ভালোবাসার স্মৃতি নিয়ে আজও অমলিন ‘মাথিনের কূপ’
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৭:৩১
ওমর ফারুক হিরু, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
কক্সবাজার: রাখাইন জমিদারের কন্যা প্রেমে পড়েছিলেন পুলিশ কর্মকর্তার। সে প্রেমে মজেছিলেন সেই পুলিশ কর্মকর্তাও। তবে সে প্রেম পায়নি মিলনের পূর্ণতার স্বাদ। ভালোবাসা ছিল, পরিবারের কাছে হেরে যায় প্রেমিকের ভালোবাসা। তাতে চিরবিরহ সঙ্গী করেন প্রেমিকা। প্রেমিক পরাজিত হয়েছিলেন চাপে, তবে পরাজিত হননি প্রেমিকা। বরং প্রেমের কাছেই আত্মোৎসর্গ করেছিলেন নিজেকে। সেই বিরহ অমর হয়ে গল্প ছড়িয়ে যাচ্ছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
প্রায় শতবর্ষী এই প্রেমের গল্প আজও মানুষের মাছে ছড়িয়ে যাচ্ছে ‘মাথিনের কূপ’। সাগরতীর কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায় অবস্থিত কূপটি আজও জমিদারকন্যা মাথিন আর পুলিশ কর্মকর্তা ধীরাজ ভট্টাচার্যেরই অতৃপ্ত প্রেমের স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে। আর সেই প্রেমের অনুভব জানতেই সারাবছর সেখানে ছুটে আসেন পর্যটকরা।
ইতিহাস বলছে, বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে টেকনাফ এলাকাটি ছিল বেশ দুর্গম। ওই সময় কলকাতা থেকে টেকনাফ থানায় বদলি হয়ে আসেন সুদর্শন পুলিশ কর্মকর্তা ধীরাজ ভট্টাচার্য। ওই থানা প্রাঙ্গণেই ছিল একটি গভীর কূপ, যা এলাকাবাসীর খাবার পানির চাহিদা মেটাত। সেই কূপ থেকেই অন্যদের সঙ্গে জল নিতে আসতেন জমিদার ওয়াং থিনের কন্যা মাথিনও। তার রূপে মুগ্ধ হন ধীরাজ। দু’জনের মধ্যে প্রেম হয়। একপর্যায়ে বিয়ে করারও সিদ্ধান্ত নেন তারা।
শুরুতে মাথিনের সহচর যারা ছিল, তারা জেনে যান মাথিন-ধীরাজের প্রেমের কথা। পরে সে কথা জেনে যান রাখাইন জমিদার ওয়াং থিনও। এ প্রেমের খবরে খুব একটা খুশি না হলেও মেয়ের কথা ভেবে তিনি ধীরাজের সঙ্গে মাথিনের বিয়েতে রাজিই হয়ে যান। তবে রাখাইন তরুণীর সঙ্গে ছেলের প্রেমের সম্পর্ক মানতে পারেনি ধীরাজের পরিবার। ধীরাজের বাবা কৌশল গ্রহণ করেন। জরুরি টেলিগ্রাফে জানান, ধীরাজের মায়ের শারীরিক অবস্থা সংকটাপন্ন। ধীরাজ কলকাতা চলে যান। পরিবারের চাপের মুখে নতি স্বীকার করে আর টেকনাফে ফেরা হয়নি ধীরাজের।
তবে মাথিনের বিশ্বাস ছিল, ধীরাজ ফিরবেন। যখন বুঝতে পারলেন, তার সেই আশা দূরাশায় পরিণত হয়েছে, মানতে পারলেন না। নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিলেন। সবার শতচেষ্টাতেও মাথিন স্বাভাবিক জীবনে আর ফিরতে চাননি। শেষে প্রেমিকের অপেক্ষাতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
