লাউয়াছড়ার প্রাণীদের বাঁচাতে বিকল্প সড়কের খোঁজ মিলেছে জরিপে
২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৭:১৭
মৌলভীবাজার: মৌলভীবাজারে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা সড়ক ও রেল পথ যেন এখানে বসবাসকারী বণ্যপ্রাণীদের মরণফাঁদ। প্রতিনিয়তই সড়কে গাড়িচাপায় কিংবা ট্রেনে কাটা পড়ে মরছে প্রাণী। এতে করে এরই মধ্যে বিরল ও বিপন্ন হয়ে পড়া প্রাণগুলো রয়েছে অস্তিত্ব সংকটে।
এ পরিস্থিতিতে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভেতরের পথটি বন্ধ করে দিয়ে উদ্যানের দুই পাশের মধ্যে যোগাযোগের জন্য বিকল্প সড়কের দাবি ছিল দীর্ঘ দিনের। শেষ পর্যন্ত বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ এবং সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের যৌথ এক জরিপে উঠে এসেছে বিকল্প একটি সড়কের প্রস্তাবনা। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, এবারে এই সড়কটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। আর তাহলেই সড়ক ও রেলপথে প্রাণ দিতে হবে না লাউয়াছড়ার বাসিন্দা বন্যপ্রাণীদের।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সরকার ১৯৯৬ সালে ১২৫০ হেক্টরের চিরহরিৎ ও মিশ্র চিরহরিৎ লাউয়াছড়া বনটিকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করে। বনটি উল্লুক, বানর, বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, বনমোরগ, বনরুই, মায়া হরিণ, মেছো বাঘ, বন্য শূকর, অজগরসহ অনেক প্রজাতির বিরল, বিপন্ন ও বিপন্নপ্রায় প্রাণীর আবাস। এখানে রয়েছে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, চার ধরনের উভচর প্রাণী, ৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি ও ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে।
এমন জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এই জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়েই চলে গেছে ঢাকা-সিলেট রেলপথ ও শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সড়ক। রেল ও সড়ক পথের দু’পাশেই উদ্যান। স্থানীয়রা বলছেন, প্রতিদিন এই সড়কে দুই থেকে তিনশ যানবাহন চলাচল করে। আর বনবিভাগের বেঁধে দেওয়া নীতিমালাকে তোয়াক্কা না করে বেপরোয়া গতিতেই চলে যানবাহন। তাতেই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে বন্যপ্রাণীরা।
স্থানীয় পরিবেশকর্মী সুহেল শ্যাম জানান, ঢাকা-সিলেট রেললাইন ও শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সড়কে প্রতিবছর অন্তত ৪০ থেকে ৫০টি বিভিন্ন বিরল প্রজাতির বন্যপ্রাণী মারা পড়ছে। আমরা দীর্ঘ দিন ধরেই এই পথ বন্ধ করে বিকল্প পথ চালুর দাবি জানিয়ে আসছি।
এ বাস্তবতায় ২০১৭ সালের ২ জুলাই ‘লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ও রাতারগুল জলজ বন’ সুরক্ষায় করণীয় বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এক পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের প্রাণী রক্ষায় উদ্যানের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তা সরিয়ে বিকল্প সড়ক নির্মাণের সিদ্ধান্তও হয়। তবে সে সিদ্ধান্ত আলোর মুখ দেখেনি আড়াই বছরেও। শেষ খবর বলছে, অবশেষে সে প্রতীক্ষার অবসান ঘটতে যাচ্ছে।
জানা গেছে, সম্প্রতি বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ এবং সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ বিকল্প সড়ক চালুর বিষয়ে একটি যৌথ জরিপ পরিচালনা করেছে। এতে শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সড়কের শ্রীমঙ্গলের রাধানগর এলাকা থেকে কমলগঞ্জের বটতলা পর্যন্ত একটি বিকল্প সড়ক নির্মাণ করা সম্ভব বলে জরিপে উঠে এসেছে।
বন বিভাগ ও সওজ সূত্রে জানা গেছে, বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ এবং সওজ শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সড়কের বিকল্প হিসেবে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের বাইরে দিয়ে যেসব সড়ক গেছে, সেই সড়কগুলোর ওপর এক প্রাথমিক জরিপ চালিয়েছে। এই জরিপ দলটি শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সড়কের শ্রীমঙ্গল উপজেলার গ্র্যান্ড সুলতান টি রিসোর্ট অ্যান্ড গলফের সামনে থেকে রাধানগর হয়ে যে রাস্তা গেছে, সেই রাস্তাটিকে শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সড়কের কমলগঞ্জ উপজেলার বটতলা নামক স্থানের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার বিষয়ে প্রাথমিকভাবে ঠিক করেছে। এতে রাস্তার দূরত্ব ৮ থেকে ১০ কিলোমিটারের মতো হতে পারে।
বন বিভাগ বলছে, বিকল্প হিসেবে এই রাস্তা করা হলে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান পুরোপুরি সড়কপথ থেকে আলাদা হয়ে যাবে। তখন উদ্যানের ভেতরের সড়কটি বন্ধ করে দেওয়া হবে। এ ছাড়া উদ্যান এলাকা থেকে নূরজাহান চা-বাগান হয়ে যে সড়কটি গেছে, সেটিও বন্ধ করা হবে। যানবাহনে বন্যপ্রাণী মৃত্যুর আশঙ্কা থাকবে না।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের কর্মকর্তা ফরেস্ট রেঞ্জার মোনায়েম হোসেন এ প্রসঙ্গে সারাবাংলাকে বলেন, সওজ’র সঙ্গে আমরা দ্রুতই বসব। আশা করছি দুই মন্ত্রণালয়ের পারস্পরিক উদ্যোগে খুব দ্রুতই বন্যপ্রাণী বাঁচাতে এ সড়ক পথ স্থানান্তরের বিষয়টির সমাধান হয়ে যাবে। এটা বাস্তবায়িত হলে অনেক বন্যপ্রাণীর প্রাণ বেঁচে যাবে।