উৎপাদন বাড়লেও মজুরি বাড়ে না চা শ্রমিকদের
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৭:৪৫
মৌলভীবাজার: রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ন্যাশনাল টি কোম্পানি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন ছোট-বড় বাগানসহ সব মিলিয়ে বাংলাদেশে চা বাগান রয়েছে মোট ১৬২টি। চা-শ্রমিকদের অক্লান্ত পরিশ্রম, উৎপাদনে ভিন্ন কৌশল, নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার ও শ্রমিকদের আধুনিক প্রশিক্ষণের কারণে প্রতিবছরই চায়ের উৎপাদন বাড়ছে। গতবছর চা শিল্প ১৬৫ বছরের ইতিহাসে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে উৎপাদনে নতুন রেকর্ড করেছে।
বাংলাদেশ চা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে উৎপাদিত এ চায়ের পরিমাণ ৯৫ মিলিয়ন বা ৯ কোটি ৫০ লাখ কেজি । ২০১৯ সালে বাংলাদেশ চা বোর্ড এর চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮০ মিলিয়ন বা ৮ কোটি কেজি চা পাতা । উৎপাদনের পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ১৫ মিলিয়ন বা ১ কোটি ৫০ লাখ কেজি বেশি চা-পাতা উৎপাদন হয়েছে ।
চা সংশ্লিষ্টরা চায়ের বাম্পার ফলনের কারণ হিসেবে চা-বাগানগুলোতে চা শ্রমিকদের অক্লান্ত পরিশ্রম, প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাত, অনুকূল আবহাওয়া, পোকামাকড়ের আক্রমণ কম থাকা, খরার কবলে না পড়াসহ সর্বোপরী বাংলাদেশ চা বোর্ডের নজরদারিকে এবারের চা উৎপাদনে নতুন রেকর্ডের কারণ হিসেবে মনে করছেন। তবে প্রতিবছর চায়ের উৎপাদন বাড়লেও, পরিবর্তন হচ্ছে না চা শ্রমিকদের জীবনমানের।
সর্বশেষ ২০১৬ সালে চা-শ্রমিকের হাজিরা (দৈনিক বেতন) ৮৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০২ টাকা করা হয়েছিল। এরপর প্রায় ৪ বছর পেরিয়ে গেলেও আর বাড়েনি চা-শ্রমিকের বেতন। প্রতিদিন ২৪ কেজি পাতা তুললে একজন শ্রমিক পায় ১০২ টাকা। ২৪ কেজির কম পাতা তুললে আনুপাতিক হারে বেতন কাটা হয়ে থাকে।
একজন চা শ্রমিক সপ্তাহে ছয়দিন কাজ করে পায় ৬১২ টাকা। সঙ্গে রেশন হিসেবে আছে সপ্তাহে মাত্র তিন কেজি আটা। তা নিয়েও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ।
মৌলভীবাজারের চা শ্রমিক সুমন বাড়ৈ বলেন, ‘আমাদের শ্রমঘামে এ শিল্পের দিনদিন উন্নতি হলেও আমাদের জীবনমানের কোনো উন্নতিই হচ্ছে না বরং ৩০০ টাকা মজুরির জন্য আমরা রাস্তায় নামছি, আন্দোলন সংগ্রাম করছি তবুও কর্তৃপক্ষের টনক নড়ছে না।’
আরেক চা শ্রমিক সুমন হাজরা বলেন, ‘রেশন হিসেবে আমাদের যে আটা দেওয়া হয় তা নিম্নমানের। এই আটা খাওয়ার অনুপযোগী।’
দৈনিক মজুরি বিষয়ে সুমন বলেন, ‘বর্তমান বাজারে জিনিসপত্রের দামের যে ঊর্ধ্বগতি তাতে ১০২ টাকা মজুরিতে পাঁচ-ছয়জনের পরিবার নিয়ে কীভাবে বেঁচে আছি। আশা করি, আপনারা ঠিকই অনুধাবন করতে পেরেছেন।’
এ ছাড়া দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি না পাওয়া। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস হলেও চা-বাগানে একজন মায়ের মাতৃত্বকালীন ছুটি ১৬ সপ্তাহ (৪ মাস) বলে জানিয়েছেন চা-শ্রমিকরা।
চা শ্রমিক নমিতা বাড়ৈ বলেন, ‘একজন নবজাতককে টানা ৬ মাস পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়াতে হয়। সেখানে মাত্র ১৬ সপ্তাহের ছুটি। এটি কী করে সম্ভব? এটি অমানবিক।’
কমলগঞ্জ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান চা শ্রমিক কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক এ বিষয়ে সারাবাংলাকে জানান, একজন চা শ্রমিক বছরে মাত্র ১২ দিন অসুস্থতাজনিত ছুটি পেয়ে থাকেন। ১২ দিনের উপরে কেউ অসুস্থ থাকলে তার হাজিরা কাটা যায়।’
তিনি আরও জানান, বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাবে বাগানগুলোতে অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকে। অনেক চা বাগানেই নেই গভীর নলকূপের ব্যবস্থা। পাহাড়ি গাং (ছড়া) ও প্রাচীন আমলের কুয়ো (কূপ) থেকেই চলে চা শ্রমিকদের পানীয়জলের ব্যবস্থা । ফলে বিশুদ্ধ পানীয়জলের অভাবে প্রতিবছর ডায়রিয়াজনিত অসুখ শ্রমিক বস্তিতে মহামারী আকার ধারণ করে।
চা শ্রমিকদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ালে চায়ের উৎপাদন আরও বাড়তে পারে বলে মনে করেন কালিঘাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রাণেশ গোয়ালা। পাশাপাশি মাতৃকালীন ছুটি বৃদ্ধি, বিশুদ্ধ পানীয়জলের জন্য গভীর নলকূপ স্থাপন, উন্নত সেনিটেশন ব্যবস্থা, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা হলে চায়ের উৎপাদন ২০০ মিলিয়ন কেজিতে উন্নীত করা সম্ভব বলে মনে করেন চা-শ্রমিক নেতারা।
প্রসঙ্গত, প্রতিবছর চায়ের আভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে চা রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে বাংলাদেশের চা শিল্প। ২০২৫ সালের মধ্যে দেশে চায়ের উৎপাদন ১৪০ মিলিয়ন কেজিতে উন্নীত করতে কাজ করে যাচ্ছে সরকার।