Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চুড়িহাট্টার পরের গল্প


১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ২৩:৩০

ঢাকা: চুড়িহাট্টায় ওয়াহেদ ম্যানসনের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন দীপু। অশ্রুহীন চোখে ছিল শুধুই শূন্যতা। দীপুর সঙ্গে আছেন তার মা তারামনি, এক ভাইয়ের স্ত্রী ইতি বেগম আর তার কোলে ছয় মাসের শিশু সন্তান।

জানতে চাইলাম, কেন দাঁড়িয়ে আছেন। বললেন, গত বছরের ২০ ফেব্রুয়ারির রাতে চুড়িহাট্টার এই ভবনটিতে যে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে, তাতে হারিয়েছেন পরিবারের তিন সদস্যকে। বড় ভাই মোহাম্মদ আলী, তার তিন বছরের সন্তান আরাফাত আর মেজ ভাই অপু রায়হান— তিন জনেই সেদিন প্রাণ হারিয়েছেন আগুনের ছোবলে। তিন ভাইয়ের উপার্জনে চলত সংসার। দুই ভাইয়ের মৃত্যুর পর এখন পুরো সংসারের জোয়াল দীপুর কাঁধে।

বিজ্ঞাপন

দীপু বলেন, একার আয়ে সংসার টানতে পারছিলাম না। ছেলে আর স্বামীকে হারানো বড় ভাবি তাই গিয়ে ওঠেন তার বাবার বাড়িতে। মেজ ভাবি ইতি তখন অন্তঃস্বত্ত্বা। মাস ছয়েক আগে সন্তান জন্ম দেন। সেই ভাবিও সংসারে অভাব থাকায় বাবার বাসায় গিয়ে উঠেছেন। এখন আমার আয়ে কোনোরকম সংসার চলছে।

দীপুর মেজ ভাই অপুর স্ত্রী ইতি বেগম ছয় মাসের বাচ্চা কোলে নিয়ে সারাবাংলাকে বলেন, দুই ভাই চকবাজারে দোকানে কাজ করত। বাবা খেতে এসে আরাফাতকে নিয়েই দোকানে যায় একসঙ্গে বাসায় আসবে বলে। বাসাও চুড়িহাট্টার কাছেই নন্দ কুমার দত্ত রোডের ৩৬, রহমতগঞ্জ এলাকায়। আসার পথে চুড়িহাট্টা মোড়ে বিস্ফোরণ ঘটলে তারা জীবন বাঁচানোর জন্য ওয়াহেদ ম্যানসনের ভেতরে যান। সেখানেই তাদের মৃত্যু হয়। তাদের পুরো শরীর ঝলসে যায়।

কাঁদতে কাঁদতে দীপুর মা তারামনি বেগম বলেন, মরদেহ বুঝে নেওয়ার সময় জেলা প্রশাসন থেকে ২০ হাজার টাকা ছাড়া আর কোনো সাহায্য পাইনি। দুই ছেলে আর এক নাতিকে হারিয়ে এখন আমরা দিশেহারা। সরকারের উচিত আমাদের পুনর্বাসন করা।

বিজ্ঞাপন

সেদিনের ভয়াবহ আগুনে প্রাণ গেছে সিদ্দিক উল্লাহর। তিনি চকবাজারের একটি গুদামে কাজ করতেন। পরিবার নিয়ে চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানসনের পাশে ৩৫ নম্বর বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। ঘটনার রাতে ওয়াহেদ ম্যানসনের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বিকট শব্দে আওয়াজ হলে অনেকের সঙ্গে তিনিও ওয়াহেদ ম্যানসনের ভেতরে চলে যান (নিচ তলার সিঁড়ি ঘরের মতো জায়গাটিতে)। সেখান থেকেই পরদিন তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তার ছেলে আহসান উল্লাহ এসেছিলেন বাবার প্রাণ কেড়ে নেওয়া সেই ভবনের সামনে।

