বিতর্কে জড়িয়ে আ.লীগের সমর্থন হারালেন চসিকের অনেক কাউন্সিলর
২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৮:০০
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম নগরীর বর্তমান কাউন্সিলরদের মধ্যে আওয়ামী লীগের ১৯ জন এবার তাদের দলের সমর্থন হারিয়েছেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ বিতর্কে জড়িয়ে ছিটকে পড়েছেন। কেউ কেউ রাজনৈতিক নানা সমীকরণে বাদ পড়েছেন বলে আলোচনা আছে। শুধু বর্তমান কাউন্সিলর নন, সমর্থনপ্রত্যাশী বিতর্কিতদেরও তালিকায় রাখেনি আওয়ামী লীগ। এবার আওয়ামী লীগের সমর্থন দেওয়া কাউন্সিলরদের তালিকায় নতুনদের জয়জয়কার।
চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, নগরীর ৪১ ওয়ার্ডে এবং ১৪টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডের অধিকাংশে পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির প্রার্থী দিতে পেরেছে দল। এতে সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তিও মানুষের কাছে বাড়বে। তবে কয়েকটি ওয়ার্ডে আবার কয়েকজন সমালোচিত কাউন্সিলর বাদ না পড়ায় কিছুটা সমালোচনাও আছে নেতাদের মধ্যে।
নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন সারাবাংলাকে বলেন, ‘কাউন্সিলর হিসেবে আমাদের দল যাদের সমর্থন দিয়েছে, তাদের ৯৫ ভাগই স্বচ্ছ ভাবমূর্তির ও বিতর্কমুক্ত। যারা বাদ পড়েছেন, তাদের সবাই বিতর্কিত— এমন নয়। কোথাও কোথাও হয়তো দল মনে করেছে, বিদ্যমান কাউন্সিলরকে বাদ দিয়ে নতুন কাউকে সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন। সেই বিবেচনায়ও দিয়েছেন হয়তো। এখন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দায়িত্ব হচ্ছে ভেদাভেদ ভুলে মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের জিতিয়ে আনা।’
বাদ পড়া কাউন্সিলরেরা হলেন— ১ নম্বর দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ডে গাজী মো. তৌফিক আজিজ, ২ নম্বর জালালাবাদে শাহেদ ইকবাল বাবু, ৯ নম্বর উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডে জহুরুল আলম, ১১ নম্বর দক্ষিণ কাট্টলীতে মোরশেদ আক্তার চৌধুরী, ১২ নম্বর সরাইপাড়ায় সাবের আহম্মদ, ১৩ নম্বর পাহাড়তলীতে মোহাম্মদ হোসেন হিরণ, ১৪ নম্বর লালখানবাজারে এ এফ কবির মানিক, ২৫ নম্বর রামপুরে এস এম এরশাদ উল্লাহ, ২৭ নম্বর দক্ষিণ আগ্রাবাদে এইচ এম সোহেল, ২৮ নম্বর পাঠানটুলীতে আব্দুল কাদের, ৩০ নম্বর পূর্ব মাদারবাড়ি ওয়ার্ডে মাজহারুল ইসলাম, ৩১ নম্বর আলকরণে তারেক সোলায়মান সেলিম, ৩৩ নম্বর ফিরিঙ্গিবাজারে হাসান মুরাদ ও ৪০ নম্বর উত্তর পতেঙ্গায় জয়নাল আবেদিন।
সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলদের মধ্যে যারা বাদ পড়েছেন, তারা হলেন— জেসমিন পারভিন, আবিদা আজাদ, আনজুমান আরা বেগম, ফারহানা জাবেদ ও ফেরদৌসি আকবর।
চট্টগ্রাম নগরীর সবচেয়ে সংঘাতপ্রবণ ওয়ার্ড হিসেবে পরিচিত লালখান বাজারে তিনবারের কাউন্সিলর এ এফ কবির মানিকের বিরুদ্ধে পাহাড় দখল করে বসতি স্থাপন, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে মদত দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ আছে। তিনি বাদ পড়েছেন। ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দিদারুল আলম মাসুমও দলের সমর্থন চেয়েছিলেন, কিন্তু পাননি। ছাত্রলীগ নেতা সুদীপ্ত বিশ্বাস হত্যা মামলায় তিনি গ্রেফতার হয়ে কারাগারে ছিলেন। সন্ত্রাসী লালনের অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। লালখান বাজারে আওয়ামী লীগ সমর্থন দিয়েছে অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছ ভাবমূর্তির তরুণ স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আবুল হাসনাত মো. বেলালকে।
বেলাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘লালখান বাজারে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ে যে নেতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে, সেটা থেকে এলাকার ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি নিয়ে আমি ভোটারদের কাছে যাব। যাদের কারণে আমাদের এলাকায় দল বিতর্কিত হয়েছে, জননেত্রী শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে, তাদের বাদ দেওয়ায় এলাকাবাসী খুশি হয়েছেন।’
তবে সমর্থন হারানো কাউন্সিলর মানিক স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।
পাহাড়তলী ওয়ার্ডের চারবারের কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেন হিরণ বাদ পড়েছেন। তার বিরুদ্ধে রেলওয়ের জায়গা দখল, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসের অভিযোগ আছে। হিরণের পরিবর্তে ওই ওয়ার্ডে সমর্থন পেয়েছেন নগর যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ওয়াসিম উদ্দিন।
হিরণ সারাবাংলাকে বলেন, ‘টানা ২০ বছর কাউন্সিলর আছি। অনেকের মঙ্গল করেছি, অমঙ্গলও করেছি। আলোচিত হয়েছি, সমালোচিতও হয়েছি। স্বাভাবিকভাবে দল মনে করছে, আমার কিছুদিন বিশ্রাম প্রয়োজন। আমি বিশ্রামে যাচ্ছি আপাতত। আমি দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাব না।’
ওয়াসিম উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাকে দল সমর্থন দিয়েছে। আমি জননেত্রী শেখ হাসিনা, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও আমার রাজনৈতিক গুরু এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর পরিবারের প্রতি কৃতজ্ঞ। ছাত্র রাজনীতি করতে গিয়ে অনেকের অপবাদ-সমালোচনার শিকার হয়েছি। যদি নির্বাচিত হতে পারি, কোনো ধরনের বিতর্কে না জড়িয়ে, দল ও দলের সভানেত্রীকে কোনো ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে না ফেলে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করব।’
গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা মাদক ব্যবসায়ীর তালিকাভুক্ত হিসেবে নাম আলকরণ ওয়ার্ডের চারবারের কাউন্সিলর তারেক সোলায়মান সেলিমের। তিনি বাদ পড়েছেন। সেখানে প্রার্থী করা হয়েছে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য আবদুস সালামকে।
তারেক সোলায়মান সেলিম দলের ভেতরে ব্যক্তিবিশেষের বিরাগভাজন ও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন বলে দাবি করেছেন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘মাদক ব্যবসায়ীর তালিকায় আমার নাম নেই। এটা ভিত্তিহীন অভিযোগ। ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আমার নাম প্রকাশ করা হয়েছে। আমি চারবারের কাউন্সিলর। ২০১০ সালে আমি নির্বাচন করিনি। তখন এই ওয়ার্ডে বিএনপির প্রার্থী জয়ী হয়েছিলেন। আমার আশঙ্কা, আমি নির্বাচন না করলে আবারও বিএনপি-জামায়াত জয়ী হবে। মানুষেরও চাপ আছে প্রার্থী হওয়ার জন্য। আবার দল সমর্থন দেয়নি। আমার জন্য এটা একটা কঠিন পরিস্থিতি।’
জালালাবাদ ওয়ার্ডে শাহেদ ইকবাল বাবু ও ফিরিঙ্গিবাজার ওয়ার্ডে হাসান মুরাদ বিপ্লব দ্বিতীয়বারেই এসে ছিটকে পড়েছেন। শাহেদ ইকবাল বাবুর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী লালন, অনুসারীদের অপরাধে মদত এবং সংঘাতের রাজনীতি করার অভিযোগ আছে। ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে উঠে আসা হাসান মুরাদ বিপ্লবের তেমন নেতিবাচক ভাবমূর্তি না থাকলেও গত বছর গ্রেফতার ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে নিতে কোতোয়ালি থানায় গিয়ে পুলিশের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে বিতর্কে পড়েছিলেন। এছাড়া তিনি সিডিএ’র বোর্ড সদস্যও।
