ভাষা আন্দোলনের সাক্ষী আম গাছটি নেই, সংরক্ষণ হয়নি গেটটিও
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১৮:০৪
ঢাকা: ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের আমতলা। ইতিহাসের বাঁক নির্মাণে এই জায়গাটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আছে। ১৯৫২ সালের ২১শে ফ্রেব্রুয়ারি। মায়ের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে এই আমতলার গেট থেকে মিছিল বের করেছিল বিক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজ। আর কারফিউ ভঙ্গের দায়ে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ মিছিল লক্ষ্য করে গুলি চালায়। এতে আন্দোলনকারীদের রক্তে রক্তাক্ত হয় আমতলা, ঢাকা মেডিকেল আর পলাশী। এ সময় শহীদ হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সালাম, বরকত ও শফিউল্লাসহ নাম না জানা অনেকে। তাদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয় পশ্চিম পাকিস্তান গোষ্ঠী। আর তখন থেকেই ২১শে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে।
রক্তের বিনিময়ে মায়ের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করার ইতিহাস পৃথিবীতে বিরল। আর এই বিরল ইতিহাসকে সম্মান জানাতেই শহিদ দিবসকে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দেয় ইউনেসকো। ঠিক পরের বছর ২০০০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি থেকে পৃথিবীর ১৮৮টি দেশে দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন শুরু হয়। বর্তমানে বিশ্বের ১৯৩টি দেশের মানুষ দিনটিকে ‘আন্তজার্তিক মাতৃভাষা দিবস’ পালন করছে। অথচ যে জায়গাটি থেকে ২১শে ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক ঘটনা সৃষ্টি সেই আমতলা আজও অমর্যাদায় পড়ে রয়েছে। ইতিহাস একে একে ৬৮ বছর পারি দিলেও আমতলা সংরক্ষণে নেই কোনো কার্যকরী উদ্যোগ। শুধু প্রতিশ্রুতিতেই বাঁধা থাকছে ঐতিহাসিক আমতলার মর্যাদা সংরক্ষণ কাজ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমান ঢামেকের জরুরি বিভাগের প্রবেশ মুখের পূর্বপাশে দ্বিতল তালাবদ্ধ গেটটিই আমতলার গেট। এক সময় সেখানে ছিল ঐতিহাসিক কালজয়ী একটি বড় আম গাছ। আর এই আম গাছের শীতল ছায়ায় বসে মিছিল-মিটিংসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতেন নেতারা। ঐতিহাসিক এই আমতলা থেকে মাতৃভাষাকে রক্ষার মত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে ছাত্রসমাজ গেট পেরুতেই তাদের ওপর পুলিশ গুলি ছোড়ে।
শুধু ভাষা আন্দোলন নয়, দেশের স্বাধীনতা অর্জন এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সাহিত্য-সংস্কৃতির বহু স্মৃতিবিজড়িত স্থানের মধ্যে অন্যতম এই আমতলা। অথচ বর্তমানে জ্বরাজীর্ণ ও তালাবদ্ধ হয়ে আছে আমতলার গেটটি। এক সময় স্থানটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরে এটি ঢামেকের বার্ন ইউনিটে চলে যায়। ঢামেককে আরও প্রশস্ত করতে ভাষা আন্দোলনের ৪৩ বছর পর ১৯৯৫ সালের ২২ নভেম্বর ইতিহাসের নীরব সাক্ষী সেই আম গাছটিকে কেটে ফেলে কলেজ কর্তৃপক্ষ। এতে ধীরে ধীরে ঐতিহ্য হারাতে বসে স্থানটি। যদিও সেই ঐতিহাসিক আমগাছটি এখন ডাকসুর সংগ্রহশালায়। কিন্তু গাছটি সংরক্ষণ করতে পারলেও ঐতিহাসিক স্থানটি সংরক্ষণ হয়নি আজও।
বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা-৯৬) আমতলা নিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘১৯৪৮ সালের মার্চের ১৬ তারিখ সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্রসভায় আমরা সকলেই যোগদান করেছিলাম। হঠাৎ কে যেন আমার নাম প্রস্তাব করে বসল সভাপতির আসন গ্রহণ করার জন্য। সকলেই সমর্থন করল। বিখ্যাত আমতলায় এই আমার প্রথম সভাপতিত্ব করতে হলো। অনেকেই বক্তৃতা করল।’ তার আত্মজীবনী থেকে এটা স্পষ্ট যে, আমতলা প্রাঙ্গণটি কত বিখ্যাত ছিল। কিন্তু এত বছর পরেও ঐতিহাসিক ওই স্থানটি সংরক্ষণ হয়নি কিংবা এর মর্যাদা রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এমনকি এ বিষয়ে তেমন কোনো উত্তর দিতে পারেননি জায়গাটির বর্তমান মালিক ঢামেক কর্তৃপক্ষ।
বুধবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১১টার দিকে ঢামেকের আমতলার গেটের সামনে গিয়ে জানা যায়, সকাল নয়টার দিকে ২১ ফেব্রুয়ারিকে সামনে রেখে স্থানটি পরিষ্কার করার জন্য সেখানে থাকা শতাধিক ভাসমান দোকান উচ্ছেদ করেছে হাসপাতালের পরিচালক। কিন্তু উচ্ছেদের দুই ঘণ্টা পর ফের সেখানে ডিম, পান, সিগারেট, ডাব ও হরেক রকম মালের দোকান নিয়ে পসরা সাজিয়ে হরদম কেনাবেচা করছেন হকাররা।