আহসান উল্লাহ বলেন, বাবাকে হারিয়ে এমনিতেই আমাদের সংসারের টালমাটাল অবস্থা। ছোট দুই ভাইয়ের পড়ালেখা বন্ধ, কাজে দিয়েছি ওদের। মা অসুস্থ। এর মধ্যেও গত একবছর সিটি করপোরেশনে দরজায় দরজায় ঘুরে বেড়িয়েছি। মেয়র প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন নিহতের সন্তানদের একটা ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। এখন আমরা অসহায় জীবন যাপন করছি।

২৬ আজগর আলী লেন থেকে এসেছিলেন নাসিমা আক্তার রনি। সেদিনের আগুনে মারা গেছেন তার বাবা জয়নাল আবেদীন। কথা বলতে গিয়েই কেঁদে উঠলেন। একমাত্র মেয়ে তিনি। ছোট দুই ভাইকে এখন তাকেই দেখাশোনা করতে হয়। এক ভাইয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন বাবা। বাড়ির ভাড়া তুলতেন আর নামাজ ও কোরআন শরীফ পড়েই সময় কাটাতেন। একমাত্র নাতি রাহাতকে নিয়ে সময় কাটাতেন।

সেই রাতের বর্ণনা দিয়ে নাসিমা আক্তার সারাবাংলাকে বলেন, এশার নামাজের পর বাবা কোরআন তেলাওয়াত করেন। এরপর নাতির সঙ্গে চলে তার দুষ্টুমি। বাবা অভিনয় করে দেখালে নাতি রাহাত দাদাকে বলে, বুড়া হইলাম তোর কারণে। এ কথা শুনে বাবা হাসতে হাসতে বেরিয়ে পড়েন। ওয়াহেদ ম্যানসনের সামনে ভ্যানে সবজি বিক্রি হতো। সেখান থেকে সবজি কিনতেই বের হন তিনি। এর কিছুক্ষণ পরই আগুন আগুন চিৎকার শোনা যায়। মা ফোন করেন বাবাকে। ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। সব জায়গায় বাবার খোঁজ করি। শেষ পর্যন্ত বাবার খোঁজ পাওয়া যায় ঢাকা মেডিকেলের মর্গে।

‘একটা পরিবারে বাবা যে কী, তা আমরা হারে হারে টের পাচ্ছি। আর আমাদের বাবাই ছিল সব,’— বলেন তিনি।

রনি আরও বলেন, রাহাত দাদাকে হারিয়ে বেশ কয়েকদিন অসুস্থ ছিল। শুধু দাদা কোথায়, দাদা কোথায় বলে চিৎকার করত। এরপর অসুস্থ হলে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। এখন সে বলে, ‘দাদা তারা হয়ে গেছে।’

চুড়িহাট্টার সেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের একবছর যখন পূর্ণ হতে যাচ্ছে, তখন ওয়াহেদ ম্যানসনের সামনে দাঁড়িয়ে দেখা গেল এমন সব চিত্র। মঙ্গলবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) সারাদিন ওয়াহেদ ম্যানসনের সামনে দাঁড়িয়ে দেখা গেল, ওই ভবনের আগুনে যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের স্বজনরা ফিরে ফিরে আসছেন ভবনটির সামনে। স্থানীয়রা জানালেন, গত একবছরের প্রতিটি দিনই এমন কোনো না কোনো স্বজন ঠিক এসে দাঁড়িয়ে থাকেন এখানে। তাদের কারও চোখে থাকে বেদনার শূন্যতা, কারও চোখে অশ্রু।

তেমনই একজন ফাতেমা আক্তার। এসেছেন ৪১, হাজী বালু রোড থেকে। সেদিনের ভয়াবহ আগুন তার স্বামী ফয়সালকে কেড়ে নিয়েছে। দুই মেয়ে ফাহিমা তানজিম (১৬) আর ফারিহা তাসনীমকে (১২) নিয়ে অভাবের সংসার পার করছেন। দুই মেয়ের লেখাপড়া আর সংসারের খরচ চালাতে অনেক কষ্ট করতে হচ্ছে। বাবার বাড়ি থেকে সহায়তা করা হচ্ছে বলে তারা বেঁচেবর্তে আছেন বলে জানান ফাতেমা।

