Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মজুত উপকরণেরই দাম বাড়ালেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা


১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১৫:১৫

ঢাকা: দেশের তৈরি পোশাক খাতে করোনাভাইরাসের প্রভাব এরই মধ্যে দেখা দিতে শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্ট কয়েকজন। তারা বলছেন, অন্তত দুই মাস পর যে প্রভাব শুরু হওয়ার কথা, তা এখনই শুরু হয়ে গেছে। নতুন করে রফতানি আদেশ (অর্ডার) পাওয়া কিংবা পুরোনো আদেশের পণ্য সঠিক সময়ে শিপমেন্ট দেওয়া নিয়েও শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রকৃত অর্থে পোশাক খাতের পরিস্থিতি নির্ভর করবে করোনোভাইরাসের স্থায়িত্বের ওপর। ছুটি শেষে চীন থেকে পণ্য পরিবহন শুরু হলে অল্পমাত্রার এই অভিঘাত সহজেই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব বলেও তাদের মত।

বিজ্ঞাপন

বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক বলেন, গত বছর আমরা চীনের বাজারে ৫৫ কোটি ডলার ফিনিশড প্রোডাক্ট রফতানি করেছি। এছাড়া, চীন থেকে আমরা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কাঁচামাল আমদানি করি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চীন থেকে আমরা টেক্সটাইল ও কাঁচামাল মিলিয়ে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছি, যা আমাদের পুরো গার্মেন্টস খাতের অর্ধেক। সোয়েটার আর ওভেন খাত মূলত চীনের কাঁচামালের ওপর নির্ভরশীল। যদিও মধ্য জানুয়ারি থেকে আমরা দেখছি, বন্দরে নোঙর থাকা জাহাজের সংখ্যা শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। তবে পরিস্থিতি জটিল হলে এটি আর নিয়ন্ত্রণে থাকবে না বলেই মনে হচ্ছে।

তৈরি পোশাক খাতের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র পরিচালক ও সফটটেক্স সোয়েটারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রেজওয়ান সেলিম সারাবাংলাকে বলেন, দেশের তৈরি পোশাক খাতে করোনাভাইরাসের প্রভাব এরই মধ্যে দেখা গেছে। আমরা নতুন করে কোনো ক্রয়াদেশ (অর্ডার) নিতে পারছি না। কারণ পোশাক উৎপাদনের পুরো বিষয়টি একটি চেইনের মতো। কাঁচামাল নিয়ে অনিশ্চয়তায় শিপমেন্ট নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে। আর ক্রেতারাও জেনে যাচ্ছে, বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে চীনের ওপর নির্ভরশীল। ফলে তারা ভাবছে, বাংলাদেশে অর্ডার দিয়ে লাভ কী? অর্ডার দেওয়ার ক্ষেত্রে তারা এখন অন্য দেশের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। অর্ডার নিয়ে যারা টুকটাক কথা বলছিল এখন তারাও আর কথা বলছে না।

বিজ্ঞাপন

এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি ও বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, চীন তাদের হলিডের সময় বাড়িয়েছে। ছুটি দীর্ঘায়িত হওয়ায় একটি ধাক্কা লাগবে। কারণ ওখান থেকে প্রাথমিক উপকরণ আনতে পারব কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। চীনের সঙ্গে চলাচল বন্ধ থাকায় বাণিজ্যে এর প্রভাব পড়বে। শুধু গার্মেন্টস নয়, সব খাতেই ধাক্কা লাগবে।

দেশের নিট গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফেকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাতেম সারাবাংলাকে বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে দুই মাস পরে যে প্রভাব পড়ার কথা ছিল, তা এখনই শুরু হয়ে গেছে। কাঁচামাল, কেমিক্যাল— সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। নারায়ণগঞ্জে ব্যবসায়ীরা নিটের প্রাথমিক সব উপকরণের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। তাদের বক্তব্য, তাদের উৎপাদিত উপকরণের প্রাথমিক উৎস চীন, যদিও তারা বাড়তি দামে এখনো কোনো উপকরণ আনেননি।

মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ডায়িং, গ্লোবাল সল্ট, সোডা, ডাইসসহ সবকিছুর দাম বেড়েছে। দাম বেড়েছে অ্যাকসেসরিজ, গাম টেপ ও স্কচ টেপেরও। যদি এই অবস্থা চলতে থাকে, দুই মাস পর বাজারে বড় ধরনের সংকট দেখা দিতে পারে। এতে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে।