গেটটির সামনে গত সাত বছর ধরে সিদ্ধ ডিম বিক্রি করছেন রোকেয়া নামের ৫২ বছর বয়সী নারী। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রতিবছর ২১শে ফেব্রুয়ারি আসলে আমগোরে তুলে দেয়। আইজ সকালেও পরিচালক স্যার আমগোরে তুলে দিছে। কিন্তু ঘণ্টা খানেক পরে ফের বসছি। কি করমু বাপ, পেট তো চালান লাগবো।’
আপনি যে গেটের সামনে বসে দোকান খুলেছেন সেটি কিসের গেট জানেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা তো মেডিকেলের গেট। হুনছি আগে এই গেট দিয়া মানুষ ঢুকতো। এহুন ওই গেট (বর্তমান গেট) হওয়ায় এইটা আর খোলে না। এছাড়া তো আর কিছু জানি না বাবা।’
ডাব বিক্রেতা নয়ন (৩৫) সারাবাংলাকে বলেন, ‘ওই যে দেখতেছেন গেটের উপরে লেহা আছে ভাষা আন্দোলনের সময় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল অইছিল, আমরা এটা জানি। কিন্তু কী কারণে কী হইছিল তা জানি না।’ পান বিক্রেতা সবুজও একই কথা জানালেন। তিনি বলেন, ‘এটা যে আমতলার প্রাঙ্গণ সেটা আপনার কাছে শুনলাম।’
শুধু রোকেয়া, নয়ন কিংবা সবুজ নয়, স্থানটি সম্পর্কে জানেন না সেখানকার অধিকাংশ মানুষ। তারা কেউ জানেন না এই গেটটি মূলত কীসের কিংবা এর ইতিহাস কী। কেউ কেউ গেটের উপরে কালো অক্ষরে ‘ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত আমতলার ঐতিহাসিক প্রাঙ্গণ থেকে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির এই দিনে ছাত্রসমাজ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মিছিল করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে। উদ্যোক্তা: ভাষা আন্দোলন পরিষদ’ লেখা সাইনবোর্ডটি দেখে জানতে পারছে এ স্থানটি ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। কিন্তু সেটির গুরুত্ব কতটুকু, সে সম্পর্কে সম্যক ধারণা নিতে পারছেন না হাসপাতালে আসা রোগীর স্বজনরাও।
বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ থেকে রোগী নিয়ে ঢামেকে আসা কলেজ শিক্ষার্থী রাসেল সারাবাংলাকে বলেন, ‘বইতে পড়েছি ঐতিহাসিক আমতলা থেকে ভাষার দাবিতে মিছিল নিয়ে বের হলে পুলিশ গুলি করে। তখন অনেক বাঙালি শহীদ হয়েছিলেন। কিন্তু স্থানটি যে মেডিকেলের সামনে এটা তো জানতাম না।’ আমতলার কথা শুনে রাসেল গেটের সামনে গিয়ে হতবাক। সেখানে একটা সাইনবোর্ড ছাড়া আর তেমন কিছুই নেই যে, ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে কিছুটা হলেও জানবে। রাসেল সারাবাংলাকে বলেন, ‘অন্তত গেটের সামনে যারা নিহত হয়েছেন তাদের বিস্তারিত বিবরণসহ একটা তোরণ করা যেত। এতে আগামী প্রজন্ম ২১শে ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক জায়গাটি সম্পর্কে ধারণা পেত।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডাকসুর সাবেক কোষাধক্ষ অধ্যাপক ড. বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘১৯৯৫ সালে যখন আম গাছটি কাটা হয় তখন ঢামেক কর্তৃপক্ষ সেটি নিয়ে বিপাকে পড়ে। পরে আমিই বলি, গাছটি ফেলার দরকার নেই। আমাদের জায়গা আছে, আমরা গাছটি সংরক্ষণ করব। তারা রাজি হয়। পরে লিখিতভাবে গাছটা আমরা নিয়ে আসি। যেটি এখনও ডাকসুতে আছে। কিন্তু আমতলার গেটটি আজও সংরক্ষণ হয়নি।’
তবে হতাশার মাঝে আশার কথা হলো- আমতলা প্রাঙ্গণটি না থাকলেও যে গেটটি আছে সেটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে ঢামেক কর্তৃপক্ষ। অন্তত রোগীর স্বজন ও দর্শনার্থীরা যেন খুব সহজেই বুঝতে পারে গেটটির ইতিহাস সে জন্য এটিকে যত দ্রুত সম্ভব সংরক্ষণ করবেন বলে জানিয়েছেন ঢামেকের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম নাসির উদ্দিন।
তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘যেটি এত বছরেও সংরক্ষণ হয়নি সেটি আগামীতেও হবে না, এ ধারণা ভুল। আমি উদ্যোগ নিয়েছি, কীভাবে স্থানটি সংরক্ষণ করে দর্শনার্থী উপযোগী কিংবা ইতিহাস সমৃদ্ধ করা যায়। প্রথমত, আমরা ভাবছি এটিকে একটি গ্যালারি করিডোরে সাজাবো। যাতে এ স্থানটিকে ঘিরে ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো সম্পর্কে সাধারণ মানুষজন থেকে শুরু করে ঢামেকে আসা রোগীর স্বজনরাও যেনো বিষয়টি সম্পর্কে সম্যক ধারণা নিতে পারে। দ্বিতীয়ত, এটিকে ঘিরে বড় কোনো ভাস্কর্য কিংবা সংরক্ষণশালা করা যায় কিনা সেটি নিয়েও আমরা ভাবছি। তবে এগুলোর জন্য অর্থের প্রয়োজন। তাই সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। শিগগিরই আমরা সংরক্ষণের কাজটি কারতে পারব বলে মনে করি।’
সেইসঙ্গে ঢামেককে ঘিরে অন্যান্য স্থানে যেসব ঐতিহাসিক ঘটনা আছে সেগুলোও সংরক্ষণের চেষ্টা করা হবে বলে জানান নাসির উদ্দিন।