রাইট উইং পপুলিজম: চিন্তাপ্রসূত ঘৃণার বীজ?
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৮:৫৩
১. সাল ১৯০৮। হিটলারের মন খুবই খারাপ। তার মা ক্লারা হিটলার দীর্ঘদিন ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে মৃত্যুবরণ করেন ১৯০৭ সালে। সেই রেশ তখনো কাটেনি। বিষণ্ণ হিটলার পাড়ি জমান ভিয়েনাতে। উদ্দেশ্য ভিয়েনার একাডেমি অব আর্টসে ভর্তি হওয়া। পরপর দুবার হিটলারের আবেদনপত্র একাডেমি অব আর্টস থেকে বাতিল হয়। প্রচণ্ড ক্রোধে ফেটে পড়েন হিটলার। ভিয়েনাতে অগাস্ট কুবিযেক নামক এক বন্ধুর বাসায় ছিলেন হিটলার। The Young Hitler I Knew নামক বইতে বন্ধু কুবিযেক উল্লেখ করেন, একাডেমি অব আর্টস থেকে রিজেক্টেড হওয়ার পর হিটলারের ব্যর্থতার এই আক্রোশ পুরো মানবজাতির ওপর পড়ে। হিটলারের মনে হয় সমগ্র পৃথিবী তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে এবং তিনি নিজেকে ধোঁকার শিকার হিসেবে মনে করতে থাকেন।
ওই সময় ভিয়েনার মেয়র ছিলেন খ্রিস্টান সোশ্যাল পার্টি’র নেতা কার্ল লুগার। উনিশ শতকের শেষ দিকে রাশিয়া থেকে প্রচুর ইহুদি বিতাড়িত হয়ে ভিয়েনাতে বসতি গড়ে। ভিয়েনার সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক (মার্ক্সবাদী) দল সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক ওয়ার্কার্স পার্টি ভিয়েনায় আসা এই ইহুদিদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য কাজ করতে থাকে। ব্যাপারটি কার্ল লুগারের পছন্দ হয়নি। তার কাছে আগত ইহুদিরা ছিলো জঞ্জালের মতো। দেশের যাবতীয় সমস্যার জন্য তিনি ইহুদিদের দায়ী করা শুরু করলেন এবং এও বললেন তাদের সব সমস্যা সমাধান করা যাবে যদি সমস্ত ইহুদিকে একটি নৌকায় তুলে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। কার্ল লুগারের এই বক্তব্য হিটলারের দারুণভাবে মনে লাগে। আমরা মাথায় রাখি, ভিয়েনায় তৎকালীন ইহুদির সংখ্যা ছিল এক লাখেরও বেশি। এবং অনেকেই ভিয়েনার একাডেমি অব আর্টসে পড়ালেখা করতো, যেখানে হিটলার সুযোগ পাননি।
২. হিটলারের গল্প থেকে আমরা কিছু সময়ের জন্য চলে আসি বর্তমান সময়ে। এ সময় ইউরোপ এবং বিশ্বের অনেক দেশে ‘পপুলিজম’ বা ‘লোকরঞ্জনবাদ’ বা ‘জনতোষণবাদ’ বেশ দারুণভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। পপুলিজম হচ্ছে সোজা কথায় জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণ করে এমন নীতি। তবে উগ্র ডানপন্থী নেতারা এই ধারণাকে পরিচালিত করছে নিজেদের মতো করে। বরিস জনসন (যুক্তরাজ্য), ডোনাল্ড ট্রাম্প (যুক্তরাষ্ট্র), নরেন্দ্র মোদি (ভারত), বলসোনারো (ব্রাজিল), ভিক্টর ওরবান (হাঙ্গেরি), কাজিন্সকির (পোল্যান্ড এর ল’ এন্ড জাস্টিস পার্টির নেতা) মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের দিকে তাকালে দেখা যায়, এদের সবাই নির্বাচিত হয়েছে জনগণের ভোটে কিংবা দলের সমর্থনে। এরা সবাই রাইট উইং পপুলিস্ট। অর্থাৎ আপাতদৃষ্টিতে এরা ‘জনতোষী’ বা বৃহৎ জনগোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। কিন্তু মূলত এরা যেটা করে সেটাকে আমরা বলতে পারি ‘পলিটিক্স অব ফিয়ার’ কিংবা ‘ভয় দেখানোর রাজনীতি’। এরা জনগণকে সরাসরি ভয় দেখায় না। তবে এরা জনগণকে বোঝায় দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার, শুধু তার দেশের জনগণই শ্রেষ্ঠ এবং অন্যকোনো জাতি বা গোষ্ঠীকে দেশে আশ্রয় দেওয়া হলে দেশের সমস্যা