ফয়সাল যেখানে ব্যবসা করতেন, আগুনে পুড়ে মারা যাওয়ার পর সেখানকার কেউ তাদের খোঁজ নিতে আসেননি। এমনকি তিনি জানতেনও না যে স্বামী কোথায় ব্যবসা করতেন। তাই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো সহায়তা পাননি তারা। অনেককে জিজ্ঞাসা করেও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কোনো খোঁজ মেলেনি।

সেদিনের ভয়াবহ আগুন কেড়ে নিয়েছিল শাহীন মোল্লার প্রাণ। তার স্ত্রী ময়না বেগম ওয়াহেদ ম্যানসনের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন। সারাবাংলাকে বলেন, চকবাজারে ব্যবসা করতেন। সকালে মেয়ে স্কুলে যাবে, সেজন্য রাতেই নাস্তা এনে রাখতেন। এশার নামাজের পর রাজমহল হোটেলে যান সেই নাস্তা আনতে। তখনই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। তিন মেয়েকে নিয়ে ছিল তাদের সংসার। এখন বাবার বাড়ি আর ভাইয়ের বাসা থেকে যা সাহায্য আসে, তাই দিয়ে আপাতত সংসার চালাচ্ছেন।

সংসার ভালোভাবে চলছে?— এমন প্রশ্নের উত্তরে ময়না বলেন, ‘সংসারের সব প্রয়োজন অনুযায়ী কি কেউ কিছু দিতে পারে? কোনো উপায় নেই। যা দেয়, তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। এভাবে কতদিন চলবে জানি না।’ বলতে বলতেই আনমনা হয়ে যান ময়না বেগম।

সেদিনের আগুনে তিন ছেলের দুই ছেলেকে হারিয়ে বাবা ফয়সাল হোসেন হতবিহ্বল। এর মধ্যে এক ছেলে মারা যায় বিয়ের মাত্র ২৮ দিনের মাথায়। মাস তিনেক আগে সেই ছেলের সন্তান জন্ম দিয়েছেন পুত্রবধূ। ফয়সাল বলেন, বাবাকে দেখতে পারেনি আমার নাতিটা। যেখানে আমার মরার কথা, সেখানে দুই ছেলের মরদেহ কাঁধে নিয়ে কবরস্থানে যেতে হয়েছে। কী করব, এখনো মাঝে মাঝে বুঝে উঠতে পারি না। তবু যদি সরকার আমাদের জন্য কিছু করত, কিছুটা হলেও স্বস্তি পেতাম।

ফয়সাল হোসেন আরও বলেন, ‘প্রতিদিন নামাজ পড়ে একবার চুড়িহাট্টার এই ভবনের সামনে আসি। দোকানে কাজ শেষ করে ছেলে দুইটা আমার ঘরে ফিরছিল। ওয়াহেদ ম্যানসনের আগুন কেড়ে নিলো আমার ছেলে দুইটাকে।’ প্রতিদিন ওয়াহেদ ম্যানসনের সামনে গিয়ে হয়তো হারিয়ে ফেলা দুই ছেলেকেই খুঁজে ফেরেন।

একবছর আগে ৬৭টি তাজা প্রাণ কেড়ে নিয়ে তবেই শান্ত হয়েছিল চুড়িহাট্টার ওয়াদেহ ম্যানসনের সেই আগুন। বছর গড়ালেও সেই আগুনের লেলিহান শিখা আজও বেদনায় ম্লান করে দিয়ে যায় আগুনে হারানো মানুষগুলোর স্বজনদের। ওয়াহেদ ম্যানসন তাদের কাছে হারানো স্বজনদের স্মৃতির শেষ আঁচড় হয়েই যেন দাঁড়িয়ে রয়েছে।

ওয়াহেদ ম্যানসন চুড়িহাট্টা চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ড চুড়িহাট্টায় আগুন চুড়িহাট্টার একবছর

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর