কেমিক্যাল গোডাউনের জায়গা নিয়েছে প্লাস্টিক কারখানা
২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১০:৩০
ঢাকা: কেমিক্যালের এক গোডাউন থেকেই একবছর আগে আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায়। সেই আগুন কেড়ে নিয়েছিল ৬৭ জনের প্রাণ। এমন বসতি এলাকায় যেন কেমিক্যালের কোনো গোডাউনের স্থান না হয়, তা নিয়ে সরব হয়েছিলেন সবাই। কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতির বদল হয়েছে সামান্যই। স্থানীয়রা বলছেন, ওয়াহেদ ম্যানসনের সেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর কেমিক্যালের গোডাউন গুটিয়ে নিয়েছেন কেউ কেউ। তবে এলাকার ৭৫ শতাংশ বাড়িতেই রয়েছে প্লাস্টিক ও পলিথিনের কারখানা। বাসিন্দারা এসব কারখানা অপসারণ চাইলে ব্যবসায়ীরা তাদের কারখানা সরাতে নারাজ।
এদিকে, ভূতুড়ে বাড়িতে পরিণত হওয়া ওয়াহেদ ম্যানসনের সামনে দিয়ে দিনের বেলা চলাচল করলেও রাতে কেউ ওই পথ মাড়াতে চান না সহজে। ক্ষোভ, হতাশা, কষ্ট নিয়ে এলাকাবাসীর দাবি, ভবনটিকে সরিয়ে ফেলতে হবে। তা না হলেও করতে হবে সংস্কার।
চুড়িহাট্টার নন্দ কুমার দত্ত সড়ক, আজগর আলী লেন, ওয়াটার ওয়াক্স সড়ক, হায়দার বক্স লেন ও চকবাজার লেন সড়কের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা হয় সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের। তারাই তুলে ধরেন চুড়িহাট্টা এলাকার এখনকার চিত্র।
চুড়িহাট্টার আগুনে প্রাণ হারানো ওয়াসী উদ্দিন মাহিদের বাবা নাসির উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, পুরান ঢাকায় কেমিক্যাল গোডাউন থাক, তা আমরা কেউই চাই না। আমরা সরকারের সঙ্গে বসতে চাই। কিন্তু জেনেশুনে আমাদেরই কেউ কেউ কেমিক্যাল গোডাউন ভাড়া দিচ্ছি। আবার সরকারের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।
নাসির উদ্দিন আরও বলেন, আমার দুই মেয়ে এক ছেলে ছিল। বড় মেয়ে ক্যানসারে মারা গেল। ছেলেটাও আগুনে পুড়ে মারা গেল। একমাত্র আয়ের উৎস ছিল ছেলের কর্ম। এখন দুর্দিন যাচ্ছে পরিবারে।
তিনি বলেন, আড়ালে অনেকেরই কেমিক্যালের গোডাউন চালাচ্ছেন। তবে তারা অনেক শক্তিশালী। আবাসিক ভবনের নিচে পলিথিন ও প্লাস্টিক জাতীয় পণ্য উৎপাদন কারখানা রয়েছে। এসবও অনেক ভয়াবহ। আগুনের ঘটনা পর এই এলাকার ব্যবসায় ধ্বস নেমেছে। লোকজন ওয়াহেদ ম্যানসনের সামনে দিয়ে হাঁটে না, অন্য সড়ক ব্যবহার করে। এই এলাকা আগে যেরকম জমজমাট ছিল, এখন তা নেই।
উর্দু রোডে প্লাস্টিকের খেলনা তৈরির একটি কারখানার নাম আয়েশা এন্টারপ্রাইজ। কারখানার ম্যানেজার মোহাম্মদ মাসুম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা প্লাস্টিকের খেলনা জিনিসপত্র তৈরি করি। এখানকার ৭৫ শতাংশ বাড়ির নিচে এরকম কারখানা রয়েছে। কিন্তু আমরা চাই না, আমাদের কারখানা অন্য জায়গায় নেওয়া হোক।’ তাদের কারখানায় কোনো দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করা হয় না বলে দাবি মাসুমের।
মালিহা এন্টারপ্রাইজ নামে আরেকটি কারখানার মালিক এরশাদ হোসেন বলেন, ‘চুড়িহাট্টার আগুনের কারণে ব্যবসার ওপর দিয়ে ঝড় গেছে। এরপরও আমরা ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছি। এ শিল্পের ওপর লাখ লাখ মানুষের ভবিষ্যত যুক্ত। ব্যবসা বন্ধ হলে এত মানুষ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? তাই আমরা চাই, প্লাস্টিক নয়, কেমিক্যাল গোডাউন এখান থেকে সরানো হোক।’ যদিও এখন এই এলাকায় কোনো কেমিক্যাল গোডাউন নেই বলেও দাবি করেন তিনি।
চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির একবছরে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলোর মধ্যে রাজ মহল হোটেল, মোল্লা রেস্তোরাঁ, ইকরা বিরিয়ানি, নিশাত এন্টারপ্রাইজ আর মসজিদের পাশে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটিতে আবার ব্যবসা চালু হয়েছে। তবে ওয়াহেদ ম্যানসন, রাজ্জাক ম্যানসন আর কর্ণফুলী হোটেলের সঙ্গের ওষুধের দোকানটি চালু করা হয়নি। এর মধ্যে রাজ্জাক ম্যানসন ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ওয়াহেদ ম্যানসনও ভেঙে ফেলার সুপারিশ রয়েছে। তবে ভবন দু’টির কোনোটিই ভেঙে ফেলার কোনো উদ্যোগ এখনো নেওয়া হয়নি।
