বস্তিতে আগুন: ‘গোপন’ থাকে তদন্ত প্রতিবেদন!
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১০:০৭
ঢাকা: গত সাত মাসে রাজধানীর তিনটি বস্তি আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে। একের পর এক বস্তিতেই আগুন লাগছে আর গৃহহীন হয়ে পড়ছেন নিম্ন আয়ের মানুষজন। আগুন লাগার ঘটনায় প্রত্যেকবারই তদন্ত কমিটি হয়েছে, অথচ এর প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। বস্তিবাসীও জানেন না আগুন লাগার প্রকৃত কারণ। তাদের অভিযোগ, ‘বস্তিতে এমনি এমনি আগুন লাগে না কখনো, আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। না হলে বস্তিতেই বারবার কেন আগুন লাগছে?’
গত সোমবার (১০ ফেব্রুয়ারি) মিরপুর ঝিলপাড় ও চলন্তিকা বস্তি এবং বনানীর টিঅ্যান্ডটি বস্তির ঘর পোড়া মানুষদের সঙ্গে কথা বলার সময় এসব অভিযোগ পাওয়া যায়।
গত বছরের আগস্ট মাসে মিরপুরের রূপনগর থানাধীন ঝিলপাড় বস্তিতে আগুন লাগে। রাত ৮টার দিকে আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিসের ১৭টি ইউনিটের চেষ্টায় আড়াই ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ততক্ষণে আগুনে অন্তত ২০ থেকে ২৫ হাজার ঘর পুড়ে যায়। আগুন লাগার পর বস্তিবাসী অভিযোগ করে বলেছিলেন, ‘গত ২৫ বছরের বেশি সময়েও এই বস্তিতে একটি বারও আগুন লাগেনি। এখন হঠাৎ করে কেন আগুন লাগলো? জায়গা খালি করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আগুন লাগানো হয়েছে।’
তবে ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছিল, বস্তির ভেতরে অবৈধ বৈদ্যুতিক ও গ্যাসলাইন থাকায় আগুন লাগার পর তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। বাতাস থাকায় আগুনে নিমিষেই বস্তিটি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ওই সময় ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তবে সেই কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি।
এরপর চলন্তিকা বস্তিতে আগুন লাগে, এতে পুড়ে যায় অন্তত ৩ হাজার ঘর। বস্তিবাসীর কেউ কেউ গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আগুন লাগার কথা বললেও অধিকাংশই বলছেন, ‘কেউ ষড়যন্ত্র করে আগুন দিয়েছে।’ চলন্তিকা বস্তির ঘটনাতেও ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। সেটিরও প্রতিবেদন দেয়নি তদন্ত কমিটি।
চলন্তিকা ও ঝিলপাড় বস্তিতে আগুনের ঘটনায় তদন্ত কমিটির প্রধান ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক দেবাশীষ বর্ধণ সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঝিলপাড় বস্তিতে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লাগে। এরপর আগুন ছড়িয়ে পড়ে। তীব্র বাতাস, প্লাস্টিক জাতীয় দাহ্য পদার্থ, অবৈধ গ্যাস লাইন আগুনের তীব্রতা বাড়িয়েছে। কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন স্বরাস্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সবার কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। তবে চলন্তিকা বস্তির ঘটনায় এখনো প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘চলন্তিকা বস্তিতে তদন্ত করতে গিয়ে বস্তিবাসীর বর্ণনা এবং ফায়ার সার্ভিসের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণেই আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। এরপর আগুন ছড়িয়ে পড়ার সময়ও বেশ কয়েকটি সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে চলন্তিকা বস্তিতে আগুন লাগার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া সম্ভব হবে।’
এছাড়া, গত ৮ ফেব্রুয়ারি ভোর পৌঁনে চারটার দিকে বনানীর টিঅ্যান্ডটি কলোনির বস্তিতে আগুনের ঘটনায় তদন্ত করছে ফায়ার সার্ভিস গঠিত কমিটি। ওইদিন আগুনের ঘটনায় অন্তত ২০০ ঘর পুড়ে যায়। এতে কয়েক হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েন। একটি গোডাউন থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হলেও বস্তিবাসীর অভিযোগ বস্তির জায়গা খালি করতেই এখানে পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগানো হয়েছে।
আগুন লাগার বিষয়ে চলন্তিকা ও ঝিলপাড় বস্তিতে বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। ঝিলপাড় বস্তির বাসিন্দা আমেনা বেগম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আগুন লাগার পর বস্তিবাসীর যে ভয়াবহ দুর্দিন গেছে তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। বৃষ্টিতে ভিজে, খেয়ে না খেয়ে দিন পার করতে হয়েছে। আগে যাদের ঘর ছিল, তারা এখন আর ঘর তুলতে পারছে না। আবার কেউ কেউ কোনোরকম ছাউনি দিয়ে আগের জায়গাতেই রয়ে গেছেন। আগুনে পোড়ার পর গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ একটি সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেন। কি কারণে কোথা থেকে আগুন লাগলো সেটি কেউ জানতে পারলো না। আগুন এখানে লাগানো হয়, যাতে জায়গা খালি হয়ে যায়। এটাই আমরা বিশ্বাস করি।’
চলন্তিকা বস্তির বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা ইয়াকুব আলী বলেন, ‘এই বস্তিতে ৩৫ বছর ধরে বাস করছি। কোনোদিন আগুন লাগেনি। এখন কেন ঘনঘন আগুন লাগছে তা বুঝতে পারছি না, মনে হচ্ছে কেউ আগুন লাগিয়ে দিয়ে বস্তি খালি করার পায়তারা করছে। খালি জায়গায় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ সাইনবোর্ড লাগিয়েছে। বস্তিবাসীর জন্য ভবন করলে কোনো বাধা আসবে না। তবে বস্তিবাসীদের বাদ দিয়ে কোনো কিছু চিন্তা করা হলে আমরা রুখে দাঁড়াবো। ’
আরেক বাসিন্দা সাহিদা আক্তার বলেন, ‘আগুন লাগার পর তদন্ত কমিটি গঠন হয়। অথচ সেই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন জমা হয় না, আমরা জানতে পারি না। বস্তিতে আগুন লাগে না, বরং আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়, যাতে বস্তির জায়গা খালি হয়। সেখানে স্থানীয় রাজনীতিবীদরা ফায়দা লুটতে পারবে।’
বনানীর টিঅ্যান্ডটি বস্তির বাসিন্দা আফরোজা বেগম বলেন, ‘কড়াইল বস্তিতে মাঝে মধ্যেই আগুন লাগে। তবে টিএনটি বস্তিতে গত দুই বছরে কোনো আগুন লাগেনি। এবারে শুনছিলাম, এই জায়গা খালি করা হবে। এর কিছুদিনের মধ্যেই আগুন লাগলো। গভীর রাতে বস্তিতে আগুন লাগার ঘটনা রহস্যজনক। রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় আগুন লাগায় কেউ কোনো কিছু নিয়ে বের হতে পারেনি। সবই পুড়ে ছাই হয়েছে। এসব ঘটনায় প্রকৃত কারণ বের হওয়া দরকার। যারা আগুন লাগায় তারা কি চায়, বস্তিবাসী ঢাকায় না থাক এটাই তো চায়? আমরা যাবো কোথায়? এদেশে সবার জায়গা হয়, আমাদের হয় না কেন বলেও প্রশ্ন রাখেন তিনি।’