দুঃসংবাদ আনছে মশা, বৃষ্টি হলে ঘনত্বের রেকর্ড ছাড়াবে
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ২২:১৮
ঢাকা: ২০১৯ সালকে বাংলাদেশে ডেঙ্গু আতঙ্কের বছর বলা যেতে পারে। প্রথমবার এক মৌসুমে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। আক্রান্ত হন ৬৪ জেলার মানুষ। এ বছর এরই মধ্যে মশার উপস্থিতি টের পাচ্ছে রাজধানীর মানুষ। দুঃসংবাদ হচ্ছে, গত বছরের এই সময়ের তুলনায় এবার মশার ঘনত্ব বেশি। যা সামনের দিন আরও বাড়তে থাকবে। আর বৃষ্টি হলে মশার বিস্তার হু হু করে বাড়তে পারে। সম্প্রতি রাজধানীর কয়েকটি এলাকার ডোবা, খাল বা মশার প্রজনন ক্ষেত্র গবেষণা করে এসব তথ্য পেয়েছেন গবেষকরা।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের কন্ট্রোল রুমের সহকারি পরিচালক ডা. আয়শা আক্তার জানান, এ বছর এখন পর্যন্ত সারাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন ২৩৯ জন রোগী। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরীতে ১৭৮ জন ও বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে ৩০ জন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। অথচ ২০১৯ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার রোগীর সংখ্যা ছিল ৫৬ জন।
গত বছর ডেঙ্গু রোগ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লে বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, এই রোগের ধরণ পাল্টেছে। এটি এখন আর কোনো নির্দিষ্ট মৌসুমের রোগ নেই। বছরজুড়েই থাকতে পারে ডেঙ্গু। একই কথা জানানো হয় সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পক্ষ থেকেও।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার সারাবাংলাকে জানান, বাংলাদেশে ১২৩ প্রজাতির মশা রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকাতেই রয়েছে ১৩ প্রজাতির। কিন্তু কিউলেক্স মশাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতেই আমরা ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার ঘনত্ব পেয়েছি। তবে সবচেয়ে বেশি পেয়েছি কিউলেক্স মশা। বর্তমানে ঢাকা শহরের ১০০ শতাংশ মশার মধ্যে ৯৫ শতাংশ হচ্ছে কিউলেক্স মশা।
তিনি আরও বলেন, অনেকদিন ধরে কোনো বৃষ্টিপাত না থাকায় মশা জন্মানোর স্থানগুলোতে পানির অর্গানিক ম্যাটেরিয়াল বেড়ে গেছে। এই অর্গানিক ম্যাটেরিয়ালগুলো কিউলেক্স মশার লার্ভার খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে সারাদেশে তাপমাত্রা কিছুটা বেড়েছে যা মশা জন্মানোর জন্য উপযুক্ত। গত কয়েক দিনে অগণিত ডিম দিয়েছে মশা। এসব ডিম আগামি ১৫ দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ মশায় রূপান্তরিত হবে। অতি জরুরি ভিত্তিতে ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নিয়ে মশা জন্মানোর স্থানগুলোতে লার্ভিসাইড ছিটানো না হলে মার্চ মাসে ভয়াবহ আকার ধারণ করবে মশা।
ড. কবিরুল বাশার আরও জানান, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসের প্রতি সপ্তাহে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে তার গবেষক দল মশার লার্ভা সংগ্রহ করে। কিউলেক্স মশার লার্ভার ক্ষেত্রে ঘনত্ব পরিমাপের জন্য প্রতি ৫০০ এমএল পানিতে মশার লার্ভাসংখ্যা গণনা করে ঘনত্ব পরিমাপ করা হয়। গত এক সপ্তাহের জরিপে ঢাকার বেশিরভাগ কিউলেক্স মশার ঘনত্ব ২০০-এর ওপরে দেখা গেছে। একইসঙ্গে ড্রেন, ডোবা ও নর্দমায় প্রচুর ডিম দেখা গেছে।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এই জরিপ থেকে জানা গেছে, জানুয়ারিতে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরীবাগ ও শাহবাগ এলাকায় মশার ব্রুটো ইনডেক্স ছিল সবচেয়ে বেশি ২৬ দশমিক ৬৭। এ ছাড়া লালমাটিয়া-মোহাম্মদপুরে ১০, গুলশান-বনানীতে শূন্য, বাসাবো-খিলগাঁওয়ে ১৩ দশমিক ৩৩, শাঁখারীবাজার ও পাটুয়াটুলীতে ১৩ দশমিক ৩৩ ছিল। এছাড়াও ফেব্রুয়ারিতে এখন পর্যন্ত গুলশান-বনানী এবং লালমাটিয়া-মোহাম্মদপুর এ দুটি অঞ্চলের তথ্য নেওয়া হয়েছে। তাতে দেখা যায়, গুলশানে ব্রুটো ইনডেক্স বেড়ে ২০ হয়েছে। লালমাটিয়ায় কমে হয়েছে ৬ দশমিক ৬৭।
মশার লার্ভার উপস্থিতি হিসাব করা হয় ব্রুটো ইনডেক্সের মাধ্যমে। জরিপে প্রতি একশ প্রজনন উৎসের মধ্যে ২০টি বা তার বেশিতে যদি এডিস মশার লার্ভা বা পিউপা পাওয়া যায়, তাহলে সেটাকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ উপস্থিতি’ বলা যায়।
তিনি বলেন, ২৪ থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। সেক্ষেত্রে মশার বংশবিস্তারের জন্য প্রচুর প্রজননস্থল তৈরী হবে। তখন কিন্তু এডিস মশা আরও বেড়ে যাবে। আর এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সকল সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোতে মশক নিধন কর্মসূচি জোরদার করতে হবে। সমন্বিত উদ্যোগ না নিলে পুরোপুরি সুফল পাওয়া যাবে না।
এর আগে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন আইসিডিডিআরবির গবেষক আতিক আহসান। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ডেঙ্গু ম্যানেজমেন্টের জন্য তিনটি ধাপ আছে। প্রথমটি হলো এনটোমোলজিক্যাল অ্যাপ্রোচ, এই ধাপে মশার সার্ভে করা হয়, যা এখন করা হচ্ছে। দ্বিতীয় ধাপে রয়েছে পাবলিক হেলথ অ্যাপ্রোচ। এই ধাপকে এপিডেমিওলজিকাল অ্যাপ্রোচ বলা হয়ে থাকে। আক্রান্ত রোগীকে কেন্দ্র করে এই ধাপে কাজ করা হয়ে থাকে। আর তৃতীয় ও শেষ ধাপ হলো সেরোপ্রিভেলেন্স। অর্থাৎ কোন ধরনের ভাইরাসে রোগী আক্রান্ত হচ্ছে, তা ভাইরোলজিস্টরা ল্যাবে পরীক্ষা করে দেখেন। এক্ষেত্রে রোগীরা কোন ধরনের সেরোটাইপে আক্রান্ত হচ্ছেন, সেটিও দেখা হয়। আইইডিসিআর এই কাজটি মাঝে মধ্যে করলেও এটি প্রতিনিয়ত করে যেতে হবে।
আতিক আহসান বলেন, এই তিনটি ধাপ নিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। শুধুমাত্র এনটোমোলজিক্যাল অ্যাপ্রোচে গিয়ে বাকি দুই ধাপকে গুরুত্ব না দিলে বা তিনটি ধাপের যেকোনো একটিকে বাদ দিয়ে গেলে সেই সুযোগে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে পারে। তখন সেটি নিয়ন্ত্রণে রাখার সম্ভাবনাও কমে যায়। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি ধাপকে গুরুত্ব দিয়ে একসঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে।
এই গবেষক আরও বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে এনটোমোলজিক্যাল ও সেরোপ্রিভেলেন্সের কাজ হচ্ছে বলে আমরা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু এপিডেমিওলজিকাল সার্ভেইল্যান্সটাও করে যেতে হবে, যেন আমি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করতে পারি। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সিটি করপোরেশন, স্বাস্থ্য অধিদফতরসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়ের খুব দ্রুত সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া দরকার বলেও মনে করেন তিনি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক ডিন ও মেডিসিন অনুষদের অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, এখনই হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হচ্ছে। এর মানে হলো ডেঙ্গু এখন আর কোনো নির্দিষ্ট মৌসুমের রোগ নয়। সামনে আবহাওয়া পরিবর্তন হয়ে বৃষ্টি শুরু হবে। তাই এখনই ডেঙ্গু প্রতিরোধে বছরব্যাপী কর্মসূচি নিতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া সারাবাংলাকে বলেন, ডেঙ্গু রোগের ধরণ পাল্টেছে। এটি এখন আর নির্দিষ্ট কোনো মৌসুমের রোগ নেই। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে বছরব্যাপী সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। আমরা হয়তো চিকিৎসাসেবা দিয়ে যেতে পারবো কিন্তু মশা নিয়ন্ত্রণ না হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা কষ্টকর হতে পারে।
জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, বছরজুড়েই ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকতে পারে এটা আমরা আগেই বলেছিলাম। আর এ কারণে মশক নিধন অভিযান বছরব্যাপী চালিয়ে যেতে হবে। কারণ, গত মৌসুমে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছিল সারাদেশে। ঢাকার বাইরে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী দুই ধরনের মশার অস্তিত্বই পাওয়া গেছে। আর তাই দেশব্যাপী মশকনিধন কর্মসূচি অব্যাহত রাখার কোনো বিকল্প নেই।
রাজধানীতে মশক নিধন কর্মসূচীর বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা উত্তম কুমার রায় সারাবাংলাকে বলেন, সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে মশক নিধন কর্মসূচি প্রতিদিনই চালানো হচ্ছে। এতে কোনো ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। অন্যদিকে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ভারপ্রাপ্ত মেয়র জামাল মোস্তফা সারাবাংলাকে বলেন, মশক নিধন কর্মসূচিতে কোনো ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। এটিকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে ডিএনসিসি।
স্থানীয় সরকার (এলজিআরডি) মন্ত্রী তাজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, সারাদেশে মশক নিধন কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদসহ সবাই মিলেই কাজ করছে। এরইমধ্যেই আমরা এ নিয়ে পরিকল্পনা করেছি কি কি কাজ করা যায় ও কিভাবে আরও ভালোভাবে করা যায় সেসব নিয়ে। এতে সবাইকে নির্দেশনা দেওয়া, উদ্বুদ্ধ করা এবং লজিস্টিক সাপোর্ট দেওয়ার বিষয় নিয়েও আমরা কথা বলেছি।
মশার ওষুধ দেওয়া হলেও তা কাজ করছে না। এ বিষয়ে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে সমস্যা মশার ওষুধে নয়। বৈশ্বিকভাবেই এসব ওষুধ পরিবর্তন করা হয়ে থাকে। কারণ ভেক্টর ইম্যুনিটি এন্ড এডাপ্টিবিলিটির উপর নির্ভর করে সারা পৃথিবীতে সময়ে সময়ে ওষুধ পরিবর্তন করা হয়ে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কখনোই এটা বলে না যে একই ওষুধে কাজ করবে। তাদের এখানে সম্পৃক্ততার প্রধান কারণ হলো পরিবেশে এমন অনেক পোকামাকড় আছে যা মানুষের জন্য উপকারি। সুতরাং এমন কোনো ওষুধ স্প্রে করা ঠিক হবে না যা উপকারি পোকামাকড়গুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এজন্য ওষুধ স্প্রে করতে হলে সব দিক ভেবেই করতে হয়।
তিনি বলেন, কিউলেক্স মশা ময়লা আবর্জনাতে বেশি থাকে। আর এক্ষেত্রে সম্মিলিতভাবে আমাদের সবাইকে কাজ করতে হবে। আমাদের কিছু ব্যর্থতা তো আছে। আমরা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়েও কাজ করছি। আর এসব ক্ষেত্রেই কিছুটা সময় তো লাগবেই। আমাদের কিছু খাল সংস্কার করা হয়েছে, কিছু হয় নি। এগুলো চাইলেও রাতারাতি করা যাবে না।
ডেঙ্গু মোকাবিলায় এবার আগের চেয়ে আরও বেশি প্রস্তুত জানিয়ে এলজিআরডি মন্ত্রী বলেন, এখন পর্যন্ত মশক নিধন কর্মসূচি চালানোর জন্য ওষুধ ও মেশিনারিজ নিয়ে কোনো সংকট নেই। পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রস্তুতি আছে। এক্ষেত্রে জনগণের সচেতনতারও বিষয় আছে। ১৬ কোটি মানুষের দেশে সবখানে সরকারের পৌঁছানোটা কঠিন বিষয়। আর তাই জনগণের সম্পৃক্ততা সবচেয়ে বেশি।