প্রায় একশ বছর আগের এ প্রেমকাহিনী হয়তো সময়ের স্রোতে হারিয়েই যেত। তবে ধীরাজ নিজেই আত্মজীবনীমূলক ‘যখন পুলিশ ছিলাম‘ বইতে এই প্রেমকাহিনী লিখে যান। আশির দশকের শুরুতে স্থানীয় সাংবাদিক আব্দুল কুদ্দুস রানা ধীরাজের বইটি পড়ার পর থানা প্রাঙ্গণের সেই কূপটি চিহ্নিত করেন। সংবাদ প্রকাশ করেন। সে খবর আলোড়ন তোলে। ১৯৮৪ সালের ১৪ এপ্রিল একটি সাইনবোর্ড টাঙিয়ে ‘মাথিনের কূপ’ নাম দিয়ে এলাকাটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরপর গত সাড়ে তিন দশকে একাধিকবার সংস্কার করা হয় কূপ ও এর আশপাশ। তাতে টেকনাফের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন স্পটে পরিণত হয়েছে মাথিনের কূপ।
‘মাথিনের কূপে’র মূল স্থাপনাটি ওই কূপ। এর একপাশে একটু উঁচু বেদীর ওপর কাঁচের বাক্সে বসানো রয়েছে পুলিশ কর্মকর্তা ধীরাজের একটি আবক্ষ ভাস্কর্য। এর দুই পাশে একাধিক ফলকে তুলে ধরা হয়েছে মাথিন-ধীরাজের প্রেমকাহিনী। কূপের অন্য পাশটি উন্মুক্ত। আর কূপ, ধীরাজের ভাস্কর্য ও ফলকগুলোর ওপরে তৈরি করা হয়েছে ছাউনি। একপাশে দিকে বসার জন্য স্থাপন করা হয়েছে কংক্রিটের বেঞ্চ। সামনের দিকে রয়েছে বাহারি ফুলের বাগান।
‘মাথিনের কূপ’ বলে ডাকা হলেও গোটা স্থাপনার কোথাও নেই মাথিনের কোনো ছবি বা ভাস্কর্য কিছুই নেই। তা নিয়ে ক্ষোভ ও আক্ষেপ দুইই রয়েছে পর্যটকদের। তারা বলছেন, প্রেমের টান অস্বীকার করেছিলেন ধীরাজ। তার ভাস্কর্য রয়েছে। অথচ যে মেয়েটি প্রেমের জন্য নিজেকে আত্মোৎসর্গ করেছিল, তার জন্য কিছুই নেই।
স্বামীকে নিয়ে ঢাকা থেকে কক্সবাজার বেড়াতে এসেছিলেন সাইমা সুলতানা। জানালেন, অনেক গল্প শুনেছেন মাথিনের কূপের। টেকনাফে নেমেই তাই চলে এসেছেন দেখতে।
সাইমা বলেন, মাথিনের ভালোবাসার গল্প শুনেছি, এখানে এসে আরও বিস্তারিত পড়লাম। মাথিন ভালোবাসার জন্য জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছে, ভালোবাসার চেয়ে বড় কিছু নেই। তার এই ত্যাগের কথা সবাই মনে রাখবে। কিন্তু তার কোনো চিহ্ন কেন সংরক্ষণ করা হয়নি এখানে, সেটি বুঝতে পারছি না।
আরেক পর্যটক রায়হান কবির বলেন, মাথিন আর ধীরাজের অতৃপ্ত ভালোবাসার গল্প বিষাদ আর বেদনাবিধুর এক অমর প্রেমের কাহিনী। ভালোবাসার জন্য যে মানুষ জীবন দিতে পারে, সেটি মাথিন দেখিয়েছিল।
যে থানায় শত বছর আগে দারোগা হয়ে এসেছিলেন ধীরাজ, সেই থানায় এখন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, মাথিনের কূপে সারাবছরই পর্যটকের আনাগোনা থাকে। গত কয়েক বছরে এই কূপের সংস্কার করে জায়গাটিকে আকর্ষণীয় করে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। আশা করি, এখানে পর্যটকদের উপস্থিতি দিনে দিনে বাড়বে বৈ কমবে না।