আরও বাড়বে। এই অন্ধকার ভবিষ্যৎ থেকে কেবল সেই নেতাই জনগণকে রক্ষা করতে পারবে। কারণ সেই নেতা অনমনীয়, দেশের স্বার্থে নিয়োজিত। মেক্সিকোর সঙ্গে ট্রাম্পের দেয়াল তোলা, ট্রাম্পের অভিবাসন নীতি, শরণার্থীদের গ্রহণ না করা, বরিস জনসনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাওয়ার চাল, নরেন্দ্র মোদির সিএএ/ক্যাব, বলসোনারোর অস্ত্র আইন শিথিলকরণ কিংবা পরিবেশ সংশ্লিষ্ট নীতি খর্ব করা, পোল্যান্ডের মুসলিম বিদ্বেষ- এ সবকিছু নির্দেশ করে রাইট উইং পপুলিস্ট নেতারা তীব্র জাত্যভিমানে ভোগেন এবং ‘সেলফ’ ও ‘আদার’ এর খেলায় এরা সবসময় একজন প্রয়োজনীয় প্রতিপক্ষ বা এসেনশিয়াল অপোনেন্ট তৈরি করে রাখেন। জনগণকে তারা দেখান এই এসেনশিয়াল প্রতিপক্ষের উদারনীতির কারণে দেশে এতো সমস্যা। তাই রাইট উইং পপুলিস্টরা নিজেদের সাধারণ মানুষের আশার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে নেতৃত্ব হাতে তুলে নেন।
৩. প্রশ্ন হচ্ছে জনগণ কেন এদেরকে চায়? সোজা উত্তর মানুষ হিসেবে আমরা ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে ভালো এবং সেরা ভাবতে পছন্দ করি। সেইসঙ্গে মানুষ সিউডো-দেশপ্রেমে নিজেকে নিমজ্জিত করতে পছন্দ করে। অন্যের ভাষা, কৃষ্টি, জীবনযাপনকে এরা হুমকি হিসেবে দেখে এবং নিজের ঘরে অন্যের সংস্কৃতি আসতে দেখলে এরা ‘জাত গেলো জাত গেলো রব’ তুলে একাকার করে ফেলে। রাইট উইং পপুলিস্ট নেতারা ঠিক এই দিকটাকে লক্ষ্য করে এগোয়। আপনারা দেখবেন, ক্রিকেট খেলায় জিতলে আমরা অনেকটা মনে করি নিজেই যুদ্ধ করেছি এবং প্রতিপক্ষকে হেয় করতে কোনরূপ পিছপা হই না। আমরা মনে করি, এভাবে উল্লাস প্রকাশ করা আমাদের অধিকার। সেটা শুধু আমরাই না, সব দেশই কমবেশি করে। উল্লাসেও যে পরিমিতিবোধ থাকা দরকার সেটা আমরা বুঝি না। এই দেশ, সীমানা, গণ্ডি, পতাকা, ভাষা- তথা জাতীয়তাবাদের প্রত্যেকটা উপকরণ যখন নিজেদের ‘শ্রেষ্ঠ’ এবং অন্যকে ‘ছোট’ ভাবতে শেখায় তখন আমরা বলতে পারি ‘জাতীয়তাবাদ’ অসুস্থ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। আর এটাকেই মূল উপজীব্য করে যখন একজন রাজনৈতিক নেতা উঠে দাঁড়িয়ে বলেন ‘আমরাই সেরা, আমার দেশই সেরা; যেকোনো মূল্যেই হোক আমি আমার দেশের স্বার্থ সংরক্ষণ করব’। তখন আপামর জনগণ মনে করে সেই নেতাই ত্রাতা! জনগণের মনের মাঝে সেই নেতা বা নেতার দল ধীরে হিংসা-ঘৃণা ও বিদ্রূপের বীজ বপন করতে থাকে। এই ঘৃণা হতে পারে ধর্ম নিয়ে, গায়ের রঙ নিয়ে, যৌনতা নিয়ে, ভাষা নিয়ে কিংবা অন্যভাবে। তখন নেতা এবং জনগণের বড় একটি অংশ নিজ জাত্যভিমানে একটি ‘কালেক্টিভ আনকনশাস’ তৈরি করে। আর এভাবেই জন্ম নেয় নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবা, অন্যের থেকে আলাদা ভাবা, বিচ্ছিন্ন মনোভাবসম্পন্ন, অসুস্থ জাতীয়তাবাদের ধারক একটি গোষ্ঠী।
৪. হিটলারের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। হিটলার মনে করেছিলেন ভিয়েনার সমস্ত সমস্যার মূলে রয়েছে অভিবাসিত ইহুদিরা। হিটলার ‘আর্য’ জার্মান রক্ত ইহুদিদের মেনে নিতে পারেনি সেই ছোট ঘটনাটি থেকেই। আর পরবর্তীতে তারই ধারাবাহিকতায় জন্ম নেয় ‘হলোকাস্ট’। হিটলার আজ নেই। তবে হিটলারের নিউরনে খেলা করা ঘৃণার বীজ আজও বয়ে বেড়াচ্ছে বহু মানুষ এবং তাদের সমর্থিত নেতারা।
লেখক: সহকারী সচিব (প্রেষণে অধ্যয়নরত, লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স এন্ড পলিটিক্যাল সায়েন্স)