এদিকে, আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত মসজিদের বাইরের দেয়ালে একবছর পর সংস্কার কাজ মাত্র শুরু হয়েছে। ওয়াহেদ ম্যানসনেও নিচের দোকান ও দ্বিতীয় তলায় সংস্কার কাজ শুরু হয়েছিল। গত সেপ্টেম্বরে সারাবাংলায় একটি খবর প্রকাশের পর রাজউক ও সিটি করপোরেশন থেকে সে উদ্যোগ বন্ধ করা হয়।
রাজ্জাক ম্যানসনের সামনে ফল বিক্রি করতেন বাবুল মিয়া। তিনি বলেন, আগুন লাগার পর এখন লোকজন আসে না এদিক দিয়ে। একদিনের ফল বিক্রি করতে চার দিন লাগে। মসজিদ না থাকলে চুড়িহাট্টা মোড় দিয়ে কেউ চলাচলও করত না।
রাজ মহল হোটেলের ম্যানেজার হাকিম উদ্দিন বলেন, মানুষ খেতে বসেও আতঙ্কে থাকে। না জানি আবার কোন ভবন ভেঙে পড়ে। আগুনের গোলায় সবকিছু তছনছ করে দেয়। এজন্য কাস্টমার অনেক কম। আমরাও সতর্ক রয়েছি, আগের মতো কোথাও কেমিক্যালের সন্ধান পাওয়া যায় তবে তার বিরুদ্ধে সবাই অ্যাকশনে যাব।
হাকিম উদ্দিন আরও বলেন, ওয়াহেদ ম্যানসন ভবনটি হয় সংস্কার করা হোক, নতুবা ভেঙে ফেলা হোক। এভাবে পোড়া একটি ভবন দাঁড়িয়ে আছে দেখলেই সবার কেমন জানি ভয় লাগে। দেখলে মনের ভেতর আতঙ্ক কাজ করে। মনে হয়, এখানেই কতগুলো লোক মারা গেছে।
মোল্লা রেস্তোরাঁর ম্যানেজার রবিউল ইসলামও বলেন, ভবনটির বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। আগুন লাগার পর চুড়িহাট্টা এলাকায় সব ধরনের ব্যবসায় ধ্বস নেমেছে। মানুষজন আসে না। আসলেও ওয়াহেদ ম্যানসন ঘুরে চলে যায়।
ইকরা বিরিয়ানির মালিক জসিম উদ্দিন বলেন, যারা চুড়িহাট্টায় আসেন, তারা ওয়াহেদ ম্যানসন দেখে বলেন, এই ভবনটি এভাবে ফেলে রাখা হয়েছে কেন? এটা সরকার ভেঙে ফেলে না কেন? একই প্রশ্ন তো আমাদেরও।
জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ মো. ইমদাদুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ভবন ভেঙে ফেলা বা অনুমোদন দেওয়া সিটি করপোরেশনের কাজ নয়। এটি রাজউক করে থাকে। তবে আমরা চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর ওয়াহেদ ম্যানসন ভবনটি ভেঙে ফেলার সুপারিশ করেছিলাম। পরবর্তী সময়ে কী হয়েছে, তা আমাদের জানা নেই।
এ বিষয়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পরিচালক (প্রশাসন) শারমিন জাহানের কাছে জানতে চাইলে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ওয়াদেহ ম্যানসন ভেঙে ফেলার বিষয়টি আমার সঠিক জানা নেই।
গত বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টার দিকে চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানসনের দ্বিতীয় তলায় বিস্ফোরণের পর আগুন ছড়িয়ে পড়ে পাশের বেশ কয়েকটি ভবনে। আগুনে ৬৭ জন মানুষের মৃত্যু হয়। আরও বেশ কয়েকজন দগ্ধ হন।
এ ঘটনায় আগুনে দগ্ধ হয়ে নিহতের এক ছেলে বাদী হয়ে চকবাজার থানায় মামলা করেন। সেই মামলায় ওয়াহেদ ম্যানসনের মালিক হাসান ও সোহেল গ্রেফতার হয়ে কারাগারে যান। তারা এখন জামিনে রয়েছেন। এ ঘটনার পর সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়। পুরান ঢাকা থেকে সব ধরণের কেমিক্যাল গোডাউন সরানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। রাজউক ও সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে অভিযান চালানো হয়। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির লাইন বিচ্ছিন্ন করা হয়। এরপর থেমে যায় সব ধরনের অভিযান।
আগুন চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আগুন চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডি প্লাস্টিক গোডাউন