পোশাক ব্যবসায়ী হাতেম আরও বলেন, আমার প্রতিষ্ঠানে লেডিস টি-শার্টের একটি অর্ডার রয়েছে। এর জন্য লেইস প্রয়োজন, যা আসে চীন থেকে। এই অর্ডারের কাজ শেষ করতে ২৫ লাখ গজ লেইস লাগবে। আগেই ২০ লাখ গজ লেইস আনা হয়েছিল। গত ২ ফেব্রুয়ারি ৫ লাখ গজ লেইস আসার কথা ছিল, কিন্তু এখনো পাইনি। এ জন্য উৎপাদনেও যেতে পারছি না। তারা বলছে, ২০ তারিখ হলিডে শেষ হলে লেইস পাঠানো হবে। কোনো কারণে ছুটি দীর্ঘায়িত হলে আমি আরও পিছিয়ে যাব।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যাকসেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টাস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএপিএমইএ) সভাপতি আব্দুল কাদের খান সারাবাংলাকে বলেন, দেশের তৈরি পোশাক খাত নিত্য পণ্য, মেশিনারিজ ও কাঁচামালের জন্য চীনের ওপর সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল। করোনাভাইরাসের ফলে গার্মেন্টস অ্যাকসেসরিজ ও প্যাকেজিং সেক্টরের কাঁচামাল আমদানি কমে গেছে। চীনে এখনো কারখানাগুলো বন্ধ। কিছু কাঁচামালের সংকট এখনই দেখা দিয়েছে। সব মিলিয়ে আমরা পোশাক খাতের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন। চীন থেকে শিপমেন্ট বন্ধ থাকায় দেশের কারখানাগুলো পণ্য উৎপাদন করে সঠিক সময়ে শিপমেন্ট করতে পারবে কি না— তা নিয়েও অনেকের মধ্যে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

মাসুদ অ্যাপারেলস লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মো. নাছির সারাবাংলাকে বলেন, করোনাভাইরাসের ফলে গার্মেন্টস খাতের অনেক বড় ক্ষতি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। ফেব্রিক্সের ক্ষেত্রে চীনের ওপর আমরা ৮০ ভাগ নির্ভরশীল। যথাসময়ে ফেব্রিক্স না এলে আমরা উৎপাদন কাজ চালাতে পারব না। অনেক কারখানাকে বসে থাকতে হবে। চীনে এখনো হলিডে চলছে। হলিডে শেষে যদি সরবরাহ স্বাভাবিক হয় এবং তারা রফতানি শুরু করে, তাহলে এখন যে খানিকটা সমস্যা দেখা দিচ্ছে, সেটা থাকবে না।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, চীন থেকে গার্মেন্টেসের অধিকাংশ উপকরণ আসে। মেশিনারিজের পার্টসও আসে। করোনাভাইরাসের ফলে সাপ্লাই চেইনে এরই মধ্যে একটা প্রভাব পড়েছে। যদি কোনো কারণে এটি একমাস স্থায়ী হয়, তাহলে আরও বিরূপ প্রভাব পড়বে। এরই মধ্যে যেসব অর্ডার নেওয়া হয়েছে, তার উপকরণের জন্য বিকল্প বাজার খুঁজতে হবে। আর চীন থেকে সবচেয়ে সস্তায় উপকরণ পাওয়া যেত। যদি অন্য বাজার থেকে কিনতে হয় তাহলে আরও বেশি দাম দিতে হবে। এর ফলে সময়েরও অপচয় হবে, বাড়তি খরচ হবে অর্থেরও।

এক প্রশ্নের উত্তরে ড. মোস্তাফিজুর বলেন, করোনাভাইরাস পরিস্থিতি যদি আরও দেরি হয়, তাহলে পোশাক খাতে বড় ধরনের সমস্যা হবে। আর যদি আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসতে শুরু করে, তাহলে ধাক্কাটা কাটিয়ে ওঠা যাবে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, পোশাক খাতের সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন করোনাভাইরাসের ফলে বেশ ভালোই প্রভাব পড়বে। পোশাকের অনেক উপকরণ চীন থেকে আমদানি হয়। অনেক ক্ষেত্রে আমদানি এখন স্থবির রয়েছে, উপকরণ পাঠানোর ক্ষেত্রে চীনের ব্যবসায়ীরা কিছুটা সময় বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে ব্যবসায়ীরা নির্দিষ্ট সময়ে পণ্য ডেলিভারি দিতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন। সব মিলিয়ে করোনাভাইরাসের ফলে দেশের তৈরি পোশাক খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কিন্তু এই প্রভাবের মাত্রা নির্ভর করছে ভাইরাসের স্থায়িত্বের ওপর।

করোনাভাইরাস পোশাকখাতে প্রভাব

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর