Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্রবাসের বিভীষিকা জয় করে ৬ নারীর ‘ধ্রুবতারা’


৫ মার্চ ২০২০ ১৩:২২

ঢাকা: ‘ভাতের জন্য গেছিলাম গো আফা। কিন্তু সেই ভাতের কষ্টেই ফিরে আইতে হইলো,’— বলছিলেন সৌদি ফেরত নির্যাতিতা বানু। সেইসঙ্গে নিজের একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই না থাকার কষ্টে চোখ ফেটে জল ঝরতে থাকে তার।

বানুর মতো এমন আরও পাঁচ নারী শাহানাজ, আসমা, মাসুদা, জুবাইদা আর ডালিয়া। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের এই ছয় নারী এখন একসঙ্গে এক ছাদের নিচে গড়েছেন ভাগ্য বদলানোর ঠাঁই। ‘ধ্রুবতারা ক্যাটারিং সার্ভিস’ গড়ে শুরু করেছেন স্বাধীন ব্যবসা। অল্প দামে মানসম্মত খাবার রান্না করে নিজেরাই বিক্রি করেন দিনভর।

বিজ্ঞাপন

সবার গল্পটাই কমবেশি এক। ভাগ্য ফেরানোর আশায় সৌদি আরব গিয়েছিলেন। একদিকে মাথায় বিশাল ঋণের বোঝা, অন্যদিকে দেশে ক্ষুধার্ত পরিবার। কিন্তু ভিনদেশে পাড়ি দিয়ে ভাগ্য বদলানো তো দূরের কথা, উল্টো মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে তাদের। প্রতিনিয়ত নির্যাতন, নিষ্পেষণ আর শারীরিক-মানসিক যন্ত্রণায় বিদ্ধ হওয়া— এই ছিল তাদের নিয়তি।

শেষ পর্যন্ত অসম্ভব শারীরিক আর মানসিক নির্যাতনে প্রায় পঙ্গু অবস্থায় ফিরে এসেছেন দেশে। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে তিন তলা থেকে লাফিয়ে প্রাণে বাঁচার চেষ্টা পর্যন্ত করেছেন একজন। কারও পঙ্গুত্ব শরীরে, কারও মনে।

সেসব দুর্বিষহ দিন পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন এই নারীরা। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাকের সহায়তায় ‘ধ্রুবতারা ক্যাটারিং’ শুরু করে তারা এখন দিনবদলের স্বপ্ন দেখছেন। প্রতিদিন দুই বেলা রান্না করা খাবার বাটিতে করে বিক্রি করেন কঠোর পরিশ্রমী ছয় নারী। প্রতিবেলায় ৪০ থেকে ৭০ জনের খাবার রান্না করেন তারা। তারপর নিপুণ হাতে বাটি সাজিয়ে ব্যাগে ভরে নিয়ে যান বিক্রির উদ্দেশ্যে। মেন্যুতে থাকে মাছ/মাংস, ডাল, ভর্তা, সবজি আর ভাত। আর এর দাম মাত্র ৭০ টাকা। দামে কম হলেও খাবারের মান আর স্বাদ নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারবে না— এমন আত্মবিশ্বাসের কথাই জানালেন তারা।

বিজ্ঞাপন

‘ধ্রুবতারা ক্যাটারিং’য়ের রান্নাটা করেন শাহানাজ। তাকে গুছিয়ে দেন আসমা, বানু, মাসুদা আর জুবাইদা। হিসাব-নিকাশ জানা ডালিয়াকে দিয়েছেন হিসাবরক্ষণ আর ব্যবস্থাপনার কাজ। সঙ্গে নিয়েছেন মালয়েশিয়া ফেরত তরুণ মুক্তারকে। বিদেশে শ্রমিকের জীবনে অসম্ভব নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে তাকেও। বাজার-সদাই আর বাইরের আরও কিছু কাজ সামলে রাখেন মুক্তার।

সকাল ৬টা বাজে দিন শুরু হয় তাদের। রান্না আর গোছানো শেষ করতে করতে সাড়ে ১০টা থেকে ১১টা বেজে যায়। কোনোরকমে মুখে দু’টো ভাত দিয়ে ১১টার আগেই বেরিয়ে পড়েন তারা। বিকেল নাগাদ সব বাটি বিক্রি হলে তবে বাড়ি ফেরেন। ফিরেই আবার শুরু করেন রাতের রান্না। রাত ১০টা বাজলেই আবার বেরিয়ে পড়তে রাতের খাবার বিক্রি করতে। সেই বিক্রিবাট্টা শেষ হলে রাতে ফিরে ঘুমাতে ঘুমাতে ১টা বেজে যায় কোনো কোনো দিন।

শাহানাজ-আসমাদের জীবনটা কঠোর পরিশ্রমের। মাছ, মাংস, সবজি রেঁধে বাটিতে ভরলেও নিজেরা কোনোমতে একটু ভর্তা আর ডাল দিয়েই খেয়ে নেন এক প্লেট ভাত। শুধুই কী ক্যাটারিংয়ের কাজ, এরই মধ্যে ঘরদোর গোছানো, গোসল, খাওয়াও তো রয়েছে। বিশ্রামের সুযোগ নেই বললেই চলে। রাস্তায় বসে খাবার বিক্রি করে শেষ করার অনিশ্চয়তা তো আছেই। তবুও প্রবাসে গিয়ে ভাগ্য বদল করতে না পারা এই নারীরা নতুন করে ভাগ্য বদলের আশায় সব অনিশ্চয়তা মাথায় নিয়েও করে যাচ্ছেন কঠোর পরিশ্রম।