ফিরিঙ্গিবাজার ওয়ার্ডে হাসান মুরাদ বিপ্লবকে বাদ দিয়ে সমর্থন দেওয়া হয়েছে নগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. সালাহউদ্দিনকে। পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির রাজনীতিক হিসেবে পরিচিত সালাহউদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি তৃণমূল থেকে ছাত্রলীগের রাজনীতি করে নগর কমিটির নেতৃত্বে এসেছিলাম। যেকোনো রাজনৈতিক কর্মীর প্রত্যাশা থাকে, জনপ্রতিনিধি হয়ে জনকল্যাণে কাজ করার। আমি সমর্থন চেয়েছিলাম, দল আমাকে সমর্থন দিয়েছে। আমি দলের ভাবমূর্তি রক্ষায় সবসময় সচেষ্ট থাকব।’
পাঠানটুলী ওয়ার্ডের মো. আবদুল কাদের ওরফে মাছ কাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী ছিলেন। সারাদেশে শুদ্ধি অভিযান শুরুর পর তিনি বেশ কিছুদিন গা ঢাকা দিয়েছিলেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা মাদক ব্যবসায়ীর তালিকায়ও তার নাম আছে বলে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। পাঠানটুলি ওয়ার্ডে সমর্থন পেয়েছেন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা নজরুল ইসলাম বাহাদুর।
সরাইপাড়া ওয়ার্ডের মো. সাবের আহমদ সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মহিউদ্দিন সোহেল হত্যা মামলার আসামি। তাকে বাদ দিয়ে এবার প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগ সমর্থন দিয়েছে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক নুরুল আমিনকে।
দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তৌফিক আহমেদ চৌধুরী অস্ত্রবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অভিযুক্ত। একাধিক মামলার আসামিও হয়েছেন। তাকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থন দিয়েছে ওয়ার্ডের সভাপতি গাজী মো. শফিউল আজিমকে।
দৃশ্যমান কোনো অভিযোগ না থাকলেও দক্ষিণ কাট্টলীতে মোরশেদ আক্তার চৌধুরীকে বাদ দিয়ে প্রার্থী করা হয়েছে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. ইসমাইলকে। সংরক্ষিত ওয়ার্ডের তিনবারের কাউন্সিলর আনজুমান আরা বেগমকে বাদ দিয়ে সমর্থন দেওয়া হয়েছে রুমকি সেন গুপ্তা নামে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের একজন নেত্রীকে।
নগর আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে আলোচনা আছে, নতুনদের সুযোগ দিতেই বিতর্কিত না হলেও কয়েকজন কাউন্সিলর বাদ পড়েছেন। বিশেষত সংরক্ষিত ওয়ার্ডের প্রার্থীদের মধ্যে যারা বাদ পড়েছেন, তাদের বিরুদ্ধেও তেমন কোনো অভিযোগ নেই। আবার পশ্চিম ষোলশহরের মোবারক আলীর বিরুদ্ধে জায়গা দখল, সন্ত্রাস, আধিপত্য বিস্তার; পশ্চিম মাদারবাড়ির গোলাম মো. জোবায়েরের বিরুদ্ধে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের এক প্রকৌশলীকে মারধর করার অভিযোগ থাকলেও তারা সমর্থন পেয়েছেন। মনোনয়ন বঞ্চিত মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারীদের অধিকাংশকে বাদ দিয়ে প্রয়াত মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারীদের অধিকাংশকে টেনে আনা হয়েছে— এমন আলোচনাও আছে নগর আওয়ামী লীগে।
২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত করপোরেশনের সর্বশেষ নির্বাচনে ৪১টি সাধারণ ওয়ার্ডের মধ্যে ৩৫টিতে এবং সংরক্ষিত ১৪টির মধ্যে ১১টিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জয়ী হন। বুধবার (২০ ফেব্রুয়ারি) আওয়ামী লীগ তাদের সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর তালিকা প্রকাশ করেছে।
আ জ ম নাছির আওয়ামী লীগ কাউন্সিলর চট্টগ্রাম চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন চসিক মেয়র মহিউদ্দিন