ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মীরাও আক্রান্ত করোনাতে, বিপাকে চীন
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১৪:২১
ভয়ংকর ছোঁয়াচে করোনাভাইরাসে চীনের জনজীবনে নেমে এসেছে স্থবিরতা। ভাইরাসের প্রকোপ দিনে দিনে বাড়ছেই। এমন সময় আরও উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা দেওয়া চীনের স্বাস্থ্যকর্মী ও ডাক্তাররা আক্রান্ত হচ্ছেন করোনাভাইরাসে। চীন সরকার চিকিৎসাসেবকদের আক্রান্ত হওয়ার কোনো পরিসংখ্যান প্রকাশ না করলেও এ সংখ্যা কয়েক শ ছাড়িয়ে গেছে। এমনটাই জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম সিএনএন।
উহান শহরের এক সেবিকা নিং জুহু। তিনি তার নাম-পরিচয় প্রকাশ না করে কিছু তথ্য জানিয়েছেন। নিং জুহু এর মতে, তার হাসপাতালের ৫০০ স্বাস্থ্যকর্মীর মধ্যে অন্তত ১৩০ জন ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। হাসপাতালে কাজ করেন এমন এক শ জন কোয়ারান্টিনেটেড অবস্থায় আছেন বাসায়। গত ২৬ জানুয়ারি চেস্ট স্ক্যান করার পর সম্ভাব্য ভাইরাসের উপস্থিতি সন্দেহে তিনিও নিরাপদে থাকছেন।
তবে নিং জুহু বলেন, ফলাফল ভালো এলে কাজে যেতে বাধা নেই। আমার ভাইরাসের তেমন উপসর্গ নেই। ইনফেকশনের মতো কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে।
চীনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম উইবোতেও কেউ কেউ হাসপাতালের এমনই অবস্থা তুলে ধরেছেন। চীনের উহান সেন্ট্রাল হসপিটালের এক সেবিকা জানান, তিনিসহ তার অন্তত ১৫০ সহকর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন অথবা সন্দেহজনক অবস্থায় আছেন।
তিনি বলেন, রোগীদের জন্য যে ফ্লোরে আমি কাজ করি, সেখানে এখন আমার সহকর্মীরা চিকিৎসা নিচ্ছেন।
‘যতবারই কোনো ডাক্তার আমাকে দেখতে আসেন। আমি নিঃশ্বাস বন্ধ রাখি। কারণ আশঙ্কায় থাকি, আমার শরীরের ভাইরাসে তিনি আক্রান্ত হবেন,’ বলেন ওই সেবিকা।
উহানে প্রায় ৩৯৮টি হাসপাতাল ও ৬ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। শহরটির মিউনিসিপ্যাল হেলথ কমিশন ৯টি হাসপাতালকে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসার অনুমতি দিয়েছে। এছাড়া, ভাইরাসের প্রাথমিক উপসর্গ দেখা দিলে ৬১টি হাসপাতাল চিকিৎসাসেবা দিতে পারবে। জুয়াংনান হাসপাতাল প্রাথমিকভাবে তেমন একটি করোনাভাইরাস নিশ্চিতকরণ কেন্দ্র। এখানের ৪০ স্বাস্থ্যকর্মী ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।
যদিও এই হাসপাতালের পরিচালক পেং জিইয়ং দাবি করেছেন, অন্যান্য হাসাপাতালের তুলনায় জুয়াংনান হাসপাতালে এই হার খুবই কম।
স্বাস্থ্যকর্মীদের ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারণ চিকিৎসা উপকরণের স্বল্পতা। উহানের ৭ নং হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগে যেসব স্বাস্থ্যকর্মী কাজ করছেন, তাদের দুই-তৃতীয়াংশ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন কারণ তাদের পর্যাপ্ত চিকিৎসা উপকরণ ছিল না। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, এন৯৫ রেসপাইরেটরি মাস্ক, গগলস, প্রোটেক্টিভ স্যুটস। এসব বিষয়ে অবগত রয়েছে উহান সরকারও।
করোনাভাইরাসের সতর্ককারী ডাক্তার লি ওয়েনলিয়াং (৩৪) এর ভাইরাসের আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঘটনা চীনের জন্য বড় ধাক্কা। প্রথমে তিনি চীনের পুলিশের রোষানলেও পড়েছিলেন। অভিযোগ ছিল, তিনি গুজব ছড়াচ্ছেন। তবে ২৮ জানুয়ারি চীনের সুপ্রিমকোর্ট জানায়, লি ওয়েনলিয়াং এর সতর্কবার্তা শুনলে আগাম ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হতো সরকারের জন্য। করোনাভাইরাস যে কতটা ছোঁয়াচে তা বুঝতে বুঝতেই চীনের বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে গেছে।
দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন গত মাসে এক প্রতিবেদনে জানায়, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম ৪২৫ রোগীর মধ্যে ৭ জন স্বাস্থ্যকর্মী। জানুয়ারির ১ থেকে ১০ তারিখের মধ্যে তাদের উপসর্গ দেখা দেয়।
যদিও উহান মিউনিসিপ্যাল হেলথ কমিশন ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সেসময় দাবি করেছিল ভাইরাসে স্বাস্থ্যকর্মীরা আক্রান্ত হননি। পরবর্তীতে জং জানসান নামের এক চীনা স্বাস্থ্যবিদ নিশ্চিত করেন, রোগী থেকে স্বাস্থ্যকর্মী ও ডাক্তারদের আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি। তিনি জানান, এক রোগী থেকে ১৪ স্বাস্থ্যকর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
পরবর্তীতে উহান মিউনিসিপ্যাল হেলথ কমিশন বিষয়টি স্বীকার করে বিবৃতি দেয়। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো আপডেট বা হালনাগাদ সংখ্যা জানানো হয়নি। চীনের গণমাধ্যমগুলো থেকেছে নীরব। ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মীদের ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়ে সিএনএন চীনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তারা মন্তব্য করে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
২০০৩ সালের দিকে চীনে ছড়িয়ে পড়া সার্স প্রাদুর্ভাবে ৫ হাজার ৩ শ ২৮ রোগীর মধ্যে আক্রান্ত হয়েছিলেন ৯৬৬ জন স্বাস্থ্যকর্মী। যা ছিল মোট সংখ্যার শতকরা ১৮ ভাগ। সে তুলনায় বর্তমানে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৬৪ হাজার ৫০০। শুক্রবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত মারা গেছেন ১৪৮৩ জন। তবে স্বাস্থ্যকর্মী ও ডাক্তারদের আক্রান্তের বিষয়টি অজানা রয়েছে।
এদিকে সম্প্রতি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং পরিদর্শন করেছেন বেইজিং এর একটি হাসপাতাল। করোনাভাইরাস যেন হাসপাতালের অভ্যন্তরে না ছড়াতে পারে সে ব্যাপারে জোরাল পদক্ষেপ নিতে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন।