অস্ত্র-গুলি, ইয়াবা-হেরোইন ব্যবসায় জড়িত ডিবির সেই এসআই
২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ২৩:০০
ঢাকা: বিপুল পরিমাণ গুলি, ইয়াবা, হেরোইন, গাজা, মদ, বিয়ার, একটি পিস্তল ও দেশীয় অস্ত্রসহ নারায়ণগঞ্জ গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উপপরিদর্শক (এসআই) জলিল মাতব্বরকে (৪৩) আটক করার পর আদালত তাকে দুই দিনের রিমান্ডে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। পুলিশ জানিয়েছে, ডিবি পুলিশে কর্মরত থাকায় বিভিন্ন মামলায় উদ্ধার হওয়া আলামত জব্দ না দেখিয়ে নিজের কাছে রেখে ব্যবসা করতেন। আবার কখনো নিরীহ লোকদের ফাঁসানোর কাজে ব্যবহার করতেন।
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ডিবির এসআই জলিল মাতব্বরের কাছ থেকে মাদকসহ যেসব আলামত উদ্ধার করা হয়েছে, তার মূল্য প্রায় ১৬ লাখ ৫৪ হাজার ৮৫০ টাকা। জলিলের বাড়ি বাগেরহাট জেলার মোড়লগঞ্জ উপজেলার পাঠামারা গ্রামে। তার বাবার আব্দুল জব্বার মাতব্বর।
আরও পড়ুন- রাজধানীতে অস্ত্র ও ইয়াবাসহ পুলিশের এসআই আটক
বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে দারুস সালাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তোফায়েল আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস কল্যাণপুর শাখার মাধ্যমে খবর পেয়ে দারুস সালাম থানা পুলিশ একটি ট্রাংক ও ফাইল কেবিনেট জব্দ করে থানায় নিয়ে আসা হয়। কারণ ওই ফাইল কেবিনেটের ড্রয়ার খুলে যাওয়ায় ভেতর থেকে মদের গন্ধ বের হচ্ছিল। পরে সব চেক করতে গিয়ে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হয়।
ওসি তোফায়েল বলেন, ড্রয়ার থেকে একের পর এক গুলি, অস্ত্র, ইয়াবা, মদ, গাজা, হেরোইন, দেশীয় অস্ত্রসহ নানা ধরনের জিনিসপত্র বেরিয়ে আসে। একপর্যায়ে জলিল মাতব্বর থানায় এসে হাজির হয়। পরে তাকে আটক করা হয়। আজ (বৃহস্পতিবার) তার বিরুদ্ধে মাদক আইনে মামলা দিয়ে ৭ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হয়। আদালত শুনানি শেষে দুই দিনের রিমান্ডে মঞ্জুর করেছেন।
ওসি আরো বলেন, এত মাদক ও গুলি কোথা থেকে পেয়েছে, কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, এর পেছনে আর কেউ জড়িত কি না— রিমান্ডে এসব বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, জলিল মাতব্বর ১৯৯৮ সালে কনস্টেবল পদে পুলিশে যোগ দেন। এরপর ২০০৮ সালে তিনি এএসআই (সহকারী উপপরিদর্শক) পদে পদোন্নতি পান। ২০১৫ সালে এসে তিনি পদোন্নতি পেয়ে এসআই হন। এর আগে তিনি ডিএমপির লালবাগ বিভাগ, গাজীপুর জেলা পুলিশ ও নারায়ণগঞ্জে চাকরি করেন। এই তিন জায়গায় পুলিশের আরেক ক্ষমতাশালী কর্মকর্তার হয়ে তিনি কাজ করতেন। ওই কর্মকর্তা ক্লোজড হয়ে পুলিশ সদর দফতরে আসার পর জলিল নারায়ণগঞ্জ থেকে বদলির জন্য উঠে পড়ে লাগেন। এরপর তিনি গত ২ ফেব্রুয়ারি গোপালগঞ্জে বদলির আদেশ পান।
পুলিশের আরেক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, জলিল নারায়ণগঞ্জ ডিবিতে থাকা অবস্থায় নিরীহ মানুষকে ধরে এনে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করতেন। না পেয়ে গুলি, বন্দুকের কার্তুজ, ইয়াবা, মদ ও হেরোইন দিয়ে ফাঁসাতেন। এরপর তাকে রিমান্ডের নামে নির্যাতন করতেন। টাকার বিনিময়ে এরপর সবকিছু ম্যানেজ করতেন জলিল। ঢাকাতেও তার অবৈধ গুলি ও মাদক ধরা পড়া পর নিজেই থানায় উপস্থিত হয়ে পুলিশের সঙ্গে দম্ভোক্তি করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এসব আমার মালামাল। আমার বাড়ি গোপালগঞ্জ। আমি ডিবির এসআই। ছেড়ে দেন আমার সব মালামাল।‘ তবে কিছুতেই কাজ হয়নি।
মামলার এজাহারে এসআই জলিলের কাছ থেকে জব্দ করা মালামালের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, স্টিলের তৈরি চার ড্রয়ারের একটি ফাইল কেবিনেট পাওয়া যায়। কেবিনেটের প্রথম ড্রয়ারে ছিল তিনটি চাবি। দ্বিতীয় ড্রয়ারে ছিল রুপালি রঙের কাঠের বাটযুক্ত ম্যাগজিন ছাড়া একটি পিস্তল। তবে পিস্তলের ট্রিগারটি অকেজো পাওয়া যায়। দ্বিতীয় ড্রয়ারে আরও পাওয়া যায় কালো রঙের একটি টিনের তৈরি পিস্তল, যার গায়ে মেড ইন চায়না লেখা রয়েছে। এর সঙ্গে ছিল ১১ রাউন্ড পিস্তলের গুলি।
এছাড়া চায়না রাইফেলের গুলি ১০ রাউন্ড, যার গায়ে বিওএফ ৮৬৭.৬২ গুণ ৩৯ লেখা আছে। রাইফেলের গুলি ছিল ৮ রাউন্ড, যার চারটির গায়ে পিওএফ ৬.০ ও বাকি চারটির গায়ে পিওএফ ৬.৫ লেখা আছে। এর বাইরেও ১৩ পিস রাইফেলের খোসা, ৪০টি শটগানের কার্তুজ (১১টি সবুজ রঙের, দুইটি খয়েরি, সাতটি কালো, ১১টি সাদা, সাতটি নীল, একটি লাল ও একটি রুপালি রঙের) এবং ২০টি শটগানের ফায়ার করা কার্তুজের খোসা পাওয়া যায় জলিলের কেবিনেটের দ্বিতীয় ড্রয়ারে।
তৃতীয় ড্রয়ারে পাওয়া যায় ১০টি বিদেশি বিভিন্ন ব্রান্ডের বিয়ার ক্যান, ৩৬ দশমিক ৩০ গ্রাম ওজনের একটি সোনার সীতা হার, ১৩ দশমিক ৩৬ গ্রাম ওজনের সোনার গলার চেন, ৬ দশমিক ২৯ গ্রাম ওজনের সোনার একটি ব্রেসলেট, ১০ দশমিক ৯০ গ্রাম ওজনের সোনার এক জোড়া কানের ঝাপটা, ১১ দশমিক ৮৫ গ্রাম ওজনের সোনার এক জোড়া কানের ঝুমকা ও দশমিক ৭৫ গ্রাম ওজনের সোনার দুইটি নাক ফুল।
মালামাল জব্দ করার সময় আরও পাওয়া যায় ৩৬ দশমিক ৭০ গ্রাম ওজনের রুপার তৈরি গলার দুইটি চেইন ও ৪ দশমিক ৭০ গ্রাম ওজনের রুপার তৈরি পায়ের নুপুর, পলিথিনে মোড়ানো দুই প্যাকেট গাঁজা, আরেক কাগজে মোড়ানো ১১০ পুড়িয়া গাঁজা (১ কেজি ৩০০ গ্রাম), ৪০ দশমিক ৭৫ গ্রাম ওজনের হেরোইন, ৫ হাজার ২৮৯ পিস ইয়াবা, কালো রঙের একটি পিস্তলের কাভার, চারটি ক্যাচি, সুইচ গিয়ার চাকু চারটি, হাতুড়ি একটি, নকিয়া, আসুস, উইনম্যাক্স, স্যামসাং ও সিম্ফনি ব্র্যান্ডের মোবাইল ফোন ২৭টি মোবাইল ফোন।
এজাহারে ট্রাংকের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, ট্রাংক থেকে এসআই জলিলের বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টের চেক, ব্যক্তিগত কাগজপত্র, বিভিন্ন মামলার কাগজপত্র, হ্যান্ডকাফ ও পাঁচ সেট পুলিশের পোশাক জব্দ করা হয়।
১৯ ফেব্রুয়ারি রাতে ডিবির এসআই জলিল মাতব্বরের বিরুদ্ধে বিক্রির উদ্দেশ্যে অবৈধ পথে মাদক পাচারের অপরাধে মামলা করা হয়। মামলার বাদী হয়েছেন দারুস সালাম থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) দুলাল হোসেন।
দারুস সালাম থানা পুলিশের একজন এসআই নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, জলিল মাতব্বর ডিবি পুলিশে চাকরির সুবাদে ক্ষমতা ব্যবহার করে মাদক ও অবৈধ গুলির ব্যবসা করতেন। যেসব গুলি পাওয়া গেছে, তার একটিও বৈধ অস্ত্রের নয়। সবগুলো গুলি অবৈধ অস্ত্রের, যা সন্ত্রাসী, ছিনতাইকারী ও দুষ্কৃতিকারীদের কাছে বিক্রি করতেন বলে জানা গেছে। এছাড়া মাদক কখনো বিক্রি করতেন, আবার কখনো নিরীহ মানুষকে ফাঁসানোর কাজে ব্যবহার করতেন। তাকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। এখন সবকিছু বেরিয়ে আসবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার মাসুদুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, গুলি ও মাদকসহ নারায়ণগঞ্জ ডিবি পুলিশের এসআইকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরই মধ্যে তিনি রিমান্ডেও এসেছেন। ব্যক্তি পুলিশের দায় ডিএমপি নেয় না। তিনি অপরাধ করেছেন, পুলিশ তার বিরুদ্ধ আইনি ব্যবস্থা নিয়েছে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে পুলিশ বিভাগ আলাদা একটি বিভাগীয় মামলা করবে।