সৌদি আরব থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে ফিরে আসার পর পরিবারের প্রতিক্রিয়া কী ছিল— জানতে চাইলে ছয় জনই বলেন, মোটেই সুখকর ছিল না। পরিবার ঋণ করে বিদেশ পাঠায় তাদের। বিদেশ থেকে নির্যাতনের খবরে আর ফেরার পর ঘরে জায়গা হয়নি তাদের। এর মধ্যে একজনের রয়েছে একটি সন্তানও। পরিবারে জায়গা না পেয়ে তাকে যেন পড়তে হয় আরও একটু বেশি অসহায়ত্বের মধ্যে।

কোনোরকমে খেয়ে-পরে থাকলেও পরিচ্ছন্নতার দিকে তাদের তীক্ষ্ণ নজর। রান্নাসহ ও খাবার প্রস্তুতির পুরো প্রক্রিয়া তারা সারেন গায়ে অ্যাপ্রন, মাথায় টুপি ও হাতে গ্লাভস পরে। শাহানাজ বলেন, পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে ব্র্যাকের পক্ষ থেকে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল।

জানা গেল, এই ছয় নারীকে এককালীন প্রায় চার লাখ টাকা দেয় ব্র্যাক। তা দিয়েই গত বছরের অক্টোবর থেকে শুরু ‘ধ্রুবতারা ক্যাটারিং’য়ের যাত্রা। ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির তথ্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ আল আমিন জানালেন, দক্ষিণখানে আপাতত ছয় মাসের জন্য একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করে দেওয়া হয়েছে ব্র্যাকের পক্ষ থেকে। একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টও খুলে দিয়েছেন তারাই। এখন বিভিন্ন জায়গায় স্থায়ীভাবে খাবার সরবরাহের জন্য যোগাযোগের কাজটাও তারাই করে দিচ্ছেন।

শাহনাজ-আসমারা বলছেন, টুকটাক আয় হলেও লাভের মুখ দেখতে প্রয়োজন বিক্রির পরিমাণ বাড়ানো। এদিকে, ব্র্যাকের ছয় মাসের সেই মেয়াদ শেষ হবে আগামী মাসে। এরপর কী করবেন— জানতে চাইলে সংগ্রামী এই নারীরা জানালেন, আরও একটু বড় দেখে নতুন একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়ার পরিকল্পনা আছে তাদের। তাদের মতো নির্যাতনের শিকার আরও যারা আছেন, তাদেরও সঙ্গে নিতে চান তারা।

নিজেদের পায়ের নিচের মাটি শক্ত করতে বদ্ধপরিকর এই নারীদের স্বপ্নটা পূরণ হবে যদি সবাই তাদের পাশে দাঁড়ায়। না, মানুষের কাছে অর্থ সহায়তা চান না তারা। চান সুনির্দিষ্ট গ্রাহক। কারণ সারাদিন রোদে ঘুরে ঘুরে খাবার বিক্রিতে কষ্ট তো রয়েছেই, তার চেয়েও বেশি রয়েছে অনিশ্চয়তা। সেই অনিশ্চয়তার অবসানই হতে পারে কোনো সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে খাবার সরবরাহ করার সুযোগ পেলে।

আশার কথা, এর মধ্যে বুধবারই (৪ মার্চ) প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে ডাক পেয়েছিল ধ্রুবতারা ক্যাটারিং। ডালিয়া জানালেন, ২০ প্যাকেট খাবার নিয়ে গিয়েছিলেন। সবাই বেশ প্রশংসা করেছেন। এখন থেকে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ প্যাকেট খাবার সরবরাহ করতে হবে তাদের।

এরকম নিয়মিত খাবারের অর্ডারেরই অপেক্ষা করছেন ‘ধ্রুবতারা ক্যাটারিং’য়ের ছয় নারী। মাসুদা আর জুবাইদা বললেন, নিয়মিত খাবার সরবরাহের সুযোগ পেলে প্রতিদিন চার থেকে পাঁচশ প্যাকেট খাবারও তৈরি করতে পারবেন তারা। তখন একবছরের শিশুকে নিয়ে সারাদিন রোদে ঘুরে খাবার বিক্রির কষ্টটা কমবে। নিজেদের পাশাপাশি তখন নির্যাতনের শিকার আরও নারীর কর্মসংস্থানের সুযোগও তৈরি করতে পারবেন— এমন আশাবাদ তাদের।

০১৭৪১৫১৩৩৩০ মোবাইল নম্বরটি ‘ধ্রুবতারা ক্যাটারিং’য়ের হটলাইন হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আগ্রহীরা এই নম্বরে ফোন করেই খাবার অর্ডার করতে পারবেন।

৬ নারী ধ্রুতারা বিভীষিকা