২১ বছরেও হয়নি উদীচীর সম্মেলনে বোমা হামলার বিচার
৬ মার্চ ২০২০ ০৭:৫৭
যশোর: ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ গভীর রাতে যশোর টাউন হল মাঠে উদীচীর দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পর পর দু’টি শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন ১০ জন। এতে আহত হয় আড়াই শতাধিক নিরীহ মানুষ। নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পার হলেও বিচারের মুখোমুখি করা যায়নি মূল ঘাতকদের।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ‘রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ’ আর ‘গোজামিলের তদন্তে’র কারণে খালাস দেওয়ার মাধ্যমে আদালত বিচার প্রক্রিয়া শেষ করতে বাধ্য হয়। বর্তমান সরকার আমলে নারকীয় এই হত্যাযজ্ঞের ঘটনার পুনঃতদন্তের কাজ শুর হলেও তা আবারও আবার থমকে গেছে।
সেই রাতে যশোর টাউন হল মাঠে উদীচীর সমাপনী আয়োজনে হাজারো দর্শক-শ্রোতার ভিড়ে গান শুনছিলেন শ্রমজীবী তরুণ নাহিদ। হঠাৎ পরপর দু’টি বোমা বিস্ফোরণে রক্তে ভেসে যায় টাউন হল মাঠের সবুজ ঘাসে ভেজা চত্বর। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে মানুষের রক্তাক্ত দেহ। রক্তাক্ত মানুষের ভিড়ে পড়েছিল নাহিদও। চিকিৎসায় বেঁচে উঠলেও কেটে ফেলতে হয় তার দু’টি পা।
অনেকদিন পরে হলেও পঙ্গু নাহিদের কপালে জুটেছে পরিবহন সেক্টরের লাইনম্যানের ২৫০ টাকা হাজিরার একটি চাকরি। কিন্তু হাজিরার সামান্য টাকা সংসার চালতে হিমশিম খেতে হয় তাকে। তারপরও পঙ্গু-হতদরিদ্র নাহিদের কাছে আরও বেশি কষ্টের উদীচী ট্রাজেডির ঘাতকদের বিচার দেখতে না পারাটা।
উদীচী ট্রাজেডিতে পঙ্গু হওয়া নাহিদ বলেন, ‘বিচার না পাওয়ার কষ্ট সবসময়ই কাজ করে। বিচার কেন পাবো না, সকল অপরাধের বিচারই তো বাংলাদেশে হচ্ছে। আমাদের উদীচী ট্রাজেডির বিচার কেন হবে না? আমরা এই ঘটনার এমন বিচার চাই যাতে আর কেউ এমন বোমা হামলা, জঙ্গি কার্যক্রমে না জড়ায়।’
সেদিনের ওই বোমা হামলায় আহত ও নিহতর পরিবার হামলায় জড়িতদের শনাক্ত এবং বিচার করতে না পারায় হতাশ। বোমা হামলায় আহত সাংস্কৃতিককর্মী সুকুমার বলেন, ‘সরকার যদি না চায় তাহলে উদীচী কেন বাংলাদেশে কোনো ঘটনারই বিচার হবে না। সেই জায়গা থেকে ২০ বছর পরও বিচার চাওয়াটাও আমাদের জন্য লজ্জাজনক।’
হত্যাকাণ্ডের পর পৃথক দু’টি মামলা হলেও সিআইডির ত্রুটিপূর্ণ চার্জশিটের কারণে ২০০৬ সালের ৩০ মে আদালত থেকে খালাস পেয়ে যায় এই মামলার সব আসামি। পরে সরকার ওই রায়ের বিরদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করলে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত হলেও আটকে আছে আইনের বেড়াজালে।
সরকারি কৌশুলি জানিয়েছেন বিষয়টি উচ্চ আদালতের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। তবে খুব শিগগিরই মামলার কার্যক্রম শুরুর ব্যাপারে আশাবাদ তারা। যশোরের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ইদ্রিস আলী বলেন, ‘বর্তমানে এই মামলার জীবিত আসামিরা জামিনে আছেন। এখনও এই মামলায় উচ্চ আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় যশোরে এসে পৌঁছায়নি। আমি দ্রুত অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসে যোগাযোগ করবো, যাতে এই মামলার কাজ ত্বরান্বিত হয়।’
যশোর উদীচী’র ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহবুবুর রহমান মঞ্জু বলেন, “দেশে বোমা হামলার কালো অধ্যায় শুরু হয় যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলার মধ্য দিয়ে। নৃশংস এই হামলার ‘খলনায়কদের’ ষড়যন্ত্র এখনও রয়েছে অব্যাহত। এদের নিশ্চিহ্ন ও বিচারের মুখোমুখি করা না গেলে মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠির এই ষড়যন্ত্র থামানো কঠিন।”
তিনি আরও বলেন, ‘এই বোমা হামলার ঘটনায় আহত বা নিহতদের পরিবারের যে আকুতি — আমরা এই ঘটনার বিচার কবে পাবো? আমরা উদীচীর পক্ষ থেকে কিন্তু তাদের কোনো জবাব দিতে পারি না। প্রথম থেকেই এই মামলাটি রাজনৈতিক উদ্দেশে পরিচালিত হচ্ছে। এ কারণে কোনো সরকারের আমলে এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি, যে কারণে বিচারই পাওয়া যাচ্ছে না। ’
উল্লেখ্য, বর্তমানে মামলাটি উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। ২৩ আসামির মধ্যে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে আর বাকিরা রয়েছেন জামিনে।