, রাকিবুলের মতো স্পিনার যেমন আছে এই লাইনে, তেমনি আছে পারভেজ হোসেন ইমনের মতো ওপেনার কিংবা তৌহিদ হৃদয় বা মাহমুদুল হাসান জয়ের মতো মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানও। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো— আকবর আলীর মতো একজন অধিনায়কও এই দলকে পথ দেখিয়েছেন, যিনি একইসঙ্গে মিডল অর্ডারের নির্ভরতা, আবার উইকেটের পেছনে অতন্দ্র প্রহরী। আমাদের মুশফিকুর রহিমকে পেরিয়ে কেউ কেউ তো তাকে ভারতের বিশ্বজয়ী ‘ক্যাপ্টেন কুল’ উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান মহেন্দ্র সিং ধোনীর সঙ্গেও তুলনা করতে শুরু করেছেন।

প্রতিভা আর কঠোর পরিশ্রমের পথ পেরিয়ে জুনিয়র এই টাইগাররাই ফের আশার আলো ফিরিয়েছেন ক্রিকেটে। জাতীয় দল যখন ম্রিয়মান মাঠে আর মাঠের বাইরের ঘটন-অঘটনে, অনূর্ধ্ব-১৯-এর এই তরুণ প্রাণরাই যেন প্রাণ ফেরালেন ক্রিকেটে। আজকের তরুণদের কাণ্ডারি আকবর আলী যথাযথ পরিচর্যায় একদিন জাতীয় দলেরও কাণ্ডারি হয়ে উঠবেন— তেমন আশা তো ক্রিকেটপ্রেমীরা করতেই পারে। তবে ভবিষ্যতের আশাবাদ তোলা থাকুক। আপাতত দেশের জন্য যে বিশ্বজয় করে আনলেন তরুণরা— সেজন্য অভিবাদন তাদের। বিবর্ণ হতে থাকা ক্রিকেটকে যে তারা রাঙিয়ে দিলেন— তাদের জন্য তাই ক্রিকেটপ্রেমীদের পক্ষ থেকে ভালোবাসা।

অনুর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ জিতল বাংলাদেশ অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর